প্রজাপতি উৎসব পর্ব-৩২

0
461

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩২
আজ টাওয়ার হ্যামলেটে বাঙ্গালীদের অনুষ্ঠান আছে। মোহনের বন্ধু মাসুম ভাই আমাদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছে।
অনুষ্ঠানে ঢুকে মনে হলো আমরা বাংলাদেশেই আছি। রঙ্গিন শাড়ি আর পাঞ্জাবী পরা মহিলা পুরুষে অডিটোরিয়াম সরগরম। আমি চেয়ার টেনে বসতে বসতে টের পেলাম কেউ প্রমিত বাংলায়, কেউ ঢাকার ভাষায় আবার কেউ সিলেটি টানে আড্ডা জুড়ে দিয়েছে। আমাদেরকে দেখে এক আপা এসে বললো,
-আপনাদের তো আগে দেখিনি? এই প্রথম এলেন নাকি আমাদের প্রোগ্রামে?
আমি বললাম,
-জি, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি মাত্র একমাস হলো।
-আমি সাদিয়া। আমি সিলেটে বর্ন অ্যান্ড ব্রটআপ। ইন্টারমিডিয়েটের সময় বিয়ে হয়ে চলে আসি এখানে। তবে ঢাকাইয়া ভালো মাতবার পারি।
-আমি রূপা, আর ইনি আমার হাজবেন্ড মোহন।
-আপনাদের নিয়ে কিন্তু খুব টানাটানি পড়ে যাবে। বিশেষ করে আপনাকে নিয়ে রূপা।
-কেন টানাটানি পড়বে?
-কেন কী আবার? শাড়ি পড়ে আপনাকে এত সুন্দর লাগছে, মনে হচ্ছে কোন ক্লাসিক উপন্যাস থেকে উঠে এসেছেন। তবে মোহন সাহেব যখন আছে ভয় নেই। উনি আপনাকে রক্ষা করবেন। আপনারা কি সেটল করছেন এখানে?
মোহন বললো
-সে রকম তো কিছু ভাবিনি। আমি মাস্টার্স করতে এসেছি, অফিস থেকে এক বছরেরে ছুটি পেয়েছি।
-উহ, সবাই ভাবে ফিরে যাবে, কিন্তু কেন যেন ফেরা হয় না। কীভাবে কীভাবে এখানে শিকড় গেঁড়ে যায়। পনেরো বছর হয়ে গেলো আমি এ দেশে। কিন্তু মনে হয় এই সেদিন গাট্টিবচকা নিয়ে এসেছি। আপনারাও দেখবেন চোখের পলকে সময় কোথায় উধাও হয়ে গেছে।
-তাই?
-জি, তবে এখানে একটা সমস্যা আছে।
আমি বললাম,
-কী সমস্যা?
-ইস্ট লন্ডন মানে হোয়াইট চ্যাপেল, টাওয়ার হ্যামলেট, ব্রিকলেন এসব যায়গায় আমাদের একটা কমফোর্ট জোন তৈরি হয়েছে। বাংলা কথা, বাঙ্গালী খাবার, বাংলা সাইনবোর্ড, এমনকি বাঙালি চাকুরী। এটা একটা মিনি বাংলাদেশ বলতে পারেন। একবার এখানে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর ইউকের মেইনস্ট্রিমে মেশা হয়ে ওঠে না। পার্সোনাল ডেভেলপমেন্ট আটকে যায়।
-আমরা ইজলিংটনে থাকি, ওখানেও অনেক বাঙ্গালী কিন্তু ব্রিকলেন কিংবা গ্রিন স্ট্রিটের মত না।
আপু এবার আমার পেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
-কবে এক্সপেক্ট করছেন?
-নভেম্বরে।
-কংগ্রাচুলেশন্স। বেশী দিন নেই তো।
-জি, বেশী দিন বাকি নেই।
-গাড়ি কিনেছেন?
