পূর্ণময়ীর বিসর্জন পর্ব-৭ ৮

0
1304

#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_ ৭+৮

আরেকটি নতুন সকাল। পূর্ণ ঔষধের জন্য এখনো রায়ানের সোফায় ঘুম। সময়টা সকাল ৮ টা। তবে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো রায়ানের। অতোটা দিন পূর্ণকে বুকে জড়িয়ে হাসপাতালের ওটুকুনি বেডে শুয়ে কেমন বদঅভ্যেস হয়ে গেছে। এই পুরাতন চেনা বিছানাও নতুন মনে হচ্ছে। রায়ান মৃদু হাসলো কথাটা ভেবেই। আস্তে করে উঠে ফ্রেশ হতে ওয়াসরুমে চলে গেলো ধীর পায়ে অনেকটা নিঃশব্দে। পূর্ণর অনেকটা ধকল গেছে এই কটাদিন।একটু ঘুমাক মেয়েটা।
ফ্রেশ হয়েই রায়ান চলে এলো নিচে। অনেকদিন পর আবারও হাসপাতালের থেকে বাড়ি ফিরে একটা চিরচেনা সকাল। কিন্তু সত্যিই চিরচেনা কি? …কোথায় পার্টি অফিসে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো? ছুটোছুটি? রায়ান সোজা চলে গেলো লিভিং রুমে বসে থাকা আয়ান সাহেবের দিকে। পেপার পড়া ব্যস্ত আয়ান সাহেব কাওকে নিজের কাছে দেখে পেপার নামালেন। ছেলেকে দেখে বসবার জায়গা করে দিলেন নীরবে। পেপার ভাঁজ করে সামনে থাকা টি টেবিলে রেখে দিলেন। কোলের উপর হাত ভাঁজ করে বসে রইলেন। ছেলের প্রতি অভিমান জন্মেছে তার। এই রাজনীতির প্রতি নেশার জন্য ছেলেকে হারাতে হতো তার। আয়ান সাহেবকে দেখে বাচ্চার মতো লাগলো রায়ানের। মৃদু হেসে বাবার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। আয়ান সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রায়ান বললো, – বাবা? খুব কথা শুনতে হয়েছে একমাত্র ছেলে রাজনীতি করে, ব্যবসায় বসে না এটা নিয়ে? খুব বেশি হেয় করেছে সবাই? আয়ান সাহেব গলার কাছে একটা পাথরের দলা অনুভব করলেন কান্না ও শব্দের তৈরি। আসলেই হেয় হতে হয়েছে প্রতিবার বেস্ট বিজনেসম্যান এওয়ার্ড নিতে গিয়ে। সবাই আঙ্গুল দিয়ে তাক করে তাকে হেয় করেছে। রেহানা আর অনুবিকা এদিকেই আসছিলেন আয়ান সাহেবকে ডাকতে। এসেই বাবা ছেলের কথা বলার মূহুর্ত দেখে অনুবিকা রেহানাকে আটকে দিলো। ভাই আর বাবার মাঝে অভিমান তার আর ভালো লাগছে না। রায়ান আবারও বলতে শুরু করলো, – আর আমি রাজনীতি করবো না বাবা। আমি তোমার ব্যবসায় সামাল দেবো। আর এটা কোনো জোড়, ভয় বা অন্য কিছুর জন্যে বছি না। এটা পূর্ণর জন্য বলছি। এটা তোমাদের জন্য বলছি। এটা মন থেকে বলছি। আয়ান সাহেব বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। ছেলে তার সত্যিই রাজনীতি ছাড়বে? ব্যবসায়ে হাত লাগাবে? সত্যিই কি এসব হচ্ছে নাকি সব তার কল্পনা? রূপকথার গল্পের ঐ পরীর মতো আচমকা তাদের জীবনে আগমন এক ফালি খুশীর নাম – পূর্ণ। আয়ান সাহেব মুখে চাইলেও কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। শুধু নিজের চোখের জল লুকাতে আর খুশীর বহিঃপ্রকাশে ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। রায়ান চোখ বুজে বাবার বুকে পড়ে রইলো। কতোদিন পর বাবার শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছে সে হিসাব নেই হয়তো।

