প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ২৫

0
2234

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রায় মিনিট বিশেক শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে আয়েন্দ্রি। নির্ঝরের মতো ধাবমান শীতল জলে নিজেকে সিক্ত করে। জলের স্রোতে ঝেড়ে ফেলে তার সমস্ত বিষন্নতা।

ভেজা চুলে তোয়ালে ঘষতে ঘষতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রি। ধীম ধীম পায়ে এগিয়ে এসে বিছানায় বসে। বিছানার হেডবোর্ডের সাথে মাথাটা হালকা হেলিয়ে দিয়ে সিলিং এ চোখ নিবদ্ধ করে। হাতের তোয়ালেটা নৈঃশব্দে নিচে পড়ে যায়। আয়েন্দ্রির অন্তরিন্দ্রিয়তে দহন হচ্ছে। সেই দহনক্রিয়ায় জ্বলছে সে। কাউকে সে তার সাথে শামিল করতে পারছে না। বলতে পারছে না তার নীরব ঘাতকের কথা। যা তীলে তীলে তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

আয়েন্দ্রি শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন, ত্রস্ত। আয়েন্দ্রির বাবা নিষ্প্রাণকে কখনো মেনে নিবে না। একটা এতিম ছেলের হাতে সে তার মেয়েকে কখনও তুলে দিবে না। নিষ্প্রাণের নিজের কোনো উপার্জন নেই। অন্যের অর্থে দিন অতিবাহিত করে। সমবয়সী তারা। আয়েন্দ্রির বাবা হুট করে চাইলেই আয়েন্দ্রিকে বিয়ে দিতে পারে। কিন্তু নিষ্প্রাণের পক্ষে এখন না বিয়ে করা সম্ভব, না উপার্জন।

নিজেকে সামলাতে বড্ড বিপাকে পড়েছে আয়েন্দ্রি।
মন আর মস্তিষ্কের খেলে মনকে হারাতে চায় সে। আয়েন্দ্রির ভাবনার রেশ কাটে তার মায়ের জোরালো গলার স্বরে। চকিতে তাকাতেই দেখল ঝুমার বিষন্ন মুখ। নিজের উৎকন্ঠা চাপা পড়ে মায়ের ভীত মুখ দেখে। অলস ভঙিতে প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—

“কী হয়েছে মা?

ঝুমা ব্যস্তসমস্ত হয়ে আয়েন্দ্রির সামনে বসল। ভীত গলায় বলল—

“দেখ না সে কখন থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে মেয়েটা! খুলছেই না।”

খানিকটা বিস্মিত হলো আয়েন্দ্রি। কার কথা বলল?তার বোন!
আরিশা তো দরজা বন্ধ করে থাকার মেয়ে নয়! তার তো পুরো বাড়ি দলিয়ে ফেলার কথা! তাহলে?

আয়েন্দ্রির বিস্মিত ভাব কেটে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই তা মাথায় টোকা মারল। চিন্তার গভীর রেখা ফুটে উঠল তার সরু কপালে। বিশদভাবে জানার ইচ্ছা পোষণ করে বলল—

“কেন? কী হয়েছে?

ঝুমা তীব্র হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। ভীত গলায় প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন—

“জানি নারে মা। স্কুল থেকে ফেরার পর থেকে কেমন অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে! দুপুরে খায়ওনি। ঘুমিয়েছিল। ঘুম থেকে ওঠার পর ঘরেই বসে আছে। কতবার ডাকলাম কোনো সাড়াশব্দ নেই। তুই একটু দেখ না মা।”

আয়েন্দ্রি ভাবুক চোখে তাকায়। তার বোনটা চড়ুই পাখির মতো। এ ডালে ও ডালে ঘুরে বেড়ানোর জন্যই তার জন্ম। তাহলে আজ কেন সে বন্দি!

