প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ১৮

0
2291

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

অবিচ্ছিন্নভাবে চোখে,মুখে পানি ছিটাচ্ছে নিষ্প্রাণ।জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ায় ভয়ংকর শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে।নিজেকে তার কোনো হিংস্র দানব মনে হচ্ছে।ইচ্ছে করছে সমস্ত পৃথিবীকে গুড়িয়ে দিতে।যেমনটা সে তার দশ বছর বয়সে করেছে।সেই আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলন্ত মানুষের আহাজারি আজও নিষ্প্রাণের কানে বাজে।সেই পোড়া গন্ধ আজও তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে ধাক্কা মারে।বালতির দুই পাশে হাত ঠেকিয়ে উপুর হয়ে পানির দিকে চেয়ে থাকে নিষ্প্রাণ।টলটলে,স্বচ্ছ পানিতে তার ভেজা মুখটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে।নাকের ঢগা,কপাল চুঁইয়ে আর অধর থেকে ঝুলন্ত পানির টুপটুপ নিঃসরণ।নিষ্প্রাণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার নিজ চোখের প্রতিবিম্বতে।মুখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তেই তা এলোথেলো হয়ে যায়।আবার শান্ত হয়।নিষ্পলক চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ।দরজায় করাঘাত পড়তেই সপ্রতিভ হয় সে।ককর্শ আওয়াজ শোনা যায়।

“ভেতরে ক্যাডা?এতো সময় লাগে ক্যান?

নিষ্প্রাণ নিজের সুপ্ত রাগকে প্রশমিত করে।স্বাভাবিক হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে সৌজন্য সূচক হেসে বললো–

“ক্ষমা করবেন।”

বৃদ্ধ লোকটি অদ্ভুতভাবে তাকালো।খিচতি মেরে বললো–

“এতো সময় ধইরা কী করো মিয়া?

নিষ্প্রাণ জবাব দিলো না।নির্বিঘ্নচিত্তে সরে আসে।এই মেসে অনেক মানুষের বাস।বৈচিত্র্য রয়েছে ভাষায়,ব্যবহার আর ধর্মে।দেশের শেষ সীমান্ত থেকেও অনেকে কাজের খোঁজে আসে এই ইট,পাথরের শহরে।তাদের ঠাই হয় হাজার টাকার এই মেসে।একগাদা মানুষের সাথে ঠেসাঠেসি,চোখাচোখি এমনকি মারামারি করেও টিকে থাকতে হয় এই শহরে।

ঘরে এসে ঘামে ভেজা শার্টটা খুলে পড়ার টেবিলের কার্ণিশে ছড়িয়ে দেয় নিষ্প্রাণ।কপালের দুই পাশে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।হাতের থাকা গ্লাসটা বিছানার একপাশে রেখে লম্বালম্বি শুয়ে পড়ে।চোখের পাতা বুজে নেয় নিষ্প্রাণ।নিমীলিত আঁখিতে তার ভাসা ভাসা সেই হাসি।সেই ঠোঁট,সেই লাল তিল।আর সেই কন্ঠ,”বিয়ে করবি আমায়?

নিষ্প্রাণের দেহ অচেতন হয়ে পড়ে।হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।খানিক পরেই মোবাইলের অস্বস্তিকর ভাইব্রেশনের শব্দ।অমিলীলিত চোখে তাকাতেই দেখে সীমান্তের নামটা মোটা অক্ষরে দৃশ্যমান।নিষ্প্রাণ কল রিসিভ করেই সাথে সাথে কথা বললো না।সীমান্ত চওড়া গলায় বলে উঠে—

“নিষ্প্রাইন্না,এতো ভাব লস ক্যান?নাম নিচে।”

নিষ্প্রান ফিকে গলায় বললো—

“কেন?

