প্রজাপতি উৎসব পর্ব-৩

0
630

প্রজাপতি উৎসব

#প্রেম #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৩

কাল লাইব্রেরীর বুক সেল্ফের আড়ালে রায়হান মিতির টিশার্টের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে জিগেস করলাম,
-মানে কি মিতি? তোর ব্রেস্টে হাত দিয়েছে?

-একদম।

-তুই কিছু বললি না?

-আমি কী বলবো? আমি তো তখন হতভম্ব।

-তার মানে তুই কিছু বলিস নাই?

– ও ফিসফিস করে বুকে হাত দেয়ার কী সব গুরুত্বপূর্ণ কারণ দেখালো।

-বুকে হাত দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ দেখালো মানে?

-বইয়ের তাকে লা নুই বেঙ্গলী নামের একটা বই নামিয়ে রেখেছিল। ওর হাত তো তখন ব্যস্ত, আমাকে বললো সাতাশ নম্বর পৃষ্ঠা খুলতে।

-তুই সাতাশ নম্বর পৃষ্ঠা খুললি?

-হ্যাঁ।

-তারপর?

-ওখানে রাইটার মির্চা এলিয়াদের অভিজ্ঞতা লেখা।

-কী অভিজ্ঞতা?

– একশ বছর আগে একটা লাইব্রেরী ঘরে রাবীন্দ্রিক মৈত্রেয়ী দেবীর সাথে মির্চা এলিয়াদ একই কাজ করেছিল।

-মৈত্রেয়ী দেবীর বুকে হাত দিয়েছিলো?

-হ্যাঁ, তাও আবার উপরের জামাটামা খুলে, কী একটা অবস্থা, একশ বছর আগে।

-তার সঙ্গে রায়হানের তোর বুকে হাত দেয়ার কী সম্পর্ক?

-রায়হান বললো, সে নাকি সেই ঐতিহাসিক ঘটনা ইতিহাসের স্বার্থে রিক্রিয়েট করতে চেয়েছে।

-তুই বকলি না?

-বকেছি তো। বলেছি, পাবলিক প্লেসে এমন করো না প্লিজ।

-রায়হান কী বললো?

-রায়হান বললো দু দিন পর তো বিয়েই হবে। এখন একটু ওয়ার্ম আপ করে নিলে ক্ষতি কী? বিয়ের পর সাজানো গোছানো নিরাপদ পরিবেশে ফার্মের মুরগীর মত ইকড়িমিকড়ি করে এত রোমাঞ্চ নাকি হবে না।

-আচ্ছা বাবা, তোদের রোমাঞ্চ তোরা বোঝ। আমি এসব ইকড়ি-মিকড়ি-চাম-চিকড়িতে নাই।

আমি লক্ষ্য করেছি ইন্টেলেকচুয়ালরা সব সময় অন্যের ঘাড়ে ফেলে দুষ্টু কাজগুলো জাস্টিফাই করে। রায়হান কোথাকার মির্চা এলিয়াদের দোহাই দিয়ে মিতির বুকে হাত দিয়ে দিলো। বললেই পারতো ওর খুব ইচ্ছে করছে। কুদ্দুস স্যার গ্রীক ফিলোসফারদের কথা বলে মিলির সাথে লেপ্টে থাকে। কুদ্দুস স্যার, রায়হান এরা সব এক ধাঁচের।

ভাগ্যিস রঞ্জন ইন্টেলেকচুয়াল না। রঞ্জন বলেছে ও অ্যানটি-ইন্টেলেকচুয়াল, ফাইনাল পরীক্ষার আগের দশ দিন টানা পড়ে পরীক্ষার হলে বসে যায়। তারপরও রঞ্জনের হাতের গতিবিধি আর নেভিগেশনের ব্যাপারে আমাকে সাবধান থাকতে হবে। হুট করে আমার বুকে হাত দিয়ে বসলে আমি ঠিক ঠিক রেগে যাবো। সোজা সম্পর্ক ছেদ করবো।

এসব ভাবতে ভাবতে আমি অতিথি পাখী সরোবরের দিকে যাচ্ছিলাম। সরোবরের কাছে আসতেই দেখলাম রঞ্জন ক্যামেরায় চোখ রেখে সামান্য কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে । সরোবরের হালকা সবুজ পানিতে কতগুলো সাইবেরিয়ান ক্রেন জলকেলি করছে। রঞ্জনের ক্যামেরার টেলি লেন্স মনে হলো সে দিকেই তাক করা। রঞ্জন লাল কালো চেকের ফ্লানেল পড়েছে। শার্টের হাতা অর্ধেক গোটানো। কালো জিন্সের সঙ্গে শার্টটা দারুণ গেছে। রঞ্জনের ঝাঁকড়া চুল আর চওড়া কাঁধের উপর কৃষ্ণচূড়ার ডাল থেকে টুস টুস করে ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ছে।

