প্রজাপতি উৎসব পর্ব-৩০

0
324

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩০
তিন মাস পর প্রীতিলতা হলে এলাম। সব আগের মতই আছে। সেই ঘন সবুজ গাছপালা আর তার মাঝে থোকা থোকা লাল ইটের বাড়ি। রঞ্জন গ্যাং ধরা পড়বার পর ইউনিভার্সিটির পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক নিরাপদ। কিন্তু ক্যাম্পাসে এতদিন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবার কারণে ভিসির পদত্যাগের দাবী মিছিল হচ্ছে।
অ্যাম্ফিথিয়েটারের কাছে দেখা হতেই অতন্দ্রিলা আমাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
-হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ, তুই কোথা থেকে এলি রূপা?
অতন্দ্রিলা আগের মতই আছে। কালো কামিজ, কালো জিন্স পড়েছে, মুখে কালো লিপস্টিক চড়িয়েছে। আসলে তিন মাসে মানুষ কতই বা বদলাবে? কেবল আমার ভেতরটা অনেক বদলে গেছে। আমার কাছে গত তিন মাস ছিল তিন বছরের মত। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কেন অতন্দ্রিলার মত শক্ত আর ধারালো হলাম না। তবে এটা সত্য যে অতন্দ্রিলা অনেক আগেই কঠিন এবং নির্মম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পেটানো লোহা হয়ে গেছে। ক্যাফেটেরিয়ায় চা খেতে খেতে আমি অতন্দ্রিলাকে সব কথা খুলে বললাম। দেখলাম অতন্দ্রিলার মুখ রাগে থমথমে হয়ে গেছে। আশেপাশে লোকজন আছে বলে ও চাপা গলায় বললো,
-তোর হাজবেন্ড একটা মেল শোভেনিস্ট পিগ। রঞ্জনের চেয়ে খারাপ না হলেও সে রঞ্জনের কাছাকাছি। তবে আঙ্কেল ঠিকই বলেছেন, বেশীরভাগ ছেলেরাই বদমাশ। এ রকম মোহন ঘরে ঘরে। কেউ মামা চাচা সেজে দিনের পর দিন গায়ে হাত দিচ্ছে, কেউ ম্যারিটাল রেপ করছে, কেউ জুয়ায় আসরে বউকে বাজি ধরছে, কেউ দিনের পর দিন বউ পেটাচ্ছে। আমি এমন এক হারামজাদাকে চিনি যে জোর করে ওয়াইফ সোয়াপ করে। ফেসবুকে এসে যত বড় বড় বাণী দেক না কেন, দেখা যায় নিজের জীবনে মেয়েরা অনেক কিছুই নীরবে মেনে নিচ্ছে। মেয়েদের আসলে বিয়ে না করাই ভালো।
– ও হাত পা ধরে মাফ চেয়েছে। আমি জানি বেশী নাটকীয়তা করেছে। বিয়েতে তো চাইলেই ভেঙ্গে দেয়া যায়, কিন্তু বল এখন আমার কোর্টে। বড় জোর ও ল-ইয়ার দিয়ে ব্যাপারটাকে বেশীদিন ঝুলিয়ে রাখবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। শুধু বুঝতে পারছি না ওকে আরেকটা সুযোগ দেবো কিনা।
-টেকনিকালি, নব্বুই ভাগ ছেলেই বদ। যেগুলো ভালো সেগুলো আবার সময়, সুযোগ কিংবা সাহসের অভাবে ভালো। মাঝে মাঝে অভিযোগ শুনি ছেলে ভালো শ্বশুরবাড়ি খারাপ আর তোর কেইস উল্টো, ছেলে খারাপ কিন্তু বাকি ফ্যামিলি তোর সঙ্গে ভালো বিহেভ করছে।
-হুম, কিন্তু বুঝতে পারছি না আরেকবার দেখবো কিনা। আমার গাট ফিলিং বলছে, এখুনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।
-মনে হয় না মোহন তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে। বরং তুই একটা কাজ করতে পারিস।
-কী, কাজ?
-প্রিপেয়ার্ড হয়ে ওর কাছে যা। ও যদি কোনভাবে অ্যাবিউজ করে, তুই ওটার এভিডেন্স রাখবি। পরে ভাইরাল করে দিবি। আর ও যদি সত্যি ভালো হয়ে যায় তাহলেও তুই তোর মত করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবি।
-তুই তাহলে একমত যে সেকেন্ড ট্রাই করবো?
-সেকেন্ড ট্রাইয়ে তোর হারানোর কিছু নেই। বরং মোহন আগের মত থাকলে ও তোকে হারাবে। তাছাড়া ও নিশ্চয় বুঝতে পারছে ওর খারাপ ব্যবহারের কথা সবাই জেনে গেছে।
-আমিও তাই মনে করি। আমি শেষবারের মত দেখবো।
-হুম, একটু নয় ছয় করলে সোজা লাত্থি দিয়ে চলে আসবি। আর আমি তো আছি, কিছু না করতে পারলে আমাকে জানাবি।
সেদিন আর বেশীক্ষন থাকলাম না। নার্সিং হোম থেকে জানিয়েছে মার শরীর আগের মত খারাপ নেই, ঘরে বসেই দেখশোনা করা যাবে। মাকে আনবার কিছু ফর্মালিটিজ আছে। মোহনের যা খরচ হয়েছিল বাবা ফেরত দিয়ে দেবে, যদিও মোহন আব্বুর বন্ধুর ছেলে হিসেবে আগ বাড়িয়ে অনেকটা জোর করেই সাহায্য করেছিল। আমার ভাই বোম্বেতে একটা চাকুরী পেয়েছে, ভালো বেতন। আব্বুর শেয়ার টাকাও ফেরত এসেছে। ফলে বাড়িতে আবার নার্স রাখা বিশেষ সমস্যা হবে না। কাল মিতি সুইডেন থেকে ফোন করেছিল। মিতিকেও সব কথা খুলে বলেছি। সব শুনে মিতি রেগে বললো,
