প্রজাপতি উৎসব পর্ব-৩৪

0
362

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩৪
পদ্মপাতা আজ আট মাসে পড়লো। পদ্মপাতা ছোট ছোট হাত পা নেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে যায়। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। আহ, আমার মন ভরে যায়।

পদ্মপাতাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য রয়েল লন্ডন হাসপাতালে আমার সি সেকশন হয়েছিল। বাইরে তখন শুভ্র তুষার ঝরছিল। লম্বা একটা সুঁই আমার মেরুদন্ডে গেঁথে ওরা যখন স্পাইনাল কর্ড অ্যানেস্থেসিয়া দিলো, মোহন আমার পাশেই ছিল। মোহনকে ভীষণ নার্ভাস লাগছিল। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল। স্বাভাবিক জন্ম হোক আর সিজারিয়ান হোক, নয় মাস গর্ভধারণের পর শিশুর জন্ম দিতে একটা মেয়েকে কী পরিমান ঝুঁকির ভেতর দিয়ে যেতে হয় সে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল। নাকি তার নার্ভাস হবার কারণ স্রেফ সুঁইভীতি? কে জানে।

আমাদের সংসারের সমীকরন বদলে গেছে। এখন আমি শুধু মোহনের স্ত্রী নই, আমি তার সন্তানের মা। সে পদ্মপাতার বাবা। দু চাকার সাইকেলের চেয়ে তিন চাকার রিক্সার ভারসাম্য বেশী থাকে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের ত্রিমুখী বন্ধন সংসারের অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা কাটিয়ে দেবে।

ঢাকায় থাকতে মোহন কথা দিয়েছিল আমার উপর ওসব ব্যাপারে জোর জবরদস্তি করবে না। মোহন এখনো তার কথা রেখেছে। তবে আমাকেও অনেক ছাড় দিতে হয়েছে। রাতবিরেতে পদ্মপাতা কেঁদে উঠলে মোহনের ঘুমে ডিস্টার্ব হয়, মোহন অন্য ঘরে গিয়ে বালিশে মাথা ঢেকে ঘুমিয়ে থাকে। পদ্মপাতাকে আমি একাই সামলাই। দিনেরাতে যতবার পদ্মপাতার ডায়াপার বদলানো লাগে, আমিই বদলাই। তারপর তো রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার আছেই। আমি সবই মেনে নিয়েছি এই আশায় যে মোহন একদিন সত্যি সত্যি ভালো হয়ে যাবে।

মোহন সম্প্রতি একটা চাকুরী পেয়েছে। এতগুলো টাকা খরচ করে এদেশে পড়েছে। এই চাকুরীটা ওর আত্মবিশ্বাসের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। তবে অ্যাকাউন্টিং পড়ে এখানে এথনিক সেক্টরে কাজ যোগাড় করা কঠিন না। কেউ বিশ্বাস করবে না ইউকেতে বারো হাজার বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট আর টেইকঅ্যাওয়ে আছে। বছর শেষ সবাইকেই সরকারের কাছে হিসেব বুঝিয়ে দিতে হয়। এ কারনেই এখানে বাংলাদেশী অ্যাকাউন্টেন্সি প্র্যাক্টিস রমরমা।

সুমাইয়ার বান্ধবী লিনার হাজবেন্ডের চেমসফোর্ডে একটা টেইকঅ্যাওয়ে আছে। লিনা বললো বৈধ ব্যবসার পাশাপাশি অনেক অ্যাকাউন্ট্যান্ট নাকি গ্রাহককে চাহিবা মাত্র নকল পে স্লিপ বানিয়ে দেয়। অনেক কর্মচারী ওই কম বেতনের পে স্লিপ দেখিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষ হিসেবে সরকার থেকে বিশেষ ভাতা এবং বাড়ি বরাদ্দ পায়। আবার রেস্টুরেন্ট গুলোও খরচ বেশী দেখিয়ে ট্যাক্সের টাকা বাঁচায়। মাস্টার্সের পর রোমান রোডে ওরকম একটা অ্যাকাউন্টিং ফার্মেই মোহনের চাকুরী হয়েছে। পাঁচ বছর কাজ করলে পারমানেন্ট রেসিডেন্স হয়ে যাবে। মোহনের ইচ্ছে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষা দিয়ে চারটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে যাবে। তখন ভালো মেইনস্ট্রিম জব পাওয়া সহজ।

মোহন এভাবে ধীরে ধীরে জীবনে সাফল্যের পথে এগোবে। কিন্তু আজ বাদে কাল যদি মোহন আমাক ছেড়ে চলে যায় তখন আমার কী হবে? এ দেশের ডিগ্রী না থাকলে ভালো চাকুরী পাওয়া কঠিন। মোহনকে বলেছি পদ্মপাতা একটু বড় হলে আমি একটা মাস্টার্স কোর্সে করবো। মোহন আপাতত রাজি হয়েছে। কিন্তু টিউশন ফির জন্য টাকা জমাতে হবে। আমাদের বাসার কাছে একটা টেসকো আর একটা মরিসনস গ্রসারি স্টোর আছে। পদ্মাপাতা আরেকটু বড় হলে ওখানে কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করবো।

