প্রজাপতি উৎসব পর্ব-৩১

0
347

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩১
আমার একটা জেদ ছিল যে আমি সংসারটা টিকিয়ে রাখবো। জানি না এ রকম জেদ ভালো কিনা কিন্তু এটাই আমি।
আমি বিশ্বাস করি মানুষ অমৃতের সন্তান। তাই মনের ভেতর যত অন্ধকার থাকুক না কেন মোহন একদিন ঠিকই ভালো হয়ে যাবে। ফেরেশটার মত অতিরিক্ত ভালো না। যে কোন স্বাভাবিক হাজবেন্ডের মত গড়পড়তা ভালো। ওইটুকুই আমার চাওয়া।
আমার ধারণা ভুল হয়নি। মোহন আগের থেকে অনেক বদলে গেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য মোহন আর কখনো আমার গায়ে হাত তুলেনি। উল্টাপাল্টা জোরজবরদস্তি করেনি। পুরনো প্রেমের কথাও মোহন শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে। নানা কারণে একটা মানুষের বিয়ের আগে এক বা একাধিক প্রেম হতেই পারে। কিন্তু মোহন বলেছিল প্রেমিকা তো দূরের কথা, ওর কোন মেয়ে বন্ধুও নেই। মোহন দাবী করে আমাকে ইম্প্রেস করবার জন্য সে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না ভাব ধরেছিল। মোহন কথা দিয়েছে সে মিথ্যে কথা বলা কমিয়ে ফেলবে।
মোহন সুদর্শন যুবক, টল অ্যান্ড হ্যান্ডসাম। মোহন হাসলে ওর গালে অদ্ভুত সুন্দর একটা টোল পড়ে। দেখলেই মনটা কেঁপে ওঠে। অথচ এমন মোহনীয় ছেলের মনের ভেতর লুকিয়ে ছিল একটা আদিম পিশাচ। সেই পিশাচটা আমাদের জীবন জারাজারা করে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি, আমি তো ওর কাছে নাও ফিরতে পারতাম? তাহলে কেন ফিরলাম? মোহনকে নিয়ে এত ধৈর্য ধরবার কী দরকার ছিল আমার?
নিজেকে বিশ্লেষণ করে বুঝলাম আমি অতন্দ্রিলার মত দুঃসাহসী বেপরোয়া মেয়ে না। আমি অতি সাধারণ মেয়ে, অতি ঘরোয়া। আমার স্বপ্নগুলো অতি ছোট ছোট। আমার আরও দুর্বলতা আছে। আমি ঝুঁকি নিতে ভয় পাই। আমি একবার হ্যাঁ বলে তারপর আর না বলতে পারি না। আশেপাশের লোকজন কী বলবে সেটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই আমি চেয়েছি আমার সংসারটা টিকে থাক, মোহন ভালো হয়ে যাক, কেউ আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করুক।।
মাঝে মাঝে মনে হয় যে মানুষটি সত্যি আমাকে ভালোবাসতো, তার আবেগের কোন মূল্যই আমি দিতে পারিনি। সহসা সেই প্রেম এসেছিল মহাসমারোহে। কিন্তু সময়টা ছিল প্রতিকূল। এ জন্যই বলে টাইমিং ইজ এভরিথিং। যাক, যা গেছে তা যাক। আমি আমার সংসারটা আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাই। এ কারণে টিটু ভাইয়ের শেষ চিঠির কোন জবাব দিইনি। প্রতিটা উত্তর মানেই টিটু ভাইকে কোন নতুন আশায় ঝুলিয়ে রাখা। সেটা ঠিক না। টিটু ভাই লিখেছিল,
প্রিয় রূপা,
জানি এই ইমেইলটা করা উচিত হয়নি। কিন্তু করে ফেললাম। অনেকেটা ইউক্রেনে রাশিয়ার সীমা এবং সীমান্ত লঙ্ঘনের মত।আশ্চর্য ব্যাপার হলো অর্ধেক রাশানরা বিশ্বাস করতে চায় না যে রাশিয়া সত্যি সত্যি ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। বাকি অর্ধেক অবাক এবং আহত হয়ে ভাবে এটা কী হলো।
ঠিক তেমনি আমার অর্ধেক মন এখনো বিশ্বাস করে না যে তুমি কারো বিবাহিত স্ত্রী। বাকি অর্ধেক মন অবাক এবং আহত হয়ে ভাবে এটা কী হলো। দুই অর্ধেক মনই নানা টালবাহানায় আমাকে চিঠি লিখতে বসায়। আমি যে আজও মনের অধীন।
রূপা, এখন গভীর রাত। চারদিকে নিবিড় নিস্তব্ধতা। শুধু আমার মনের জলাজংলায় শিশিরের মত টুপ টুপ করে ঝরছে তোমার স্মৃতি। আমার তৃষার্ত মন চাতক পাখীর মত সেই শিশিরের জলে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।
মনে আছে অনেক আগে লুদমিলা নামের একটা মেয়ের কথা বলেছিলাম? টিপিকাল রাশান মেয়েদের মত সেও ভীষণ লাবণ্যময়ী। লুদমিলা অনেকদিন ধরে আমার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। গতকাল রাখঢাক না করে বলেই ফেললো,
-টিটু আমি তোমার মনটা চাই।
আমি বললাম,
-আমার মন তো আমি বাংলাদেশে রেখে এসেছি।
লুদমিলা অবাক হয়ে বললো,
-বাংলাদেশে কার কাছে রেখে এসেছো?
