প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ১৪

0
2638

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নক্ষত্রলোকের ক্লান্তিহীন অশ্রুজলে সিক্ত পত্রপল্লব।ধরিত্রীর প্রভঞ্জনে হিমশীতলতা।শান্ত প্রকৃতির অশান্ত,বিমূঢ় আচরণে উৎকন্ঠিত মনুষ্যগন।যামবতীর নিকষকৃষ্ণ আঁধার ফুঁড়ে বজ্রধ্বনি।ঝমঝমিয়ে মৃত্তিকার বুকে পড়া কলধ্বনি।নির্বাক,শীতল পরিবেশে ছন্দপতন শুধু বর্ষণের।

পিচঢালা সড়ক পথের পায়ের গোড়ালি ডুবন্ত পানি।শহরাঞ্চলে বর্ষণের অতি পরিচিত রোমাঞ্চকর রূপ।ক্ষণিক বর্ষণে জমে যায় জলদবারি।ডুবো ডুবো পায়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির তাল সামলিয়ে একটা ক্যাফেতে ঢুকে চার বন্ধু।নভোমণ্ডলের ক্রন্দন আজ যেনো থামবার নয়।খানিক সময় পরপর মৃদু সুরে সে ঝরায় অশ্রুনীর।তাতে প্রলেপিত হয় বসুন্ধরা।

মাঝখানে অবস্থিত একটি টেবিলের দুই পাশে বসে আয়েন্দ্রি,সীমান্ত আর প্রাবিশ,নিষ্প্রাণ।সীমান্ত পাতলা শার্ট দ্বিতীয়বারের মতো বৃষ্টির কবলে পড়ে।আয়েন্দ্রির শরীরে মৃদু বৃষ্টির ছটা।আঁচলটা পেছনের দিকে মেলে দিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে সে।ফ্যানের বাতাসে কম্পিত দেহেও প্রশান্তি।আর্দ্র দেহে উষ্ণতার যোগান প্রয়োজন।প্রাবিশ মুখে লেগে থাকা পানি মুছে নেয় টেবিলে থাকা টিস্যু পেপার দিয়ে।সেই মতো ঘটনার পূনারাবৃত্তি ঘটায় আয়েন্দ্রি।ঝাঁকড়া চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ।শার্টের উপরের দুই বাটন খুলে কলারটা পেছন দিকে ছড়িয়ে দিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে সীমান্ত।তার অগোছালো বসার কায়দা দেখেও নির্বিকার সকলে।এক পা হাঁটু ভেঙে বেঞ্চে উঠিয়ে রেখেছে।দ্রুত বেগে ঘুরছে ফ্যান।সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

ক্যাফের ছেলেটা এসে অর্ডার নিয়ে যায়।পারসেট আড়াইশত টাকার সেটমেন্যু অর্ডার করে সীমান্ত।আজকের স্পেশাল অফারে চারশত টাকার বদলে তা আড়াইশত করা হয়েছে।নিষ্প্রাণের মনে চলছে নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতা।তার দাদু তাকে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি।ভুলতে পারেনি ভয়াল সে অতীত।সেই আগুন,আগুনে দগ্ধ লাশ,ছাই হয়ে স্তুপে পরিণত হওয়া সেই দেহাংশ।নিষ্প্রাণের মানসলোকে প্রকটিত হয় সেই আর্তনাদ,সেই মৃত্যু আহাজারি,চোখের সামনে লহুতে রঞ্জিত সেই লাল তিলওয়ালা ঠোঁট। যার চোখে সম্ভ্রম হারানোর কাতরতা।প্রস্ফুরণ শুরু হয় নিষ্প্রাণের শরীরে।শ্বাসের বেগ বাড়তে থাকে।নিষ্প্রাণ অব্যক্ত রাগে ফুঁসতে থাকে।তার বেগতিক অবস্থায় ধমকে উঠে সীমান্ত–

“ওই নিষ্প্রাইন্না !কী হয়েছে তোর?

ফট করেই অক্ষিপল্লব মেলে ধরে নিষ্প্রাণ।উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক পলক ফেলে তাকাতেই দেখে সব শান্ত,স্বাভাবিক।নেই উষ্ণতা,নেই শোনিত জড়ানো সেই লাশ,নেই কৃষ্ণকায় দগ্ধ দেহ,নেই আর্তনাদ।নিজেক ধাতস্থ করে লোচনজোড়া থেকে চশমাটাটা নামিয়ে রাখে টেবিলে।একটা টিস্যু নিয়ে ঝাপসা চশমাটা মুছে পূর্বের স্থলে প্রতিস্থাপন করে।মুচকি হাসে আয়েন্দ্রি।প্রশ্ন করে—

“পাওয়ার কতো?

