প্রজাপতি উৎসব পর্ব-২৮

0
378

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৮
সেদিন বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেলো। একদিকে শরীর খারাপ, অন্যদিকে মনের ভেতর তীব্র রাগ আর ঘৃণা। আমি কারও সাথে কথা না বলে সোজা বিছানায় চলে গেলাম। চোখ বন্ধ করে অসাড় হয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। মোহন আজ আর আমাকে ঘাটালো না। সবাইকে বললো আমার খুব মাথা ধরেছে।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি ব্যাগ গুছাতে আরম্ভ করলাম। কখনো ভাবিনি আমার সংসার মাত্র তিন মাস স্থায়ী হবে। একেই কি বলে তাসের ঘর? মোহন অফিসে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-রূপামনি, কোথাও যাচ্ছো নাকি?
-হুম।
-কোথায়?
-আমাদের বাড়িতে।
-বাড়িতে? কেন কী হয়েছে?
আমি কাপড় গোছানো বন্ধ করে মোহনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-তোমার কী মনে হয়? নিজের স্ত্রীকে রাতের পর রাত অত্যাচার করছো, মিথ্যে কথা বলে অ্যাবর্সন ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছো। তোমার মত একটা লোকের সঙ্গে আমার কি থাকা সম্ভব?
আমার কাছে থেকে এমন সরাসরি কথা বোধহয় মোহন আশা করেনি। মোহন কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,
-ঠাট্টা করছো, তাই না?
-মানে? ঠাট্টা করবো কেন? তুমি যে একটা আপাদমস্তক মিথ্যুক আর প্রতারক সেটা জানলে কি আমি কোনভাবেই তোমাকে বিয়ে করতাম? তুমি তো আগে আব্বুকে পটিয়েছো।
-রূপা, কথা কিন্তু তীরের মত, একবার বলে ফেললে পরে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। তাই ভেবে বলো প্লিজ।
-আমি ঠিকই বলছি। তোমাকে বিয়ে করে আমি বিরাট ভুল করেছি। আমি আর এ বাড়িতে থাকছি না ।
-তুমি চাইলেই হয়ে গেলো?
-মানে?
-আমি তোমার হাজবেন্ড। আগে ডিভোর্স নাও, তার আগে আমি তোমাকে এখান থেকে কোথাও যাবার পারমিশন চিচ্ছি না।
-কেন? আমি গেলে তোমার কী সমস্যা?
-এত টাকা খরচ করে মাত্র বিয়ে করলাম। এক বছর সার্ভিস না পেলে আমার ফুল লস।
-এক বছর সার্ভিস মানে? কীসের সার্ভিস।
-উফ, তোমার দুই পায়ে পড়ি এত ন্যাকা সেজো না। একটা ছেলে একটা মেয়েকে কেন বিয়ে করে? কোন সার্ভিসের জন্য,বুঝো না? তিনশ পঁয়ষট্টি রাত সার্ভিস দাও, তারপর থাকলে থাকবে, গেলে যাবে।
-আমি কালই তোমাকে ডিভোর্স করবো।
– ডিভোর্স এত সহজ? কেইস হবে, কারণ দেখাতে হবে। এক বছর আগে ছাড়া পাবে না। সুতরাং সোনামণি, মাথা গরম না করে ঠান্ডা মাথায় নিজের কথা ভাবো, তোমার মার ক্লিনিকের খরচের কথা ভাবো, তারপর সিদ্ধান্ত নাও। ওকে? আমি এখন অফিস যাচ্ছি, এখন আর মাথা গরম করতে চাচ্ছি না। এসে কথা বলবো।
মোহনের সাথে তর্ক করে লাভ নেই। ও অফিস যাক। তারপর আমার যা করার আমি তাই করবো। একটু পর মোহন শিস দিতে দিতে অফিস চলে গেলো। আমি নাস্তা সেরে বাবার ঘরে গেলাম। গত এক মাস ধরে বাবার বেডসোর হচ্ছে। আমি অনেক যত্ন করে বাবার পিঠের ব্যান্ডেজ পাল্টে দিই। বাবা প্রতিদিন সকালে আমার অপেক্ষায় থাকেন। কী দুঃখজনক একটা ব্যাপার, মোহন বাদে এই বাড়ির সবার সঙ্গে আমার একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কেমন একটা মায়ার বাধনে জড়িয়ে গেছি। বাবার ব্যান্ডেজ বদলে দিতে দিতে বললাম,
-বাবা, অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি আর মোহনের সাথে থাকতে পারছি না।
বাবা কী বুঝলেন কে জানে। বললেন,
-মোহন আমার নিজের ছেলে, কিন্তু আমি জানি ও সাপের মত নিষ্ঠুর আর ঠান্ডা মাথার। তোমাকে কয়েকদিন দেখেই বুঝেছিলাম তুমি একটা আবেগপ্রবণ মেয়ে। ভেবেছিলাম এরকম একটা ইমোশনাল মেয়ে এই যান্ত্রিক ছেলের পাল্লায় কীভাবে পড়লো। তারপর ভেবেছি হয়তো তোমার আলোয় সেও আলোকিত হবে।
আমি বাবাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। বাবা বললেন,
-আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি মা। আমাদের কাছে বিয়ে ভাঙ্গা একটা বড় ব্যাপার, সোশাল ট্যাবু। আমি আর কী বলবো। যা তোমার জন্য ভালো, তুমি তাই করবে।
