#পূর্ণিমা🍂
#পর্ব_২
#Sanchita(Writer)
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা অচেনা জায়গায় দেখে ভয়ে চমকে উঠলো পূর্ণি।তার হাতে ক্যানেলা লাগানো। গায়ে সেই হসপিটালের পোশাকের পরিবর্তে অন্য একটা পোশাক!
ভয়ে ভয়ে পুরো কক্ষে চোখ বোলালো পূর্ণি ডান পাশে তাকাতেই দেখতে পেলো চশমা পড়া কম বয়সী একটা মেয়ে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বইয়ের দিকে মনোযোগ তাকিয়ে আছে।
ভয়ে ভয়ে একটু নড়াচড়া করতেই ক্যানেলায় টান পড়লো আর ব্যাথায় পূর্ণি হালকা স্বরে সাউন্ড করলো।
এতে সোফায় বসা মেয়েটি হতচকিত হয়ে উঠলো আর তার দিকে তাকালো।
“একি তুমি উঠে গেছো! তোমার কি কোন সমস্যা হচ্ছে কোথাও ব্যাথা পাচ্ছো?(হতচকিত গলায়)
পূর্ণি ভয়ে কোন কথা বলছেনা তার মাথায় ঘুড়ছে সে কোথায় আছে!তার তো গাড়িটার সাথে ধাক্কা লাগার পর আর কিছুই মনে নেই!আর সামনে বসা এই মেয়েটিই বা কে?
এইরকম হাজারো প্রশ্ন পূর্ণির মাথায় ঘুড়ছে।এরই মাঝে মেয়েটা আবারো বলে উঠলো।
“থ্যাংক গড তোমার জ্ঞান ফিরেছে, আমরা তো ভেবছিলাম তোমার জ্ঞান আর ফিরবেনা!পুরো সাত ঘন্টা পর তোমার এখন গিয়ে জ্ঞান ফিরেছে!আচ্ছা তুমি কি কথা বলতে পারোনা নাকি এইযে কত কথা বলছি তুমি একটাও উত্তর দিচ্ছোনা?(ভ্রু কুচঁকে)
পূর্ণির নির্বাক চোখে মেয়েটিকে লক্ষ্য করলো সুতির একটা থ্রী-পিস,গলায় ওড়না জুলানো,মাথায় ঝুটি করা আর মুখের সামনে দুইপাশ বেয়ে কিছু চুল ছেড়ে রাখা।চোখে চশমা দেখে একদম ভদ্র ঘরের মেয়ে মনে হয়।
পূর্ণি শুকনো গলায় বলল।
” আমি কোথায় আছি?
মেয়েটি মুচকি হেসে বলে উঠলো।
“তুমি এখন আমাদের বাড়িতে আছো!আচ্ছা তুমি তখন প্রেগনেন্ট অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় কি করছিলে?গায়ে হসপিটালের পোশাক ছিলো,তুমি কি হসপিটাল থেকে পালিয়ে টালিয়ে আসছো নাকি?(ভ্রু নাচিয়ে)
পূর্ণির মনে পড়তে লাগলো আগের ঘটনাগুলো। গত চব্বিশ ঘন্টা ধরে তার সাথে নিয়তি এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলো যেনো পূর্ণির প্রতিটা নিশ্বাস ফেলাও কস্টকর হয়ে গেছিলো!প্রতিটা ক্ষণ বিষামদয় এক যন্ত্রণা অনুভব করেছিলো।
পূর্ণির নির্ঝরের কথা মনে পড়লো! সে তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে তাকে মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছে!
পূর্ণির সবচেয়ে বেশি ঘৃণা লাগছে নিরব,মিসেস কনা আর তার বোনের মতো বড় জা আর অভিনব রায় চৌধুরির উপর।
পূর্ণির নিজের উপরও নিজের ঘৃণা লাগছে
বামুন হয়ে সে ভুলবশত চাদেঁর উপর হাত বাড়িয়েছিলো যার ফলে নিয়তি তাকে এইরকম কঠোর শাস্তি দিচ্ছে।
পূর্ণি নির্ঝরের সাথে থেকে থেকে নিজের জায়গাটাই ভুলে গেছিলো সেতো রায় চৌধুরি বাড়ির সামান্য মালি,আশ্রিতার মেয়ে ছিলো।
মালি,আশ্রিতার মেয়ে হয়ে কি এত বড় বাড়ির বউ হওয়া যায়।
সব ভেবে পূর্ণির চোখ বেয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।
সোফায় বসে থাকা মেয়েটি এবার উঠে তার কাছে এসে বসলো আর বলল।
” আচ্ছা তুমি তোমার বাড়ির ঠিকানাটা দাও আমি তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিবো!