আমি বললাম,
-রূপার কাছে।
লুদমিলা নিশ্চিত হবার জন্য জিগেস করলো,
-সে কি তোমার মনের যত্ন নিচ্ছে নাকি অনাদরে, অবহেলায় ফেলে রেখেছে?
প্রশ্নটা আমারও। রূপা, তুমি কি আমার মনটা অনাদরে অবহেলায় ফেলে দিয়েছো? নাকি পুরনো কাপড়ের মত তিন চার ভাঁজ করে কয়েকটা ন্যাপথলিনসহ মনের সিন্দুকে উঠিয়ে রেখেছো?
ইতি
রুপামুখী টিটু।
টিটুর সেই চিঠির আমি কোন উত্তর দিইনি। কান্না এসেছে কিন্তু ভালোই করেছি উত্তর না দিয়ে। ভুল হোক, ঠিক হোক, মন এক যায়গায় পুরোপুরি দেয়াই ভালো। যদি কোন দিন মন উঠিয়ে নিতে হয়, পুরোটাই উঠিয়ে নেবো।
কদিন আগে ঢাকার সব অম্লমধুর স্মৃতি ভুলে আমরা লন্ডন চলে এসেছি। লন্ডনে মোহন আর ইলোরাকে নিয়ে আমার নতুন জীবন শুরু হলো। ইলোরা এখনও আমার পেটে। সব ঠিক থাকলে আর তিন মাস পর রয়্যাল লন্ডন হাসপাতালে ইলোরা পৃথিবীর আলো দেখবে। আমি যখন দ্বিতীয়বারের মত কন্সিভ করলাম, মোহন আগের মত বিরক্তি দেখালো না। অতি উচ্ছাস প্রকাশ না করলেও, গতবারের দুর্ব্যবহারের ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্য মোহন নিয়ম করে ফলমূল এটাসেটা এনে যত্নআত্নি করেছে।
তবে গত ক মাসে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি যেটা আগে নজরে পড়েনি। আমি অন্য কোন পুরুষের দিকে তাকালে, কিম্বা অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে হেসে কথা বললে মোহন কেমন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। ব্যাপারটা অন্যরা বুঝতে পারে না কিন্তু আমি মোহনের চোখমুখের সূক্ষ্ম পরিবর্তন দেখে দেখে আঁচ করতে পারি। বিয়ে বাড়িতে, জন্মদিন কিংবা অন্য কোন অনুষ্ঠানে গেলে সামাজিকতার খাতিরে অনেকের সঙ্গে আলাপ করতেই হয়। সেটাই স্বাভাবিক। এই তো সেদিন মোহনের এক ক্লাসমেটের বিয়েতে গেলাম। মোহন ওর বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ওদের ভেতর বিমানের পাইলট খালেদ ভাই আমার সঙ্গে একটু বেশী আগ্রহ নিয়েই গল্প করছিলেন। আমিও ভদ্রতা করে ওনার কথা শুনছিলাম। এছাড়া উপায় কী? মোহন স্মিত হাসি দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল।একটু পর মোহনের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ও ঈর্ষা বোধ করছে। বাসায় ফিরেও মোহন কেমন থম মেরে রইলো। অনেক জোরাজুরির পর বললো,
-শাড়ি পড়লে তোমাকে অন্যদের থেকে বেশী সুন্দর লাগে।
আমি খুশী হয়ে বললাম,
-সেটা তো ভালো যে তোমার স্ত্রী সুন্দরী।
-খালেদ সারাক্ষণ তোমার দিকে হা করে তাকিয়েছিল। ভালো হতো তুমি ওকে ইগ্নোর করলে। না হলে পরে পেয়ে বসবে, ভাববে প্রশ্রয় দিচ্ছো।
-সেটা তো আগে বলোনি?