মোহন বললো,
-এখনো কেনা হয়নি। বাংলাদেশের লাইসেন্সে মনে হয় মাত্র ছয় মাস চালাতে দেয়। এক মাস তো চলেই গেলো।
-তাড়াতাড়ি গাড়ি কিনে ফেলাই ভালো। এখন তো রূপা চালাতে পারবেনা কিন্তু আপনি চাইলে ড্রাইভিং লেসন নিতে পারে। এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ভালো হলেও দরকারে বেদরকারে একটা গাড়ি থাকা লাগে।
-হুম, ভালো অ্যাডভাইস দিয়েছেন।
সাদিয়া আপা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-যতদিন গাড়ি নেই, যে কোন প্রয়োজনে আমাকে কল করবেন, আমার ফোন নম্বর দিয়ে দেবো।
সাদিয়া আপুর বয়স বোঝা যায় না। শরীরের আঁটো গড়ন দেখে মনে হয় বয়স পঁয়ত্রিশ। আবার চোখের কোণে বলিরেখা জানান দেয় ওনার বয়স পঁয়তাল্লিশও হতে পারে। তবে সাদিয়া আপু এই কমিউনিটির কেউকেট গোছের কেউ হবেন। সবাই ওনার সঙ্গে একবার করে কথা বলে যাচ্ছে। মোহন ওর বন্ধুর সঙ্গে অন্যদিকে চলে গেলো। সাদিয়া আপু আমাকে মেয়েদের ভিড়ে দিকে নিয়ে গেলো। যেতে যেতে একটা মেয়েকে দেখিয়ে বললো,
-ওই যে মেয়েটা দেখছেন না, সবুজ শাড়ি পরা।
-হ্যাঁ, ভেরি প্রিটি।
-ও এলিটা। ওর সঙ্গে হাই হ্যালো করবেন কিন্তু বেশী মিশবেন না।
-কেন?
সাদিয়া আপু আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো,
-দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে। অনেক গল্প আছে, পরে বলবো।
সাদিয়া আপাকে আসতে দেখে লাল শাড়ি আর কালো হিজাব পরা একটা মেয়ে এসে বললো,
-আপা, আমার গানটা আগে দেয়া যায় না?
-সব তো স্কেজুল করা, তোমাকে আগে দিলে অন্যরা কাউমাউ করবে।
-আমাকে চারটায় আরেক যায়গায় যেতে হবে, সেমিনের মেয়ের জন্মদিন।
-আচ্ছা দেখি কী করা যায়। এনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনাকে বোধহয় আগে দেখিনি। আমি শাপলা।
-আমি রূপা, এক মাস হলো এখানে এলাম। আগে কোন প্রোগ্রামে আসিনি তো।
-অনেক দিন তো কোন অফলাইন প্রোগ্রাম হয়নি, কভিডের জন্য সব অনলাইন ছিল। আপনি সময় মতই এসেছেন।
শাপলা ওনার হাজবেন্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদদ্রলোক মহা আগ্রহে গল্প জুড়ে দিলো, সঙ্গে যোগ দিলো ওনার আরেক বন্ধু। এভাবে কে কখন এসে গল্প করে গেলো আমি ঠাওর পেলাম না।
একটু পর হঠাৎ মোহন আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে এক পাশে ডেকে নিলো। থমথমে গলায় বললো,
-রূপা, একটা রিকোয়েস্ট করবো?
-হ্যাঁ, শিওর।
– টয়লেটে গিয়ে ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে এসো।
-কেন?
-অনেক লোক তোমার সঙ্গে এসে গল্প করছে।
-আমি কী করবো এরা কথা বললে? আমি তো না করতে পারি না।
-ডোন্ট গেট মি রং, আমি মানুষ ধুয়ে খেয়েছি, এগুলা সব খবিশ লোক।
-কীভাবে বুঝলে?
-একটু আগে লাল শার্ট পরা একজন কথা বললো না তোমার সঙ্গে?
-হ্যাঁ, বাতেন ভাই।
-অতো ভাই ভাই করো না। চেহারা দেখলেই বুঝা যায় লম্পট লুম্পেন লোক একটা। আমি তো তোমাকে হিমালয় পাহাড়ে উঠতে বলছি না। জাস্ট লিপস্টিক মুছে আসো, খামোখা মানুষ অ্যাট্রাক্ট করার দরকার নেই।
মোহনের সঙ্গে তর্ক করতে গেলে সিন ক্রিয়েট হবে। আমি টয়লেটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটা টিস্যু পেপার দিয়ে লিপস্টিক মুছে ফেললাম। পাশে একজন মহিলা চোখে কাজল দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন,
-আমি কাজল লাগাচ্ছি আর আপনাকে দেখি লিপস্টিক মুছে ফেলছেন।
-বুঝলাম না, হঠাৎ এলার্জিক রিয়েকশন হয়েছে।
-অনেক সময় হয়, সব তো কেমিকেল দিয়ে বানানো। আমারটা ইউজ করে দেখবেন?