নিষ্প্রাণ নির্দ্বিধায় বললো–

“মাইনাস 1….।”

সীমান্ত খটমটিয়ে বললো—

“তোর দরকার কী?তুই ও আন্দা হবি নাকি?অবশ্য তুই তো নাম রাখার পর থেইকাই আন্দি।”

সীমান্তের মাথায় চাটি মেরে বসে আয়েন্দ্রি।সীমান্ত ছোট্ট দম ফেলে নিরুদ্যম গলায় বললো—

“ডিমের কুসুমডার ভাব বাড়ছে।রিকোয়েস্ট করলাম তাও আইলো না।”

আয়েন্দ্রি অনুদ্বেগ গলায় বললো–

“ও আসলে ওর মামা,মামী রাগ করবে।অন্যের বাসায় থাকে বুঝিস তো ব্যাপারটা।”

“কেন তিনকোনা মানাইতে পারতো না?হুরর!যত্তসব।”

আয়েন্দ্রি হতাশ গলায় বললো–

“তৃণা লেখাপড়া নিয়ে সিরিয়াস।এইসবে ওর ইন্টারেস্ট নেই।”

“ওরে যাইয়া বলিস ওর মধ্যেও কোনো ইন্টারেস্ট নাই আমার।”

কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁঞ্চি করে তিন জোড়া স্থির চোখ সীমান্তের দিকে অকস্মাৎ তাকাতেই মিনমিনে গলায় বলে উঠে সে—

“আরে আগে থেইকা কইয়া রাখলাম আরকি।ওইসম বইয়ে ডুইবা থাকা ললনা দিয়া আমার পোষাইবো না।”

নিষ্প্রাণ অধর কোণে হেসে সামনের দিকে তাকাতেই তার শিথিল দৃষ্টি অনুপলেই অশিথিল,অচক্রী,তীক্ষ্ম,
উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে।পেছনের বিশাল আয়নায় আয়েন্দ্রির উন্মুক্ত পিঠের অর্ধাংশ দৃশ্যত।তাদের টেবিল থেকে দুই টেবিল পড়ে থাকা টেবিলে উপবিষ্ট দুই জোড়া ছেলের মধ্যে একজনের নিমেষহীন চাহনি আয়েন্দ্রির শুভ্র,বাঁকহীন নগ্ন পিঠে।তরতর করে নিষ্প্রাণের থিতিয়ে থাকা সেই বন্দি মানব যেনো জাগ্রত হতে চাইছে।সকলের অগোচরে ভাবাবেগ ছাড়াই উঠে দাড়ায় নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রির পাশে গিয়ে টেবিলের উপর এক হাত রেখে ঝুঁকে যায়।আয়েন্দ্রির কর্ণরন্ধ্রে ফিসফিসানো আওয়াজ—

“সামনের টেবিলে গিয়ে বসো।”

নিষ্প্রাণের ক্ষীণ কন্ঠ ভয়ংকর শীতল মনে হলো আয়েন্দ্রির।তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে শিরশিরিয়ে উঠলো আয়েন্দ্রির দেহপিঞ্জর।দ্বিধান্বিত আয়েন্দ্রি বিনাশব্দে উঠে নিষ্প্রাণের জায়গায় বসে।হতভম্ব চোখে অবলোকন করছে প্রাবিশ আর সীমান্ত।খাবার দিয়ে যেতেই স্বাভাবিক হয় পরিস্থিতি।কিন্তু নিষ্প্রাণের নজর সেই ছেলেটির প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে।আয়নায় তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নিষ্প্রাণ।তার অভীপ্সা জাগ্রত দুই চোখে খেলে যাচ্ছে আয়েন্দ্রির দেহের গভীরতার লুকায়িত বাসনা।খাবারে মনোযোগ নেই নিষ্প্রাণের।

আধুনিক ক্যাফে হওয়ায় হাত ধোয়ারও আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে।সম্মুখে উপস্থিত আরশিতে লোচনজোড়া স্থির হতেই আয়েন্দ্রি ঠাওর করে তার লাল ঠোঁট দুটোতে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে লিপস্টিক।টিস্যু দিয়ে মুছে নেয় তা।আয়েন্দ্রির নগ্ন কোমরে যেই না হাত ছোঁয়াতে যাবে ছেলেটি তাকে এক ঝটকায় টেনে হাতের মুষ্টি তার চোখের সন্নিকটে এনেও রুখে যায় নিষ্প্রাণ।নাকের পাটা ফুলিয়ে,দাঁতে দাঁত নিষ্পেষন করে নিজেকে শান্ত করে নিষ্প্রাণ।স্বল্প সময়ের পার্থক্যে হুলস্থুল কান্ড।ছেলেটি অস্বীকার করে তার উদ্ধত নোংরা কাজটির।নিষ্প্রাণ গজরাতে থাকে।পকেট থেকে হাজার টাকার নোট বের করে ধরিয়ে দেয় সীমান্তের হাতে।কঠিন গলায় বললো—

“বিলটা পে করে দিস।আই এম ফিলিং রেস্টলেস।”