-হুম, আগে তো বুঝিনি খালেদ তোমাকে দেখে ক্রেইজি হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে নেক্সট টাইম ব্যাপারটা খেয়াল রাখবো।
স্বামী তো আর সন্যাসী না, স্বামী হলো সংসারী। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না স্বামী হিসেবে মোহনের এই অতিরিক্ত অধিকারবোধ ভালো নাকি মন্দ? নিজের স্ত্রীকে অবহেলা করার চেয়ে তাকে নিয়ে অতিসচেতন থাকাটাই কী ভালোবাসার লক্ষণ?
আমরা লন্ডন যাবার আগের দিন দিলশাদ, অতন্দ্রিলা আর মিলি এসেছিল দেখা করতে। ওদের সবার মন ভীষণ খারাপ। এই যে দেশ ছেড়ে যাবো, আবার কবে সবাই একসাথে হবো কে জানে। এভাবেই বন্ধুরা আস্তে আস্তে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, সময় আর দূরত্বের কারণে সম্পর্কের সুরটা হয়তো কেটে যায়। তাই ওদের সঙ্গের সময়টা আমি ভীষণ উপভোগ করছিলাম। দিলশাদ বললো ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে, হবু বর বারডেমের ডাক্তার। দিলশাদ শুরু থেকেই বিয়ের ঝামেলা ওর বাবামায়ের কাঁধে ছেড়ে দিয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সে বেশ উত্তেজিত। মিলি মিলির মত ভালো আছে, ওর হাজবেন্ড ওকে পাগলের মত ভালোবাসে। ফিরে যাবার সময় দিলশাদ আর মিলি আগেই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গিয়েছিল। অতন্দ্রিলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে বলেলো,
-সত্যিই চলে যাচ্ছিস রূপা?
-হুম, কিন্তু এখন তো চাইলেই মেসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপে কল দেয়া যায়।
-মায়া করে জড়িয়ে ধরা তো যায় না।
-তা যায় না।
-এখন তুই কোন বিপদে পড়লে আমি চাইলেও ছুটে আসতে পারবো না। ব্যাপারটা খুব প্যাথেটিক।
-হ্যাঁ, সেটা সত্যি।
-আচ্ছা রূপা, একটা কথা কখনো ভেবেছিস?
-কী কথা?
-একটা মেয়েও আরেকটা মেয়েকে গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে, এটা কখনো মনে হয়েছে তোর?
-হ্যাঁ, কেন না? সবাই সবাইকে ভালবাসতে পারে।
-আমি সেটা মিন করিনি রূপা,আমি মিন করেছি… আচ্ছা বাদ দে, ভালো থাক তুই।
অতন্দ্রিলার মত শক্ত মেয়ে যে যাবার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু এখনো অনেক গোছগাছ বাকি। অত ভাবারও সময় নেই আমার হাতে।
মোহনের অ্যাকাউন্টিং কোর্সের ক্লাস সেপ্টেম্বরে আরম্ভ হবে। কোভিডের প্রকোপ এখন আর আগের মত নেই। আমরা লন্ডনে চলে এলাম জুলাই মাসে। কদিন বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টে থেকে আমরা ইজলিংটনে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করলাম। প্রতিদিন টিউবে করে আমরা চলে যাই ঝকঝকে আয়নার মত ওয়েস্ট লন্ডনে। সেদিন লন্ডন আই-এ চড়লাম। আমি প্রেগন্যান্ট বলে কিনা জানি না, লন্ডন আইকে দেখে মনে হচ্ছিল গর্ভবতীর সামান্য সামনে হেলে থাকা পেট। উটপাখীর ডিমের মত কাঁচের ক্যাপ্সুল্টা যখন উপর দিকে উঠছিল, পুরো লন্ডন শহরটা ধীরে ধীরে চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছিল। আমি শক্ত করে মোহনের হাত ধরেছিলাম কারণ এত সুন্দর দৃশ্য কারও উষ্ণ হাতের স্পর্শ ছাড়া উপভোগ করতে ভালো লাগে না।
(চলবে)

পর্ব ৩০ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1377788132736210/
পর্ব ৩২ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1381858242329199/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here