-না, না ঠোঁট চুলকোচ্ছে এখন।
-আপনাকে দূর দেখে দেখলাম। সঙ্গের ভদ্রলোক কি আপনার হাজবেন্ড, ওই যে নীল পাঞ্জাবী পরা?
-জি।
-ওনাকে চেনা চেনা লাগছিল, উনি কি মোহন ভাই?
-জি, আপনি কীভাবে চেনেন?
-তাই তো বলি, গোঁফ কেটে ফেলায় কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক বান্ধবী ছিল রাবেয়া, তার ফেন্ড নায়লা। নায়লার সঙ্গে অনেকেবার দেখেছি ডিইউ-এ।
-আপনি ঢাকায় ছিলেন?
-হ্যাঁ, দু বছর হলো এসেছি। হাজবেন্ড প্ল্যাব দিলো। এখন উইকফোর্ডে জিপি।
-আপনার হাজবেন্ড ডাক্তার?
-হ্যাঁ। আমি সুমাইয়া। আমি কিন্তু ডিইউতে সোশিওলজি পড়েছি।
-আমি জাহাঙ্গীরনগরে ছিলাম, ডিইউতে ফ্রেন্ডরা ছিল কিন্তু অত যাওয়া হয়নি। আচ্ছা আপনি যে নায়লার কথা বললেন। নায়লা এখন কোথায়?
-নায়লা তো আমার মতই বিয়ে করে ইউকে চলে এলো।
কথাটা আমার ভালো লাগলো না, কেমন অশনি সংকেতের মত শোনালো। বললাম,
-আপনি যে বললেন মোহনের সঙ্গে কিছু ছিল? আপনি কীভাবে জানলেন?
-ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই জানতো। এগুলো কি ঢেকে রাখা যায়?
-ওরা বিয়ে করলো না কেন?
-ভার্সিটি লাইফে কত কিছুই হয়। সবাই একটা এক্সপেরিয়েন্স চায়। কিন্তু বিয়ে করার সময় অনেক মেয়ে বুঝে বিয়ে করে, ঠিক কিনা?
-আমি শিওর না। আমি অত হিসেব করে কিছু করিনি কখনো।
-আমি শুনেছি নায়লার হাজবেন্ড সাউথাম্পটন নাকি নটিংহ্যাম কোথায় জেনারেল প্র্যাকটিস করছেন। আমার হাজবেন্ডেরর মতই।
-ওহ আচ্ছা।
আমার ম্লান মুখ দেখে সুমাইয়া বললেন,
-আসলে আমার এই প্রসঙ্গ ওঠানো উচিত হয়নি। আপনাকে খামোখা চিন্তার ভেতরে ফেললাম। মোহন ভাইকে দেখে চেনা লাগলো তো, তাই এত কথা বললাম।
-আপনি তো ওকে আগে থেকেই চেনেন। চলুন আবার পরিচয় করিয়ে দিই, ও হয়তো আপনাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে।
-আরে না,আমি মোহন ভাই বলছি ঠিকই কিন্তুই আমি ওনাকে সরাসরি চিনি না। এত মেয়ের মাঝে উনি আমাকে আলাদা করে মনে রেখেছেন বলে মনে হয় না।
সত্যই মোহন সুমাইয়াকে চিনতে পারলো না। একটা ছোট মেয়ে গাইছিলো, প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গিন পাখা। শুনে মনে হচ্ছিল আমিও নির্ভার রঙিন পাখা মেলে চঞ্চল হাওয়ায় উড়ে বেড়াই। কোন নজরদারি থাকবে না, শুধুই আমি।
সেদিন রাতে বিবাহিত জীবনের যুগল শয্যার বেদীতে নিজেকে বিসর্জন দিতে দিতে ভাবছিলাম, মোহনকে কি জানে বসন্তের মৃদু বাতাসকে চার দেয়ালে আটক ফেললে তা কেমন গুমোট আর স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়?
(চলবে)
পর্ব ৩০ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1377788132736210/
পর্ব ৩৩
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1383633465485010/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here