আহা কী যে হ্যান্ডসাম লাগছে রঞ্জনকে। এরকম লম্বা, চওড়া হ্যান্ডসাম একটা ছেলে কেন দিনের পর দিন আমার পেছনে লেগে রইলো? এত সময় নিয়ে ফাউন্টেন পেনে হাতে লিখে লিখে চিঠি পাঠালো? আমার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে তো ভার্সিটিতে অনেক আছে। কথাটা ভেবেই আমি মনে মনে লজ্জা পেলাম। আমরা মেয়েরা কেন সব সময় ভাবি ছেলেরা চেহারা দেখেই প্রেমে পড়ে? সেটা ভাববার পরও কেন তাহলে আমরা ওদের ডাকে সাড়া দিই? না, না, রঞ্জন নিশ্চয় আমার ভেতর অন্য কিছু পেয়েছে। আমার পার্সোনালিটি কিংবা কোন একটা স্বকীয়তা নিশ্চয় ওকে অ্যাট্রাক্ট করেছে। আমি কাছে যেতেই রঞ্জন ক্যামেরা থেকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
-রূপা, তুমি কি জানো শাড়ি পরলে তোমাকে কত সুন্দর লাগে?

-কেন শাড়ি না পরলে সুন্দর লাগে না?

– সেটা শাড়ি না পরলে মানে শাড়ি খুললে গভীরভাবে পরযবেক্ষণ করে বলতে পারতাম, সে সুযোগ এ জীবনে পেলাম কোথায়?

আমার হাসি পেলো, কিন্তু হাসি চেপে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
-উফ, সেটা মিন করিনি, গাধা কোথাকার। আমি বলতে চাইছি সালোয়ার কামিজে কিংবা টিশার্টে কি আমাকে ভূতের মত লাগে? রূপার সৌন্দর্য কি ওই শাড়ির মহিমা? রূপা কি চাঁদ যার নিজের কোন রূপালী আলো নেই?

রঞ্জনে আমার হাত ধরে বললো,
-রূপা, সালোয়ার কামিজে তোমাকে মনে হয় একটা গোলাপ কলির মত, কলি ফুটিতে চাহে ফুটে না, মরে লাজে, মরে ত্রাসে। আর শাড়িতে তোমাকে মনে পূর্ণ বিকশিত গোলাপের মত, পরিপূর্ণ নারী।

-থাক এখন আর বানিয়ে বলতে হবে না। কীসের ছবি তুলছো, সাইবেরিয়ান ক্রেন?

-সাইবেরিয়ান ক্রেনের ছবি একটু আগে তুলেছি। এখন একটা খঞ্জনার ছবি তোলার চেষ্টা করছি।

-খঞ্জনা আবার কোথায়?

-লেকের ওই সাইডে ছাতিম গাছের উপরে আছে, খালি চোখে ভালো দেখতে পাবে না। ক্যামেরা দিয়ে দ্যাখো।

আমি ক্যামেরায় চোখ রেখে দেখলাম, দূরে একটা ছাতিম গাছের ডালে রঞ্জনের খঞ্জনা লেজ নাড়াচ্ছে। রঞ্জন আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
-কিন্তু তোমার গভীর চোখের পলক পাতায়
খঞ্জনা এক পক্ষী যেন পুচ্ছ নাচায়।

আমার ভেতরটা কেমন অদ্ভুত ভালো লাগায় তিরতির করে কেঁপে উঠলো। শিহরিল দেওদার বন। ঠিক ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল রঞ্জন আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুক। যা হবার হোক। বুঝলাম এভাবেই সর্বনাশ হয়।

না, সবাই শরীর ছুঁলে এমন হয় না। ক’দিন আগে ইস্কাটন লেডিজ ক্লাবে আমার ফুপাতো বোনের বিয়ে ছিল। বর কণের সঙ্গে গ্রুপ ছবি তোলার সময় এক আঙ্কেল মুরুব্বী মুরুব্বী ভাব করে আমার পিঠে হাত রাখলো। তারপর ব্রার স্ট্র্যাপ ধরে টুস করে টান মারলো। ঘৃণায় আমার গা রিরি করে উঠেছিল। আমিও আঙ্কেলের লোলুপ হাতে জোরে চিমটি দিয়ে নখ গেঁড়ে দিয়েছিলাম। আঙ্কেল না পারে কইতে, না পারে সইতে।

কিন্তু রঞ্জনের স্পর্শ অন্যরকম। সর্বনাশা। বুকের ভেতর ষড়ঋতু, ষড় রিপু আর জোয়ারভাটা ডেকে আনে। আমি ভালবাসার অতি উচ্ছাস লুকোতে রঞ্জনকে বললাম,

-কী সুন্দর পাখী, তাই না?