“আন্দির বাসায় যামু।তোর লাইগা শালা ট্রিট মিস হইয়া গেলো।”

নিষ্প্রাণের ভ্রু জোড়া ক্ষণপলেই কুঞ্চিত হয়।কপালের মাঝ বরাবর দুটো সরু ভাঁজ উবে উঠে।সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

“কেন?ওর বাসায় যাবি কেন?

সীমান্ত চরম বিরক্তি নিয়ে বললো–

“এক ঠাটাইয়া চড় মারমু গালের দুই আঙুল নিচে।এতো প্রশ্ন করোস ক্যান?নামতে কইছি নাম।নাইলে তোর তোর ওই গুপ্ত ঘরে ঢুইকা পড়মু কইতাছি।”

নিষ্প্রাণ কখনো তার বন্ধুদের নিজের মেসে আনে না।ভার্সিটি আসার প্রথম সপ্তাহেই ভালো বন্ধুত্ব হয় সীমান্তের সাথে।সীমান্তের লাগামছাড়া কথাবার্তায় মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও তার ভেতরকার সরল মনের মানুষটিকে আপন মনে হয় নিষ্প্রাণের।প্রাবিশের সাথে কথা হয় মাস তিনেক পরে।তাদের রেজিষ্ট্রেশন ফি জমা দিতে প্রায় ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে নিষ্প্রাণ।প্রাবিশের সহায়তায় সেদিনকার মতো এই অপেক্ষা থেকে নিষ্কৃতি পায় সে।এভাবেই শুরু হয় তাদের বন্ধুত্বের সুরের তাল।প্রাবিশ আর সীমান্তের সাথে ডিপার্টমেন্টের অন্য স্টুডেন্টদের একটা অমায়িক সম্পর্ক থাকলেও নিষ্প্রাণের সাথে সেই সম্পর্ক তারকাটার মতো।সবসময় তাকে বিঁধে যায়।

নিচে নেমে এসে নড়বড়ে গেইটটার সামনে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।সীমান্ত আর প্রাবিশ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।নিষ্প্রাণ বুকে একটা ধাক্কা কিল মেরে গর্জে উঠে সীমান্ত।

“শালা ঢঙ করোস! আইয়া পড়লি কেন এমনে?

নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়।

“ভালো লাগছিলো না।তোরা কেন এসছিস?

” আন্দির মা সবাইরে যাইতে কইছি।চল।”

নিষ্প্রাণ সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো–

“কেন?

“এতো কথা কইতে পারুম না।চল।”

,
,
,
আয়েন্দ্রির মা ঝুমা মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে তার বন্ধুদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।সীমান্ত চিল মুডে খেয়ে যাচ্ছে।খাওয়া দাওয়ায় তার বাছ-বিচার নেই।প্রাবিশের জন্য আলাদা রান্না করেছেন ঝুমা।কষা মুরগির মাংস আর সরষে ইলিশ।ভূনা গরুর মাংস পেয়ে আর কিছু দেখলো না সীমান্ত।নিষ্প্রাণের খাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে আরিশা।খাওয়াতে অনীহা না থাকলেও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না তার।আরিশা ফিচেল গলায় বললো–

“নিষ্প্রাণ ভাইয়া আপনার কী কোনো সমস্যা?রান্না কিন্তু আপু করেনি।মা করেছে।নির্দ্বিধায় খেতে পারেন।পেট,মন দুটোই শান্তি পাবে।”

চোখে হাসে নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি রাগ দেখিয়ে বললো—

“এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দেবো।যা এখান থেকে।”

