প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৩
আজ বিকেলে উপসালা থেকে মিতি ফোন করেছিল ।
নানা ব্যস্ততায় এতদিন মিতির কোন খবর নিতে পারিনি। মিতির নিজেরও খুব ন্যালাক্ষেপা সময় গেছে। একদিকে পড়ালেখা, অন্যদিকে রিটেইল শপের কাজ, তার উপর প্রেগন্যান্সি।
আজ শুনলাম মিতির একটা কন্যা সন্তান হয়েছে। নাম রেখেছে অরোরা। কিন্তু সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ মিতি পেটের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল,
-রূপা, আমি বিয়ে করেছি।
আমি অবিশ্বাস মাখা কন্ঠে বললাম,
-বিয়ে করেছিস মানে? ঠাট্টা করছিস?
-ঠাট্টা না, সত্যি। সারা জীবন কি একা থাকবো? বিয়ে যদি করতে হয় আগে করাই ভালো। তাছাড়া অরোরার তো একটা ফাদার ফিগার লাগবে।
– হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ, কাকে বিয়ে করলি?
-ছেলেটার নাম এড্রিয়ান। সুইডিশ। আমি যে রিটেইল শপে কাজ করি ও সেটার ম্যানেজার।
-সুইডিশ ছেলে বিয়ে করলি?
-হুম, বাঙ্গালী ছেলেদের উপর ভক্তি উঠে গেছে।
– কীভাবে কী হলো, একদম শুরু থেকে খুলে বল।
-কোত্থেকে যে শুরু করি। অনেক কাহিনী। সামনাসামনি মন খুলে বলতে পারলে শান্তি হতো।
-তাহলে কিছুদিনের ছুটি নে। তারপর সবাইকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে আয় বেরাতে। রায়হানের সঙ্গেও দেখা করে গেলি।
মিতি সামান্য রেগে বললো,
-রায়হান খবিশটার কথা আমাকে বলবি না। আমি কেন ওর সঙ্গে দেখা করবো? জানিস খবিশটা পাপের শাস্তি পেয়েছে?
-কী শাস্তি?
-বেন নেভিস পাহাড়ে উঠতে গিয়েছিল।
-কে, রায়হান?
-হুম, সামান্য একটু উঠতেই পিছলে পড়ে ডান পা ভেঙ্গে তিনভাগ হয়ে গেছে।
-তুই রায়হানের খবর কীভাবে জানলি?’
-আমি খোঁজ রাখি। ফেসবুকে ফলো করি। ওকে শাস্তি দিতে হবে না?
-তুই তো বিয়ে করে ফেলেছিস, বাচ্চা আছে। এখন রায়হানের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভালো।
-রায়হান অরোরার পিতৃত্ব স্বীকার করলে আমি ওকে মাথা থেকে ঝাড়বো। তার আগে না।
-আচ্ছা তাহলে এড্রিয়ানের কথা বল।
-তুই তো শুনেছিস স্যাটার ডে, সান ডে আমি রিটেইল শপে কাজ করি। আমি প্রেগন্যান্ট দেখে এড্রিয়ান খুব কেয়ারফুল ছিল আমার ব্যাপারে। কেয়ারিং ও বলতে পারিস। একদিম লাঞ্চের সময় বললো, তোমার পার্টনারকে তো কখনো দেখলাম না মিতি। আমি বললাম, আমার পার্টনার নেই, ব্রেক আপ হয়ে গেছে বাংলাদেশে থাকতে। কী আশ্চর্য এড্রিয়ানের দেখি উল্টো খুশীতে চোখ চকচক করে উঠলো। এভাবে গেলো কিছু দিন। একদিন রাতে এড্রিয়ান আমাকে একটা রেস্টুরেন্টে ইনভাইট করলো। আপুকে বললাম, যাবো নাকি? আপু বললো, যা, ঘুরে আয়, একটু ঘোরাঘুরি না করলে দম বন্ধ হয়ে যাবে।। সেদিন সন্ধ্যায় এড্রিয়ানে্র সঙ্গে অনেক আলাপ হলো। জিগেস করলাম ওর কোন মেয়ে বন্ধু আছে কিনা। এড্রিয়ান বললো ওর গার্লফ্রেন্ড ছিল কিন্তু এক বছর হল ব্রেক আপ হয়ে গেছে। এতদিন নাকি কাউকেই ওর ভালো লাগেনি কিন্তু আমাকে দেখে নাকি তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
-তারপর? তুই রাজি হয়ে গেলি?