-হ্যাঁ, খঞ্জনা আমার খুব পছন্দের পাখী, ভীষণ চঞ্চল।

-আচ্ছা রঞ্জন, খঞ্জনা কি খাওয়া যায়?

রঞ্জন আহত চোখে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি ফিক করে হেসে বললাম,
-উফ, ঠাট্টা করলাম রঞ্জন। আমি খঞ্জনা খাবো কোন দুঃখে? আমার ঘরে কি টিকটিকি, তেলাপোকার অভাব হয়েছে?

রঞ্জন এবার হো হো করে হেসে ফেললো। রঞ্জনের এই রমনীমোহন সহস্র স্বর্ণমুদ্রার হাসি দেখার জন্যই আমার মন উতলা হয়ে আছে । তা না হলে আমি কি আর ঠাট্টা করার মানুষ?

ছবি তোলা শেষে ক্যামেরা ট্রাইপড গুছিয়ে আমরা উল্টো দিকে কাশেমের চায়ের টং-এ বসলাম। চায়ের কাপ হাতে নিতেই টিটু ভাই অনেকগুলো লিফ্লেট হাতে কোত্থেকে এসে আমাদের সামনের বেঞ্চে বসলেন। কাশেমকে চা দিতে বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-এই রূপা, তোমাকে আমি এক সপ্তাহ ধরে খুঁজছি।

-আমাকে খুঁজছেন? জানি না তো।

-কেন, মিতি বলেনি?

-কই, না তো, মিতি তো কিছু বলেনি।

-তোমার সঙ্গে জরুরী কথা ছিল, একটু আসবে এদিকে?

আমি টিটু ভাইকে অনুসরণ করে আবার ওই দীঘির ধারেই গেলাম। উনি একটা লিফ্লেট আমার হাতে দিলেন। লিফ্লেটে লেখা, শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার। আমি আন্দাজ করে বললাম,
-উফ, টিটু ভাই, আবার সেই কাজ। মেয়েদের হলে লিফ্লেট বিলি করতে হবে তো? আচ্ছা আমাকে দিন, আমি করে দেবো।

টিটু ভাই গম্ভীর হয়ে বললেন,
-লিফ্লেট বিলি করতে বলিনি। হঠাৎ করে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলারশিপ পেয়ে গেছি। অনেক চিন্তা করে দেখলাম আমার এই সুযোগটা নেয়া উচিত।

আমি খুশী হয়ে বললাম,
-কনগ্রাচুলেশন্স টিটু ভাই, আপনি এত ব্রিলিয়ান্ট, ইউ ডিজার্ভ ইট। কবে যাচ্ছেন?

-আগামী মাসে ফ্লাইট।

-ভালোই হলো, এখানে নাকি টিচিং-এর জবটা আপনাকে এমনিতেও দিতো না। তাছাড়া শুনলাম কারা নাকি আপনাকে ক্যাম্পাস ছাড়ার জন্য হুমকি দিয়েছে?

-হুম। হুমকির ভয়ে আমি কখনো আদর্শ ছাড়িনি। তুমি লিফ্লেটটা পড়েছ?

-পড়লাম তো, শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার।

-না, না, উল্টো দিকে দ্যাখো।

আমি লিফ্লেট উল্টে দেখলাম গোটা গোটা অক্ষরে লাল কালিতে লেখা,

-আই লাভ ইউ কমরেড, আই লাভ ইউ।

টিটু ভাই বাঁ আঙ্গুলে লিকোপ্লাস্ট দেখিয়ে বললেন,
-কাল রাতে আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে লিখেছি। রূপা, তুমি কিছু একটা বলো প্লিজ।

টিটু ভাই আমাকে পছন্দ করেন সেটা আমি জানি। আমারও ভালো লাগে টিটু ভাইকে। খুব ভালো মানুষ উনি। আমি চাইনা আমার কোন কথায় টিটু ভাই আহত হোক।

এখন আমি কী করি ? ওদিকে চায়ের টং থেকে রঞ্জন হাতের ঘড়ি দেখিয়ে আমাকে ইশারায় ডাকছে।

(চলবে)

#এশরারলতিফ

পর্ব ২
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1340245509823806/
পর্ব ৪ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1342443359604021

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here