#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_৬
রায়ান আর পূর্ণ গাড়িতে চড়ে বসলো। একটু আগেই রেহানা অনুবিকাকে কল করে দ্রুত মিষ্টি দই নিয়ে যেতে বললো। কেননা তাদের বাসায় ডাক্তার হেনরিক ফেয়োল এসছে। তাই অনুবিকা চলে গেছে। পূর্ণ গাড়িতে রায়ানের বুকের একপাশে মাথা রেখে বসে আছে। রায়ান গাড়ির জানলা দিয়ে প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত। আর ড্রাইভার আপন মনে ড্রাইভ করছে। হঠাৎ রায়ান বুঝলো পূর্ণ কেঁপে কেঁপে উঠছে। বসন্ত চলছে বলা যায়। শীত তো নেই আর। তাহলে পূর্ণ কেঁপে উঠছে কেন ভাবতে গিয়ে রায়ানের ভ্রু কুঁচকে এলো। মৃদু ভাবে শুকনো হয়ে যাওয়া ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে রায়ান ইংলিশে প্রশ্ন করলো,
– কি হয়েছে পূর্ণ?
পূর্ণ মাথা সড়িয়ে নিলো রায়ানের বুক থেকে। ঠোঁট উলটে মুখ ফুলিয়ে চোখে জল নিয়ে তাকালো রায়ানের দিকে। রায়ান যেন মূহুর্তের মাঝে অস্থির হয়ে গেলো। পূর্ণর একগালে নিজের ডান হাত রাখতে গিয়ে ব্যাথা অনুভব হলো তার। কিন্তু পূর্ণর চোখের জলকণা গুলো তার মস্তিষ্কে যেভাবে ঝড় তুলছে। সে অনুপাতে এ শারীরিক ব্যাথা কি একবিন্দুও গুরুত্ব রাখবার মিতো? পূর্ণ ভাঙ্গা বাংলায় বললো,
– রাজনীতি আর না। কথা দাও?
এই সাতদিনে হাসপাতালে করবার মতো কিছুই ছিলো না পূর্ণর। তাই অনুবিকা, রেহানা, আয়ান আর সর্বশেষে রায়ানের থেকে বাংলাটা শিখতে শুরু করেছে পুরোদমে। মাইন্ড অনেক শার্প বলে সাধারণের তুলনায় দ্রুত আয়ত্ত করছে সে ভাষাটা। তবে এখনো অনেকটা শেখার প্রয়োজন আছে তার। রায়ান তবুও এইটুকু বাংলা অনায়াসে বুঝলো। এই একই কথা যদি তাকে আয়ান সাহেব গর্জে, আদর করে বলতো। তাহলে মনে হতো বাবার জন্য সে তো সর্বদা থাকবে। চিন্তা কিসের বাবার এতো? কিন্তু এখন রায়ানের ক্ষনিকের জন্য বুক কেঁপে উঠলো। এই মেয়েটাকে এই রাজনীতির চক্করে হারাবে না তো? এতোদিন একবারও কিভাবে সে ভাবলো না নিজের বাবা, মা ও বোনের কথা? বাবা একজন ভালো ব্যবসায়ী। আর তার ছেলে রাজনীতি করে। না জানে কতোটা হেয় হতে হয় তাকে তার পার্টনার দের কাছে। মা’টা ঘরে একা থাকে। যদি কখনো বিরোধী দলের কোনো শত্রু আঘাত হানে তার উপর? বোনটাও তো একাই কলেজে যায়। সামনেই এইচএসসি। পাশ করবার পর সাইকোলজি নিয়ে পড়বে আশা রাখে। যদি রাজনীতির কারণেই কোনো শত্রুর কবলে পড়ে বোনটাকে হারাতে হয় তার স্বপ্ন গুলো? রায়ান যদি পরিবারের এই মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলে? যদি হারিয়ে ফেলে এই নিষ্পাপ প্রাণ যা রায়ান ছাড়া অচল? রায়ান চোখ বুজে নিলো। সিটে মাথা এলিয়ে দিলো। গায়ের মাঝে এক অনুশোচনার উত্তাপ সে অনুভব করছে যেন।হঠাৎ চোখ বুজে রাখা অবস্থায় সে বুঝলো পূর্ণ রায়ানের হাত গলে মাথা ঢুকিয়ে বুকে রেখেছে। উত্তাপ যেন মূহুর্তে মিশে গেলো হাওয়ায়। শুধুই একরাশ প্রশান্তি। আচ্ছা এভাবেই কি একটা মেয়ে এসে একটা যুবককে পরিপূর্ণ করে দেয়? তাই কি তার মা বিয়ের কথা বলে? পূর্ণ আসার আগেও সে পরিবারকে ভালোবাসতো। কিন্তু দায়িত্ব অনুভব করেনি কখনোই। এখন দায়িত্বের পাশপাশি ভালোবাসাটা কি তীব্র ভাবে আগলে নিচ্ছে না তার মস্তিষ্ক? পূর্ণর জন্য কি রাজনীতি ছাড়া যায়? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো রায়ান। পরমূহুর্তেই তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো।
.