রেহানা আর অনুবিকা এগিয়ে এলেন আয়ান সাহেব ও রায়ানের কাছে। সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। একটা সময় পর সবাই সবাইকে ছেড়ে দাঁড়ালো। রায়ান তখনই বললো,
– তবে বাবা, এখনই না৷ আমার একটা কাজ আছে। একটু লন্ডন যাবো। এরপর ওখান থেকে ফিরে ব্যবসায় সামলাবো বাবা ছেলে মিলে।
– লন্ডন কেন ভাইয়া?
অনুবিকা প্রশ্নবিদ্ধ স্বরে জানতে চাইলো। রায়ান উত্তর দিলো না। শুধুই হাসি দেখা গেলো তার মুখে। আয়ান সাহেবের ভ্রু কুঁচকে এলো এক অজানা আশংকায়। তাহলে তার ধারণাই কি ঠিক??

পূর্ণ ঘুম ভাঙ্গার পর রায়ান কে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রায়ানের ঔষধ হাতে ছুটে এলো নিচে।এসে দেখলো সবাই লিভিং রুমে সোফার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণ ছুটে এসে রায়ানের হাতে গুঁজে দিলো ঔষধ রেহানা মৃদু হেসে হাত বুলিয়ে দিলো পূর্ণর মাথায়। আয়ান সাহেবের মুখেও হাসি। কিন্তু অনুবিকা একবার ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে তাকালো ভাইয়ের দিকে। আর তাকালো ভাইয়ের মুগ্ধ চাহনীর অধিকারীনি পূর্ণর দিকে।
– আচ্ছা চলো, সবাই খেয়ে নিই। চল ভাইয়া।