আসলে পড়ালেখা আর কাজের কথা আমাকে শিখী বলেছে। লন্ডনে এসে শিখী মেয়েটাকেই আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে। অতন্দ্রিলার সঙ্গে ওর অনেক মিল আছে শুধু রং ছাড়া। অতন্দ্রিলার সবকিছু কালো। শিখীর সবকিছু ময়ূরপুচ্ছের মত রঙিন। জীবনের সমস্ত রঙ্গ যেন ওর যৌবন থেকে উপচে পড়ছে।

ওয়েস্টমিন্সটার অ্যাবির সামনে শিখী বাস্কিং করছিল, মানে রাস্তায় মাইক্রোফোন দিয়ে মিউজিক বাজাচ্ছিল। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের কাছে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের সুর শুনে আমি থমকে গিয়েছিলাম। তাকিয়ে দেখি শ্যামল-বরণ একটা মেয়ে গভীর মনোযোগে বেহালার ছড়ে সুর তুলছে। ও যখন মিউজিক শেষ করে সবকিছু গুটাচ্ছিল, আমি কাছে গিয়ে বললাম,
-একটা কথা বলতে পারি।
শিখী আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললো,
-বলুন।
-আপনি কী বাংলাদেশের?
-হ্যাঁ। ক্লাস এইট পর্যন্ত ঢাকায় ছিলাম, তারপর চলে আসি। আপনি বাংলাদেশের?
-জি, আমি রূপা। বেশীদিন হয়নি এসেছি।
-আমি শিখী।
-হঠাৎ সেন্ট্রাল লন্ডনে বেহালায় বাংলা মিউজিক শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রচুর লোকও দেখলাম ভিড় করেছে।
-বেহালায় বাজিয়েছি বলেই সবাই শুনেছে। মিউজিক একা আবস্ট্রাক্ট এবং ইউনিভার্সেল। মিউজিকের ওয়েভে যে যার মনের মত শব্দের নৌকা ভাসাতে পারে। কিন্তু মিউজিকে শব্দ যোগ করলেই ওটা কন্টেক্সচুয়াল হয়ে যায়।
-আসলেই তাই। আপনি যখন বেহালায় সুর তুলছিলেন, আমি ভাবছিলাম আপনি কী গাইছেন, ‘আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনে মানুষ যে রে’ নাকি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

কথা বলতে বলতে শিখীর সঙ্গে কী যেন একটা ক্লিক করে গেলো। হতে পারে আমি নিজে খুব গতানুগতিক হওয়ায় খাপছাড়া অদ্ভুত প্রকৃতির মেয়েদের প্রতি বেশী আকৃষ্ট হই। অতন্দ্রিলার মতই শিখীও নিজের মত করে চলে। বাঙালি কমিউনিটির গসিপ কালচারের সঙ্গে তার একবারেই যায় না। তাই না পারতে সে কমিউনিটির সঙ্গে মেশে না। আমরা দুজন কাছের একটা কফি শপে গিয়ে বসলাম। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললাম,
-আপনার শিখী নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। শিখী মানে কী?
-শিখী মানে ময়ূর। কিন্তু…
-কিন্তু কী?
-শিখী শব্দটা মাসকুলিন। ফেমিনিন হলো শিখিনী।
-তাই নাকি? আমার কাছে শিখী শব্দটাই ফেমিনিন লাগছিলো।
-আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সেদিন একজন ভুল ধরিয়ে দিলো। ভেবে দেখুন জন্ম থেকে এই ভুলের বোঝা বয়ে চলছি।
-এখন তো বাংলায় মাস্কুলিন, ফেমিনিন সব শব্দ এক করে দিচ্ছে। সেই হিসেবে শিখী নামটা ঠিক আছে।
-বাহ, এটা ভালো বলেছেন। এতদিন ধরে খালি মনে হতো আব্বু আম্মু আমাকে ছেলেদের নাম দিয়েছে।
-জানেন, এই প্রথম কোন বাঙ্গালী মেয়েকে রাস্তায় বাস্কিং করতে দেখলাম।
-এটা আমার ভকেশন, আমার স্ট্রেস রিলিফ হয়। এখান থেকে যা আয় হয় আমি আরএসপিবিকে দিয়ে দিই।
-আরএসপিবি কী?
-নেচার কনজার্ভেশন চ্যারিটি।
-আপনি তাহলে অন্য কোন চাকুরী করছেন?
-নাহ। ইউসিএল-এ পিএইচডি করছি জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিং-এ। সুবিধা হলো ওটা ফান্ডেড পিএইচডি।