.
হেনরিক সাহেবের বুকে ঘাপটি মেরে বসে কেঁদেই চলেছে অঝরে পূর্ণ। ঘরে ঢুকে সোফায় হেনরিক সাহেবকে দেখেই সে ছুটে যেতে চাইছিলো। কিন্তু আবারও ফিরে এসে রায়ানকে ধরে ধরে নিয়ে গেলো লিভিং রুমে বসে থাকা সকলের কাছে। রেহানার পাশেই একটা সোফায় বসিয়ে দিয়ে ছুটে গেলো হেনরিক সাহেবের দিকে। তারপর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কেঁদে চলেছে। উপস্থিত সবার খুব মায়া লাগছে মেয়েটির জন্য। হেনরিক সাহেব না পেরে মুখ খুললেন। ইংলিশে বললেন,
– কেঁদো না সোনা। কেন কাঁদছো তুমি?
পূর্ণ মাথা আরেকটু গুঁকজে দিয়ে বললো,
– ওরা আমায় ছেড়ে দিয়েছে হ্যান্ডসাম। ওরা আমায় এই ভীনদেশে ফেলে চলে গেছে। এতোটাই অনীহা তাদের আমার প্রতি? কেন ফেয়োল? ওরা তোমার মতো কেন হলো না? আমার মাঝে কমতি আছে তা আমি বুঝেছি। কিন্তু আমি বুঝে পাইনা এই কমতি কিভাবে কমাবো? আমাকে কেও ভালোবাসে না কেন ফেয়োল?
হেনরিক খুব মায়া অনুভব করলো। পূর্ণকে আগলে নিলো। সে কখনো বিয়ে করেনি। করলে হয়তো পূর্ণর মতো একটা সন্তান তারও থাকতো। হেনরিক পূর্ণকে জড়িয়ে ধরেই মুখ খুললো পূর্ণর সম্পর্কে সবাইকে জানাতে। কেননা বুঝা যাচ্ছে সবার মাঝে চাপা কষ্টের পাশাপাশি প্রবল কৌতুহল বিরাজ করছে।
– মিস্টার আবির ও মিসেস নিয়াশা নিঃসন্তান ছিলেন। অনেক চেষ্টার পরেও যখন তারা সন্তানের সুখ পেলো না। তখন তারা এডোপ্ট করলো একটি বাচ্চা। কিন্তু তা নিয়ে কখনোই তারা সুখী ছিলো না। তার প্রকৃত কারণ ছিলো মিসেস নিয়াশার কুটিল ভাই বাদল ও তার স্ত্রী হিয়া। তাদের সবসময় নজর মিস্টার আবির ও নিয়াশার সম্পদে। যা একটা সন্তানের জন্য বাঁধা পড়ে ছিলো। তাই তারা সবসময় তাদের মাঝে বিষ সৃষ্টি করতো রক্ত সম্পর্কিত কথা তুলে। আর তাতে সফলও হলো। মিস্টার আবির আর মিসেস নিয়াশা ঐ স্থানে নামকরা তাই এভাবেই পূর্ণকে ত্যাগ করা যেতো না। তাই তারা বাংলাদেশের ট্রিপে এসে পূর্ণকে ফেলে চলে যায়। আমরা সকলে জানতাম পূর্ণ এখানে স্টে করছে কারণ বাংলাদেশ তার ভালো লেগেছে।
হেনরিক থামলো। তার আর বলবার মিতো কিছুই নেই। পূর্ণর কান্না থেমে গেছে। তবুও হিচকি তুলে যাচ্ছে। আয়ান সাহেব কথা বদলালেন। আরো কিছু কথাবার্তার পর সবাই দুপুরের খাওয়া সেড়ে নিলো। হেনরিক জানালেন সে খুব অসুস্থ এক পেশেন্ট ফেলে এসছে অপারেশনের পর। তাকে আজকেই ফিরতে হবে। সন্ধ্যের দিকে সে ফিরে গেলো। পূর্ণর হালকা মন খারাপ হলেও রায়ানের সাথে থেকে তাও ভুলে গেলো। তবে এতো কিছুর মাঝে যে পূর্ণকে জড়িয়ে রায়ানের মাথায় ভয়ংকর কিছু চলছে তা কেও বুঝলোই না। বুঝবার কথাও না।
.
.
চলবে…