পূর্ণকে সুযোগ না দিয়ে অনুবিকা এগিয়ে গিয়ে রায়ানকে ধরে নিয়ে গেলো টেবিলের দিকে। পূর্ণর হালকা মন খারাপই হলো। তবুও সবার সাথে সেও গেলো ডাইনিং টেবিলের দিকে।
.
.
সারাটাদিন বাসার সবার সাথে সময় কেটে গেলো পূর্ণর। কিন্তু রাতে সবার সাথে যখন লিভিং রুমে বসে ছিলো। তখনই রায়ানের মোবাইলে একটা কল এলো। রায়ান কল রিসিভ করে কথা বলে পূর্ণর দিকে তাকাতেই দেখলো পূর্ণর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। চোখের আনাচে কানাচেও লাল হচ্ছে মৃদু ভাবে। আয়ান সাহেব আর রেহানা চুপ করে রইলো বেচারি পূর্ণর কথা ভেবে। আর অনুবিকা ভ্রু কুঁচকে অবস্থা বুঝার চেষ্টায় আছে।
– কোথায় যাবে তুমি?
ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাবে বললো পূর্ণ। রায়ান নিজের শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলো জিহব দিয়ে। এরপর বললো,
– ৭ দিনের জন্য বাইরে যাবো কাজে পূর্ণ।
পূর্ণ খপ করে রায়ানের হাত ধরে রায়ানের বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে বললো,
– না, না।
অনুবিকা বিরক্তি বোধ করলো। মৃদু বিরক্তি প্রকাশ করেই বলে উঠলো,
– ভাইয়া ঘরে বসা না পূর্ণ। কাজ থাকতেই পারে।
পরক্ষনেই রেহানার চোখে চোখে শাসানো দেখে কিছুটা দমে গেলেও বিরক্তি নীরবেই যেন বাড়লো। আয়ান সাহেব উঠে এসে পূর্ণর পাশে বসে বললো,
– এভাবে কষ্ট পায় না মা। রায়ান ৭ দিনের মাথায় চলে আসবে।
পূর্ণ অসহায় ভাবে মাথা তুলে অভিযোগ ভরা চোখে তাকালো আয়ান সাহেবের দিকে। আয়ান সাহেবের খুব কষ্ট লাগলো। তাও জোর পূর্বক হেসে বললো,
– এই ৭ দিনে তুমি একদম বাংলা শিখে নেবে। কেমন? আর এরপর রায়ান খুশী হবে?
পূর্ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
– খুশী হবে?
আয়ান সাহেব মাথা দুকিয়ে বললো,
– হুম, অনেক খুশী হবে রায়ান।
পূর্ণর মুখে হাসি ফুটলো। কিন্তু পরেই আবার রায়ানের বুকে মুখ গুঁজে বললো,
– রায়ান অসুখ।
রায়ান হেসে ফেললো। পূর্ণকে শক্ত হাতে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে বললো,
– অসুখ না পূর্ণময়ী। বলো রায়ান অসুস্থ।
পূর্ণ মাথা তুলে তাকিয়ে নিলো রায়ানের দিকে। এরপর বললো,
– রায়ান অসুস্থ।
রায়ান হাসলো। আয়ান সাহেবও হাসলো। রেহানা বাবা ছেলের মাঝের দূরত্বের অবসান ঘটানো পরীটির দিকে তাকিয়ে। শুধুই অনুবিকার চোখেই যেন একরাশ বিরক্তি। অনুবিকা উঠে চলে গেলো। সেদিকে কেও খেয়াল করলো না। তাহলেই বুঝতো সবটা।
.
.
রায়ান প্যাকিং করছে খাটে থাকা লাগেজে প্রয়োজনীয় জিনিস। কালই সে ফ্লাইটে উঠবে। হেনরিক ফেয়োলকে সে কল করে রেখেছে। তার সাহায্যের প্রয়োজন হবে জানা আছে বেশ ভালো ভাবে রায়ানের। পূর্ণ আসন করে বসে হাঁটুর উপর দুই হাতের ভর রেখে গালে হাত দিয়ে বসে আছে মুখ গোমড়া করে। রাতের খাওয়া একটু আগেই শেষ করেছে সবাই মিলে। পূর্ণকে এভাবে চুপ হয়ে বসে থাকতে দেখে যেন রায়ান অবাকের সব সীমা হারিয়ে ফেলছে। মুচকি হেসে সে পূর্ণকে চট করে কোলে তুলে নিলো। পূর্ণ রায়ানের গলায় জড়িয়ে ধরে কাঁধের একদিকে মাথা এলিয়ে দিলো। রায়ান সেভাবে পূর্ণকে কোলে করেই নিয়ে চললো ছাদের দিকে। সবাই এখন নিজ নিজ রুমে বলেই এভাবে বেড়িয়েছে সে। কিন্তু অনুবিকা যে ভাইকে পূর্ণকে এভাবে কোলে করে ছাএর সিড়িতে পা রাখতে দেখে ফেলেছে তা কারোর জানা হলো না। কারোর জানা হলো না অনুবিকার চোখে বিরক্তির কারণ কি।
.
.
রায়ান ছাদের মেঝেতে শুয়ে আছে। চোখ আকাশে, একহাত মাথার নিচে আরেক হাত পূর্ণর মাথায় বিলি কাটছে। আর পূর্ণ রায়ানের বুকে মাথা রেখে রায়ানকে হাত দিয়ে জাপটে ধরে শুয়ে আছে। রায়ানের দৃষ্টি আকাশের দিকে। পূর্ণ হঠাৎ বলে উঠলো,
– আমি স্বপ্ন দেখি। তুমিও অন্ধকারে ফেলে যাও। আমাকে ফেলে চলে যাও অন্ধকারে।
রায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো পূর্ণর দিকে। পরক্ষনেই মৃদু হেসে বললো,
– কখনো হবার নয়।

দুজনে আবারও নীরবে শুয়ে রইলো। আর অন্যদিকে অনুবিকা নিজের রুমে ছক কষছে নিজের মতো। আর যাই হোক ভাইয়ের মাঝে এক অসুস্থ মেয়ের জন্য সহানুভূতি দেখে মেনে নিলেও ভালোবাসা ধরনের কিছু মেনে নেবে না কখনোই সে। ভাইয়ের জীবন হবে সুন্দর। সেখানে অসুস্থ পূর্ণ মানানসই না। এটাই অনুবিকার ধারণা।
.
.

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here