খিলখিলিয়ে হাসে আরিশা।তার কথায় চাপা হাসে তৃণা,কুসম।আয়েন্দ্রি রান্না ঘরে গিয়ে তার বাবার কথা জিঙ্গেস করতেই জানতে পারে সে এখনো বাইরে।আয়েন্দ্রির চোখে,মুখে বিষাদ ছেয়ে যায়।আজও তাকে বাইরে থাকতে হবে?নিজের মোবাইল নিয়ে কল করতে গেলে টুক করে তা শাটডাউন হয়ে যায়।আয়েন্দ্রি বিপাকে পড়ে।ড্রয়িং রুমে এসে সীমান্তের কাছে মোবাইল চাইতেই সে বলে ব্যালেন্স নেই।আয়েন্দ্রি আগ্রহী চোখে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে।তার থেকে মোবাইল নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই আচম্বিত হয় আয়েন্দ্রি।পুরো স্ক্রিন জুড়ে এক অদ্ভুত ওয়ালপেপার।আয়েন্দ্রির কেমন অস্বস্তি হলো।মনে হলো এইটা তারই পরিচিত কিছু।আয়েন্দ্রির হাত চলে যায় তার ওষ্ঠাধরে।তার গাঢ় লাল তিলের এক স্পষ্টত ছবি যা নিষ্প্রাণের মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে।আয়েন্দ্রি ত্রস্তে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে।নিষ্প্রাণের অধরে খেলে যাচ্ছে মিষ্টি হাসি।সেই হাসিতে প্রাণহাণি মায়া,চোখে রয়েছে খুন হয়ে যাওয়ার তীব্র অভীপ্সা।চট করেই আয়েন্দ্রির মস্তিষ্কের নিউরণে খেলে যায় গোলযোগ।নিষ্প্রাণের কললিস্ট চেক করতেই জ্বলজ্বলে চোখে দেখতে পায় ধ্রুবতারা নাম দিয়েই সেভ করা তার নাম্বার।আয়েন্দ্রি ভীত চোখে তাকায়।শুষ্ক ঢোক গিলে গ্যালারিতে যেতেই দেখে তা লক করা।আয়েন্দ্রির গলা শুকিয়ে আসে।চমকে উঠে সে।

“কী খুঁজছিস?

আয়েন্দ্রি জড়ানো গলায় বললো—

“কীককক কিছু না।তোর মোবাইল নে।”

নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক হাসে।মোবাইলটা নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে বিনা সংকোচে।আয়েন্দ্রির উদ্বিগ্ন চাহনি।কোমল হাসে নিষ্প্রাণ।হাতের মুঠ উন্মোচন করে দৃঢ় দৃষ্টিপাত করে আয়েন্দ্রির ঠোঁটে।সরল কন্ঠে বললো—

“এইটা তোর জন্য।হ্যাপি বার্থডে।”

নিষ্প্রাণের হাতে ঝুলে আছে এন্টিক রঙয়ের একটা চেইন।চেইনের সাথে একটা তারকাকৃতির লকেট যার মধ্যখানে সফেদ রঙের পাথর।আয়েন্দ্রি হাতে নিয়ে বিস্মিত চোখে দেখে।অনুরাগী গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“গলায় পরে দেখ।ভালো লাগবে তোকে।”

আয়েন্দ্রি নিস্পৃহ গলায় বললো—

“পরে।”

“এখনই গলায় পরে নে।আমি দেখি কেমন লাগছে তোকে।”

নিষ্প্রাণের আঁখুটে কন্ঠ আয়েন্দ্রির মনে ভয়ের উদ্বেগ ঘটায়।খাওয়া শেষ করে প্রাবিশ এসে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণের পাশে।তার কাঁধে হাত রেখে বললো—

“এতো করে যখন বলছে গলায় পরে নে।”

আয়েন্দ্রি শুষ্ক চোখে তাকিয়ে চেইনটা গলায় পরে নেয়।প্রসন্ন হাসে নিষ্প্রাণ।লকেটের মাঝের সেই সফেদ পাথরের নিচে লাগানো একটা মাইক্রোচিপ।যার মাধ্যমে আয়েন্দ্রির সশব্দে ফেলা নিঃশ্বাসও পৌঁছে যাবে নিষ্প্রাণের কর্ণরন্ধ্রে।যে আয়েন্দ্রিকে প্রতিটি ক্ষণ নিষ্প্রাণের প্রাণস্পন্দন করে রাখবে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here