-আমি আজই চলে যাবো বাবা। আমার আর ভালো লাগছে না।
-জানি না মোহন কীভাবে নেবে, কিন্তু আমি তো প্রতদিন সকালে তোমার যত্নে অভ্যস্ত হয়ে গেছি মা, আমার খুব কষ্ট হবে।
আমার কান্নার স্বভাব, বাবার হাত ধরে কেঁদে ফেললাম। বাবা আমার মাথায় হাত রাখলেন, কিন্তু আর কিছু বলেলন না। সেদিন দুপুরে আমি ট্যাক্সি নিয়ে গাজিপুর চলে এলাম। আব্বু আমাকে দেখে বললো,
-আরে রূপা, তুই হঠাৎ? বলে আসবি না?
-আমি একদম চলে এসেছি আব্বু।
-মানে?
-আমি আর ওখানে ফিরে যাবো না।
আব্বু চমকে উঠে বললেন,
-কেন? মোহনের সঙ্গে কোন সমস্যা হয়েছে? নাকই শাশুড়ির সঙ্গে?
মোহনের সঙ্গে এমন সব সমস্যা হয়েছে যার বেশীরভাগ বাবাকে বলা যায় না। বললাম,
-শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। কিন্তু মোহনের সঙ্গে কিছুতেই মিলছে না। ওর গায়ে হাত তোলার অভ্যাস আছে।
-মোহন গায়ে হাত তোলে? আমি তো ভাবতেই পারছি না। এত ভালো একটা ছেলে।
-তোমার সঙ্গে হয়তো সে ভালো। ও একেক জনের সঙ্গে একেক রকম।
আব্বুর মন খারাপ হয়ে গেলো। সোফায় বসে মুখে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলো। তারপর বললো,
-তোর চাচা শেয়ারের কিছু টাকা ফেরত দিয়েছে। তোর মার খরচ আমরাই দেখতে পারবো। মোহনকে বলে দেবো ওর আর ইনভল্ভড হবার দরকার নেই। তাছাড়া তোর মার শরীর যত খারাপ বলেছিল, এখন আর ততো খারাপ নেই।
হঠাৎ মনে হলো মোহন কোনভাবে ডাক্তারকে দিয়ে ভুল কথা বলায়নি তো? যেন তাড়াতারি আমাকে বিয়ে করতে পারে? মোহনের পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব না। আমি বললাম,
-মোহনের জন্য এবার পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আগামী বছর প্রাইভেটলি পরীক্ষা দেয়ার জন্য অ্যাপ্লাই করবো।
-সবই বুঝলাম, খালি ভাবছি, আর কিছুদিন দেখলে ভালো হতো না? মাত্র তিন মাস হলো। সন কিছু সেটেল হতেও তো সময় লাগে।
-আর কী দেখবো?
– হয়তো ও এভাবেই বেড়ে উঠেছে। আপ্নন মা না থাকায় নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে জানে না। তুই চলে আশায় এখন হয়তো ওর একটা শিক্ষা হবে।
-জানি না আব্বু ভবিষ্যতে কী হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি ওর সঙ্গে থাকতে পারছি না। অন্তত এখানে কারো যন্ত্রণা ছাড়া ঠান্ডা মাথায় নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারবো।
সেদিন বিকেলে মোহন আমাকে ফোন না করে আব্বুকে ফোন করলো। মোহন নিশ্চয় আব্বুর সঙ্গে মিহি করে কথা বলছে কারণ আব্বুকে উত্তেজিত হতে দেখলাম না। একটু পর ফোন রেখে আব্বু বললো,
-তুই চলে এসেছিস দেখে মোহনের খুব মন খারাপ। কান্না কান্না অবস্থা। বললো ও স্ট্রেসে থাকে বলে তোর সঙ্গে দু একবার খারাপ ব্যবহার করেছে, এমন আর কখনো হবে না। আমার মনে হচ্ছে ও জেনুইনলি স্যরি ফিল করছে।
-তুমি তো জানোই না ও কী করেছে।
-যাই করুক, সে তো স্যরি বলছে। তুই একটু ভাব। মোহন আজ আসতে চেয়েছিল, আমি বলেছি দু একদিন পর আসতে। সে রাজি হয়েছে।
আমি যাই বলি আব্ববু ভাববে আমার রাগের কারণেই আমি চলে এসেছি। মোহন সবাইকে খুব সহজে কনভিন্সড করে ফেলতে পারে। মিনু একদিন কথায় কথায় বলেছে অনেক মেয়েই মোহনকে চিঠি লিখতো। অথচ মোহন বিয়ের আগে বলেছিল, প্রেমিকা তো দূরের কথা, ওর কোন মেয়ে বন্ধুই নেই। তা ছাড়া আমার শ্বশুর সাহেবের বানানো বাড়িরে মোহন ওর বানানো বাড়ি বলে দাবী করেছিল। এ রকম একটা মিথ্যুকের সাথে কতদিন থাকা যায়?
(চলবে)

পর্ব ২৫ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1372051429976547/
পর্ব ২৬ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1373296693185354/
পর্ব ২৭ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1374211096427247/
পর্ব ২৯
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1376901626158194/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here