মেয়েটির কথা শুনে ভয়ে আতঁকে উঠলো পূর্ণি। ও বাড়িতে যদি সে পুনরায় আবার যায় তাহলে তার সাথে সাথে তার অনাগত সন্তানটাও বাচঁতে পারবেনা।
পূর্ণি ভয়ে ভয়ে দ্রুত বলে উঠলো।
“না আমি বাড়ি যাবোনা!আমার কোন বাড়ি নেই বাড়িতে গেলে আমার সাথে সাথে আমার অনাগত সন্তানটাও বাচঁতে পারবেনা।পৃথিবীর আলো দেখতে পারবেনা!আমাকে মা বলে ডাকবেনা?(ভয়ে ভয়ে)
পূর্ণির কথা শুনে মেয়েটি ভরকে যায়।
পূর্ণি এবার সব বলতে লাগলো মেয়েটিকে। গত দুদিন থেকে এই পর্যন্ত তার সাথে কি কি হয়েছে!
সব শুনে মেয়েটি মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো।
” ও মাই গড! তোমার সাথে এতকিছু ঘটে গেছে।মানুষ এতটা হার্টলেস কিভাবে হতে পারে সামান্য আশ্রিতা,মালির মেয়ে বলে কি এতটা অবহেলা,অত্যাচার করাটা তাদের কি ঠিক হয়েছে!আর তোমার হাসবেন্ডই বা কেমন তোমাকে এইরকম প্রেগনেন্সির টাইমে ডিভোর্স দিয়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে! এরা তো জানোয়ারের চেয়েও অধম?(হালকা রাগী স্বুরে)
পূর্ণির চোখ বেয়ে আপন গতিতে জল বের হয়ে লাগলো। পূর্ণি কাদঁছে তবে নিস্বঃব্দে! কখনো ভাবেনী লাইফে এমন একটা সিচুয়েশনে এসে তাকে দাঁড় হতে হবে।
মেয়েটি আর পূর্ণি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো।
“তোমাকে আর তোমার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি নামক কিট দের কাছে রেখে আসা যাবেনা!আজ থেকে বরং তুমি এখানেই থাকবে আমার সাথে আমি এই ফ্ল্যাটে একলাই থাকি আমার মা,বাবা-ভাইয়া সবাই ইউএস এ থাকে কিছুদিন পর তারাও বিডিতে ব্যাক করবে!ওহ হ্যাঁ তোমার নামটাই তো জানা হলো না।আমার নাম তিথি আর তোমার নাম?(উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে)
পূর্ণির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে এখনো।ডান হাতের কনুই দিয়ে নিজের চোখের জল মুছে নাক টেনে মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠলো।
” পূর্ণিমা।
তিথি চোখে-মুখে উচ্ছ্বাসের ছায়া রেখে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো।
“পূর্ণিমা! আসলেই একদম তুমি তোমার নামের মতোই,তোমার চোখে মুখে পূর্ণিমার উজ্জল আলোই বিরাজমান!আমি ভাবছি নির্ঝর ছেলেটা কিভাবে তোমার মায়া কাটিয়ে এইরকম একটা সিরিয়াস মোমেন্টে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ হলো!
তবে তোমার জন্য আগামীতে সমস্যা হতে পারে! জানো তো এই সমাজের লোক তোমার এই সন্তান নিয়ে অনেক কথা শোনাবে!অবৈধ বলে জাজমেন্ট করবে,অপমান করার চেষ্টা করবে!তোমার পক্ষে একা ওকে এই পৃথিবীতে মানুষ করা সম্ভব না?(চিন্তিত কন্ঠে)
তিথির কথা শুনে পূর্ণির বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো।
পূর্ণি ভাবছে কিভাবে তার অনাগত সন্তানকে পিতৃহীনা ভাবে মানুষ করবে।কিভাবে সমাজের লোকজনের থেকে আড়াল করে ওকে নিজের মতো করে গড়ে তুলবে।
পূর্ণি নিশ্বাস নিতে কস্ট হচ্ছে,তিথির কথাগুলো যেনো তাকে শ্বাস রুদ্ধ করে দিচ্ছে।
“আচ্ছা তুমি এখন এইসব চিন্তা বাদ দাও আমি কিছু খাবার আনছি খেয়ে নিবে!