-সে তো কোন প্রপোজ করেনি, জাস্ট বলেছে ভালো লাগে। আরও অনেকদিন ধরে দেখলাম এড্রিয়ানকে। ওদের বাড়ি গেলাম। ওর বাবা মা চুপচাপ কিন্তু খুব ভালো মানুষ। তারপর একদিন এড্রিয়ান বিয়ের প্রস্তাব করলো। আমার কান্না চলে এলো। সব জেনেবুঝে একটা প্রেগন্যান্ট মেয়েকে এড্রিয়ান বিয়ে করতে চেয়েছে। কত ভালো একটা মানুষ। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। বিয়ের কিছুদিন পরই অরোরা হলো। এড্রিয়ান অরোরাকে অনেক আদর করে।
মিতি ফোন রাখবার পর ভাবলাম, মানুষের জীবন কী অদ্ভুত। এই সেদিন মিতি জাহাঙ্গীরনগরের আনন্দ দীঘিতে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছিল। আজ সেই মিতি উপসালায় সুইডিশ হাজবেন্ড আর নিজের মেয়ে অরোরাকে নিয়ে সংসার বেঁধেছে।
মনে মনে ভাবলাম, ইস, মোহন যদি মিতির হাজবেন্ডের মত ভালো মানুষ হতো? সেদিন প্রোগ্রাম থেকে ফেরার সময় মোহন ট্যাক্সিতে গজগজ করছিল আমার সাজসজ্জা নিয়ে। আমি বললাম,
-মোহন, মেয়েরা কিন্তু ছেলেদেরকে দেখানোর জন্য সাজে না।
-তাই? তাহলে কেন সাজে?
-নিজের জন্য সাজে। এটা মেয়েদের একটা স্বভাব বলতে পারো।
-নিজের জন্য সাজে আর মৌমাছি এসে ভিড় জমায়।
মনে হচ্ছিল নায়লার কথে জিগেস করে মোহনকে বোবা বানিয়ে দিই। সুমাইয়ার মুখে নায়লার কথা শুনে প্রথমে কষ্ট পেলেও পরে নিজেকে সামলে নিয়েছি। এমন হতেই পারে নায়লাকে মোহনের পছন্দ ছিল আমার যেমন ভালো লেগেছিল রঞ্জনকে। কিন্তু পরে কোন কারণে ওদের সম্পর্ক এগোয়নি। নায়লা ইংল্যান্ডে এসেছে, মোহনও ইংল্যান্ডে এসেছে। এটা কাকতালীয় হতেই পারে কারণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার জন্য নর্থ আমেরিকা, ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়াতেই আসে। এখন যদি রঞ্জন জেলে না থাকতো আর ইংল্যান্ডে চলে আসতো আমার কী করার ছিল?
আবার খারাপভাবে ভাবে ভাবলে কত কিছুই ভাবা যায়। নায়লার বাবা হয়তো নায়লাকে ইংল্যান্ডের প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ছেলের সাথে নায়লার পছন্দ অপছন্দ উপেক্ষা করেই বিয়ে দিয়েছে। মোহন আমাকে বিয়ে করে সেই কষ্ট ভুলে থাকতে চেয়েছে। পরে হয়তো ওদের আবার যোগাযোগ হয়েছে। সম্পর্কের ছাই চাপা আগুন তখন ভসভস করে জ্বলে উঠেছে। মোহন মাস্টার্স পড়ার নাম করে নায়লার সঙ্গে মেশার জন্যই ইংল্যান্ডে চলে এসেছে। হয়তো সে নায়লার সঙ্গে গোপন অভিসার চালিয়ে যাবে। ইস, অতিরিক্ত ভাবতে ভাবতে আমি হয়তো তিলকে তাল বানিয়ে ফেলছি। একবার কাউকে নিয়ে মনে সন্দেহ জাগলে তাকে খারাপ ভাবার তো কোন শেষ নেই। সন্দেহ বড়ই ভয়ঙ্কর অভ্যাস। কিন্তু সন্দেহ ছাড়া উপায় কী?
আমি ফেসবুকে ঢুকে নায়লার প্রোফাইল খুঁজলাম। সুমাইয়া বলেছিল নায়লা ডিইউ-এ সাইকোলজি পড়তো। একটু সময় নিলেও নায়লাকে খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি।মেয়েটা মনে হয় প্রতিদিন ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে। নানা ভঙ্গিমায় নায়লাকে দেখে আমি সামান্য হলেও ইন্সিকিউরড ফিল করলাম। টিটু ভাই বলেছিল আমি ভোরের শিশির ভেজা শিউলির মত লাবণ্যময়ী। আর নায়লার ছবি দেখে মনে হলো মেয়েটা বাঁকা তরোয়ালের মত চকচকে আর ধারালো। নায়লায় প্রাখর্যে প্রলুব্ধ না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু আমি এখুনি মোহনকে কিছু বলবো না। মোহনের পলিসি হলো অফেন্স ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স। শেষে নিজের সাফাই গাইতে গিয়ে মোহন অফেন্সিভ হয়ে কী অশান্তি ডেকে আনবে কে জানে। বাচ্চা হবার দুমাস আগে আমি ওরকম ঝামেলা চাই না।
কিন্তু সব সময় কি ঝামেলা এড়ানো যায়? সেদিন মোহন শাওয়ার করছিল। ওর মোবাইলটা বিছানায়। হঠাৎ টুং করে শব্দ হলো। কারো টেক্সট মেসেজ এসেছে। ডিসপ্লেতে মেসেজ প্রিভিউ জ্বলজ্বল করছে। লুকিয়ে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। কেউ লিখেছে,
-প্রিয় সম্মোহন, তুমি লন্ডনে, আমি নটিংহামে, এত কাছাকাছি অথচ কতদূর।
(চলবে)
পর্ব ৩২ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1381858242329199/
পর্ব ৩৪ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1384975758684114/