নিষ্প্রাণের পরাস্থতায় পৈচাশিক হাসে ছেলেটি।ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আর্দ্র,বালিতে দলিত সড়কপথে হাঁটা ধরে নিষ্প্রাণ।চূড়ান্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ তার পদতলে।দপ দপ করে পা ফেলতেই সড়কের জমা পানি আর পানিমিশ্রিত বালু,আবর্জনা নিষ্প্রাণের দুই প্যান্ট মাখিয়ে ফেলেছে।তবুও অশান্ত দুই পা এগিয়ে চলছে।
,
,
,
ক্রন্দনে হাঁসফাঁসিয়ে উঠা নিশীথিনীর অম্বু শান্ত।টানা বর্ষণে ভারী বুক হালকা হয়েছে তার।রাতের স্নিগ্ধ আকাশে উদিত চন্দ্রিকা।ঝিলমিলে তারকারাজি আজ অদৃশ্য।সমীরণে এখনো আর্দ্রতা।পথঘাট পানিতে পরিশ্রান্ত।

ঢাকা শহরের টিবিগেট একটা ঘনবসতি এলাকা।মূল সড়ক থেকে ভেতরের অলিগলি বেশ সংকীর্ণ।লাগোয়া ঘরবাড়ি।ভেতর গলির প্রশস্ততা এতোটাই সংকীর্ণ যে প্রশ্ন হতে পারে আদৌ সেখানে তিন চাকায় চালিত রিক্সার প্রবেশ সম্ভব?এখানেরই সাইড দেওয়াল আর টিনের ছাউনি বেষ্টিত তিন বেডরুম আর রান্নাঘর,স্নানাগার বিশিষ্ট নিজস্ব বাড়িতে থাকেন জহুর মিয়া তার দুই ছেলেকে নিয়ে।ছোট ছেলে এখানকার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট।

একজন চেইন স্মোকার জহুর সাহেবের ছোট ছেলে জেমি।রাতের খাবার খেয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে বাইরে বের হয়ে আসে।ভগ্নিপতী এসেছে বলে নিজের ঘরটা তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।বড় ভাইয়ের সকালে অফিস।সে নিজ কক্ষে নিদ্রাচ্ছন্ন।বাবা অসুস্থ। হাফ দেওয়ালের বাউন্ডারির বাড়িটির ছোট্ট গেইট খুলে বাইরে এসে সিগারেট ধরায় জেমি।দুই আঙুলের ফাঁকে রেখে দুটো টান দিতেই আচমকাই তার মুখে কেউ রুমাল চেপে ধরে।জেমি কিছু বুঝে উঠার আগেই নিশ্চেতন হয়ে ঢলে পড়ে পেছন দিকে।তার পুরো ভর সামলে নেয় নিষ্প্রাণ।সহজ,স্বাভাবিক নিষ্প্রাণ ভেজা রাস্তায় শুইয়ে দেয় জেমিকে।জেমি অচেতন।হাতের সিগারেটটা নিচে পড়ে যেতেই জলের সংস্পর্শে নিভে যায় তা।এক হাঁটু গেড়ে বসে নিষ্প্রাণ।নীরব,নিস্তব্ধ,নির্বাক চারপাশ।নিষ্প্রাণের চাহনিতে অবিশ্বাস্য স্বাভাবিকতা।কোমল স্বরে বললো—

“আমার ধ্রুবতারার দিকে হাত বাড়িয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করলি তুই।”

নিষ্প্রাণ সাবলীলভাবে একটা ছোট্ট শিশি বের করে পকেট থেকে।তার ছিপি খুলে কাত করে ভেতরে থাকা তরল ঢালতে থাকে জেমির মুখের উপর।অদ্ভুত আওয়াজে ঝলসে যেতে থাকে জেমির মুখমণ্ডল।সালফিউরিক এসিডে দগ্ধ হয়ে যায় জেমির সুশ্রী মুখটা।তীর্যক হাসে নিষ্প্রাণ।ঘুমের চাদরে আবৃত নগরীতে জেগে আছে রাস্তার নেড়ি কুকুর।আবছা আলোতে নিষ্প্রাণকে দেখে সশব্দে ডেকে উঠে কালো রঙের হাড় বেরিয়ে আসা কুকুরটি।নিষ্প্রাণ আলতো হাসে।আরো কয়েকটা কুকুর এসে জড়ো হওয়ার আগেই জেমির গলায় ঢুকিয়ে দেয় বিশাল এক লোহার তীক্ষ্ম দন্ড।যা সহজেই ঢুকে যায় স্বরনালীর গভীরে।গলগলিয়ে রক্তের ধারা বইতে থাকে।কুকুরের আত্ম চিৎকার শুরু হতেই অন্ধকারের প্রলীন হতে থাকে নিষ্প্রাণ।তার ঠোঁটে সেই অদ্ভুত সিটির সুর,তৃপ্তির হাসি।কুকুরগুলো জেমিকে ঘিরে সমানতালে চেঁচিয়ে পুরো এলাকার ঘুমন্ত মানুষদের জাগিয়ে তুলছে। শীতল,স্বচ্ছ পানির সাথে মিশে যাচ্ছে জেমির উষ্ণ,লাল রক্ত।

চলবে,,,

(বিঃদ্রঃ
সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন😒😒😒)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here