-তুই কি স্পাইনলেস? এই ছেলেকে এখনো ডিভোর্স দিচ্ছিস না কেন?
-কারণ আমি গড়পড়তা বাঙ্গালীর মত অসহিষ্ণু না। সে মাফ চেয়েছে, আমি দেখতে চাই সে আসলেই পাল্টায় কিনা। যদি না পাল্টায় আমি চলে আসবো।
-ওই নরককুন্ডে আবার যাবি?
-মোহন যেমনই হোক পুরো বাড়িকে নরককুন্ড না বলাই ভালো। এটাও টিপিকাল বাঙ্গালী মত কথা হলো, একজন খারাপ তো সবাই খারাপ। শ্বশুর শাশুড়ি আর মিনুর সাথে আমার সম্পর্ক ভালোই আছে। মিনুও তো বলেছে, তুমি না চাইলে আসবে না।
-ঠিক আছে, তুই যদি মনে করিস সিচুয়েশন খারাপ হলে ট্যাকল করতে পারবি তাহলে গিয়ে দেখে আয়। অন্তত সবাইকে বলতে পারবি ইউ ট্রাইড ইওর বেস্ট। কারণ আমাদের সোসাইটি বিয়ে ভাঙলে মেয়েদেরকেই ব্লেইম করে।
পরদিন সত্যিই আমি মোহনের বাড়িতে ফিরে এলাম। আমাকে দেখে সবচেয়ে খুশী হলেন আমার শ্বশুর সাহেব। বললেন,
-তোমাকে অনেক মিস করেছি মা। কিন্তু মোহন যা করেছে তারপর কোন মুখে তোমাকে আসতে বলি?
আমার শাশুড়ি চুপচাপ মানুষ , উনি কিছু বললেন না, গরম গরম লুচি ভেজে আমার জন্য আনলেন। ওনার স্নেহের প্রকাশ এ রকমই, কথায় না, কাজ দিয়ে। কিন্তু আমাকে দেখে সবচেয় খুশী হয়েছে মিনু। আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমুটুমু দিয়ে মিনু বললো,
-ভাইয়াকে আরেকটা চান্স দেয়ার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ ভাবী। তোমাদের মাঝে যাই হয়ে থাকুক, আমি শিওর ভাইয়া আর ওরকম করবে না। আব্বার কাছ অনেক ঝাড়ি খেয়েছে।
বিকেলে মোহন অফিস থেকে ফিরে আমাকে দেখে মনে হলো সত্যিই খুশী হয়েছে। অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছে যে আমাকে জোর করে বেঁধে রাখতে পারবে না। মোহন খুব সাবধানে মেপে মেপে কথা বলছে। রাতে একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য কাণ্ড হলো। মোহন বললো,
-ছাদে যাবে? আজ মুনলিট নাইট।
আমরা ছাদে গিয়ে দেখলাম সত্যিই শুভ্র আলোয় চারদিক থই থই করছে। মোহন আমার হাত ধরে বললো,
-তুমি চলে এসেছো, আমি খুব গ্রেইটফুল রূপা। তুমি চলে যাবার পর আমি অনেক ভাবলাম, ভেবে ভেবে বুঝলাম আমি তোমার সঙ্গে পিশাচের মত আচরণ করেছি। আমি সত্যিই লজ্জিত।
আমি বললাম,
-তুমি আমাকে অনেক বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছো মোহন। আমি এসেছি কিন্তু সব ভুলতে অনেক সময় লাগবে। হয়তো কোনদিনই ভুলবো না। তুমি যদি একবারও আগের মত ব্যবহার করো, তাহলে আমাকে আর কখনো ফিরে পাবে না।
-বলেছি তো রূপা আমি নিজেকে বদলে ফেলবো।
এর পরের কদিন মোহনের ভেতর অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আগে অফিস থেকে রাত করে ঘরে ফিরতো। জানি না কাদের সঙ্গে আড্ডা দিতো কিন্তু এখন সে সময় করে বাড়ি ফিরছে। রাতে বিছানায় সে আর আগের মত জোর করছে না, আমি যেভাবে চেয়েছি সেভাবেই অ্যাপ্রোচ করছে। আমিই বরং বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছি, ওর উষ্ণতায় গলতে আরও সময় লাগবে। আগে কোন কারণে খারাপ ব্যবহার করলে সেটা ভোলানোর জন্য মোহন দামী গিফট কিনে আনতো। এখন ছুটির দিনে এমনিতেই আমরা বেড়াতে বের হই, ও এটা ওটা কিনে দিতে আবদার করে। আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যক্তিগত ব্যবহার্য পছন্দ করি না, তাই ওকে অনেক বলে কয়ে থামাই, আমার পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য মোহন বেডরুমের এক কোণায় একটা পড়ার টেবিল বসিয়েছে। নতুন কোর আই নাইন ল্যাপটপ কিনেছে। বললাম পুরনো ল্যাপটপেই হবে, মোহন শুনলো না।
কিন্তু মোহন যে হঠাৎ এমন ওয়ান এইটি ডিগ্রী ভালো হয়ে গেছে, সেটাও আমার কাছে চিন্তার কারণ। এটা ঝড়ের আগের শান্ত আবহাওয়া নয় তো?
(চলবে)

পর্ব ২৯
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1376901626158194/
পর্ব ৩১ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1380266615821695/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here