শিখীর কথায় আমি অবাক হলাম। যেই মেয়ে ইউসিএল-এ পিএইচডি করছে, সেই একই মেয়ে রাস্তায় ছন্নছাড়ার মত বাজনা বাজাচ্ছে। মেয়েটা দু বাহু বাড়ায়ে জীবনের দুই প্রান্ত ছুঁয়ে আছে। আমার ভাবনায় বাঁধা দিয়ে শিখী বললো,
-তবে ভাববেন না আমি খুব স্বাধীন। এখনো হ্যারোতে বাবামার সঙ্গে থাকি। ওনারা একমাত্র মেয়ের মায়া কাটাতে পারছেন না।

সেদিন বাড়ি ফিরে কেন যেন নিজেকে নিয়ে একটু হতাশ বোধ করলাম। নায়লার টেক্সট দেখার পর থেকে মনের ভেতর একটা কাঁটা খচখচ করছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ক’জন মেয়ের সঙ্গে মোহনের সম্পর্ক ছিল। তাদের ভেতর কত জন মোহনকে আবার চাচ্ছে? মোহন কি আমাকে একটা বোকাসোকা দুধভাত মনে করে? মনের চাপ রাখতে না পেরে একবার নায়লার কথা সরাসরি জিগেস করলাম। মোহন পাত্তা না দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বললো
-স্যরি, কার কথা বললে? শায়লা, লায়লা নাকি নায়লা?
-এদের সবাই তোমাকে পছন্দ করে?
-হ্যাঁ। আমার কী করার আছে বলো। ভার্সিটিতে এত মেয়ে আমাকে পছন্দ করতো, আমি কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। মাঝে মাঝে মনে হতো আমি মোহন নাকি রাসপুটিন। যা হোক, তুমি কার কথা বলছো? শায়লা, লায়লা নাকি নায়লা?
অগনিত মেয়ে যে ওকে পছন্দ করতো সেটা নিয়ে মোহন বেশ গর্বিত। কিন্তু এত দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি মোহনের কথা যাচাই বাছাই না করে বিশ্বাস করা ঠিক না। মোহন যা বলছে তার উল্টোও হতে পারে। মোহনই হয়তো এই মেয়েগুলোর পেছনে ল্যালল্যাল করে ঘুরেছে। পরে একজন দুজন হয়তো ওকে দয়াপরবশ হয়ে পাত্তা দিয়েছে। আমি বিরক্তি চেপে রেখে বললাম,
-আমি নায়লার কথা বলছি। N ফর নায়লা।
-নায়লার কী কথা?
-নায়লা কি এখনো তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে?
মোহন কী বুঝে সাবধান হয়ে উত্তর দিলো,
-আর বলো না, ও একটা স্টকার। আমার পেছনে লেগে আছে তো লেগেই আছে। বিয়ে হয়ে গেছে তাও আমার পিছু ছাড়ছে না।
-ও কোথায় আছে জানো?
-ইস, হঠাৎ তুমি নায়লাকে নিয়ে লাগলে কেন?
-তোমাদের কি বিয়ের কথা হয়েছিল?
-বুঝলাম না, এখন এ নিয়ে বলছো কেন। আমি একটা সুদর্শন যুবক। ঢাকায় নিজের বাড়ি,গাড়ি সব আছে। এ রকম পাত্রকে তো অনেক মেয়েই বিয়ে করতে চাইবে। নায়লা ইজ ওয়ান অফ দেম, সমুদ্রের তীরে নুড়ির মত। কিন্তু নায়লার কথা তোমাকে কে বললো?
-সেদিন প্রোগ্রামের সময় সুমাইয়া তোমাকে দেখে বললো এই ভাইয়ার তো নায়লার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ছিল। ও তোমাকে চিনতে পেরেছিল কিন্তু তুমি চেনোনি।
-কিন্তু বিয়ে তো হয়েছে তোমার সঙ্গে আমার। ইউ আর দা লাকি ওয়ান। সো ড্রপ ইট। তোমাকেও তো কারাগারে বন্দী রেপিস্ট রঞ্জন বিয়ে করতে চেয়েছে। সেটা নিয়ে আমি কিছু বলি?

আমি মোহনকে সাবধান করতে চেয়েছিলাম, করলাম। দেখা যাক কী হয়। নায়লার আর কোন টেক্সট এর মাঝে দেখিনি। মোহন যদি অফিসে বসে শায়লা, লায়লা, নায়লার সঙ্গে টেক্সট চালাচালি করে তাহলে আমার কিছু করার নেই।

কিন্ত আমাকে ইদানীং যে ব্যাপারটা সবচেয়ে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তা হলো সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলে মোহনের মুখ থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ বের হয়।

(চলবে)

পর্ব ৩৩
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1383633465485010/
পর্ব ৩৫ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1387048305143526/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here