বলেই তিথি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
পূর্ণি বেডের সাথে হেলান দিয়ে ভাবছে কিভাবে সে একা তার অনাগত সন্তানকে মানুষ করবে,নিজের মতো করে গড়ে তুলবে,অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে।
পূর্ণির ভাবতেও কস্ট হচ্ছে এগুলো সমাজের লোক যদি তাকে আর তার সন্তানকে মেনে না নেয় প্রতিনিয়ত অপমান করে,অবৈধ বলে আখ্যায়িত করে,বিশ্রী বিশ্রী উপাধি দেয়
পূর্ণি চোখ বন্ধ করে মাথা চেপে ধরেছে।
.
.
“গোটা আস্ত একটা মেয়ে পালিয়ে গেছে হসপিটাল থেকে আর তোমরা চেয়ে চেয়ে খালি দেখছিলে!ওকে আটকাও নি কেনো?(রাগান্বিত স্বরে)
মিসেস কণা রায় চৌধুরি” র চেচাঁমেচিতে সকল নার্স,স্টাফরা মাথা নিচু করে রইল।
এদিকে দুহাতে চুল খামচে মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে আছে নিরব
“তোমরা চেয়ে চেয়ে কি করছিলে! এতগুলো লোকের চোখকে ফাকিঁ দিয়ে পূর্ণি পালিয়ে কিভাবে গেলো!ওকে যদি এখন না পাই তাহলে এই হসপিটালের যে কি অবস্থা করবো জাস্ট ডোন্ট নো?(রাগী কন্ঠ)
স্টাফ,নার্সরা মাথা নিচু করে রেখেছে এদিকে মিসেস কণা আর নিরব চেচাঁমেচিই করে যাচ্ছে।
পূর্ণির বড় জা মিশু হাতের সামনে আয়না নিয়ে তাতে মুখ দেখতে দেখতে টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে ভাব নিয়ে বলে উঠলো।
“ঢংয়ের আর শেষ নেই,ন্যাকা শুনুন মা ওই মেয়ে পালিয়েছে তো আরও ভালো হইসে!এত বছরের আপদ ঘাড় থেকে নেমেছে! আর যেখানেই যাক না কেনো কস্ট ওর পিছু ছাড়বেইনা অলক্ষণে মেয়ে!আমাদের আর ওকে নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন আজাইরা প্রয়োজন নেই!(মুখ ভেংচি দিয়ে)
নিরব ভ্রু উচিয়ে মিশুর দিকে তাকালো আর বলে উঠলো।
” বৌদি তোমাকে এতক্ষণ আমি লক্ষ্যই করিনী মনে হচ্ছে আগের চেয়ে আরও হ*ট,সুন্দরি হয়ে যাচ্ছো!কি ব্যাপার কি ক্রিম ইউজ করো?ওয়াও কি রুপ তোমার যদি বড় ভাইয়া না থাকতোনা তাহলে তোমাকে আমিই বিয়ে করতাম!(ভ্রু উচিঁয়ে)
মিশু লজ্জার মুচকি হাসি হাসলো। মিসেস কণা বিরক্তিকর মুখ করে আরেকদিকে ফিরলেন।নার্সরা একেকজন লজ্জায় মাথা নিচু করে অন্য নার্সের সাথে ফিসফিস করতে করতে অন্যদিকে চলে যেতে লাগলো।
“দেখেছিস হিয়া এই লোকজন গুলোকে! মানুষ কতটা খারাপ হলে নিজের আপন বৌদিকে এইসব কু-কথা বলে?
” যার জন্ম দাত্রী মা-বাবারই চরিত্র খারাপ তাদের ছেলে তো খারাপ হবেই!গাছ যেমন তার ফলও তো তেমনই হবে?(ফিসফিস করে)
#চলবে,,