অচিরে উঠে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি। অশান্ত চিত্তে ছুটে যায় বোনের কাছে।

কোলাহল চলছে মেসের ভেতরে। সিঁড়ি বেয়ে নিমগ্নচিত্তে উঠছে নিষ্প্রাণ। একাগ্রমনে শুনছে আয়েন্দ্রি ও তার মায়ের কথোপকথন। আশেপাশে নজর নেই তার। কোনো আগ্রহও নেই। নিষ্প্রাণ চলছে আপন মনে মেসের করিডোর দিয়ে।

অনেকক্ষণ যাবৎ দরজায় করাঘাত করার পর দরজা খুলে আরিশা। তাকে দেখেই হতবাক দৃষ্টি আয়েন্দ্রির। কচি, উচ্ছলতায় আচ্ছন্ন থাকা মুখটি বিবর্ণ। চোখের পাতা সিক্ত। অশ্রুসিক্ত নয়নযুগল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখের নিচের অংশ ফুলে গিয়েছে। ওষ্ঠাধর ফুলিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলে আরিশা। বোনের বুকে আঁছড়ে পড়ে। আয়েন্দ্রি শক্ত হাতের বেড়িতে বোনকে জড়িয়ে নেয়। ঝুমা ভেতরে আসলেন না। দরজার চৌকাঠ থেকে ফিরে গেলেন। আয়েন্দ্রি তটস্থ হয়ে ভেতরে দিকে নিয়ে আসে আরিশাকে। বিছানার উপর বসিয়ে চোখ, মুখ মুছিয়ে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে—

“কী হয়েছে আরু? কাঁদছিস কেন তুই?
কেউ কিছু বলেছে?

আরিশা ঠোঁট ভেঙে ফুঁপাতে থাকে। তার নাকের ডগা সংকুচিত, প্রসারিত হচ্ছে। বুক কেঁপে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আয়েন্দ্রি ঝপাৎ করে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে আরিশাকে। পিঠের উপর আলতো হাত রেখে বলল–

“আরু, বোন আমার। কী হয়েছে আপুকে বল?

আরিশা ঝমঝমিয়ে কাঁদে। হেঁচকি তুলে তুলে কম্পিত গলায় সবটা বলে।
আরিশা যেখানে কোচিং ক্লাস করে সেখানে তাদের ম্যাথ টিচার প্রায়ই আরিশাকে অপদস্ত করে। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত লাগায়। আজও তা করেছে যা আরিশা সহ্য করতে পারেনি। ভয়ে কাউকে সে এ কথা বলেনি। তার বাবা পড়ালেখার বিষয়ে খুব কড়া। আয়েন্দ্রি বোনের মনস্তত্ত্বাত্তিক উচাটন শান্ত করতে আশ্বাস দেয় সে দেখবে এই ব্যাপারটা। এমনকি তার বাবার সাথেও কথা বলবে। প্রয়োজনে সেইখানে কোচিং করা বন্ধ।

সবটা শান্তভাবে শুনে নেয় নিষ্প্রাণ। নিরুদ্বেগ, নিরুত্তাপ। দরজার কপাট খুলে নিজের ঘরে ঢুকে সে। ঘুটঘুটে তমসাচ্ছন্ন কক্ষের কিছুই স্পষ্ট নয়। ভেতরে প্রবেশ করেই ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয় নিষ্প্রাণ। অন্ধকারে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে। হাঁটুর কাছে বিছানার অস্তিত্ব অনুভব হতেই নৈঃশব্দে বসে। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয় বিছানার পাটাতনে। নিকষকালো অন্ধকারময় ঘরে নিষ্প্রাণ তার নিজের উপস্থিতিও টের পাচ্ছে না। তার মানসলোকে প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কেন পৃথিবীর মানুষ এমন? কেন নারীদেহে তাদের এত লালসা? নারীর রক্তে এত কেন সুখ খুঁজে পায় মানুষ রূপী হায়েনারা? নারী কেন শুধু ভোগ্যবস্তু?

নিষ্প্রাণের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে নির্গত হয়–

“মা!

অন্ধকারে চোখ বুজে নেয় নিষ্প্রাণ। আচম্বিতে অমিলীত চোখে উঠে বসে। তার সামনেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আয়েন্দ্রি নয় সে। শুভ্র একদলা মেঘ যেন কৃষ্ণ কাদম্বিনীর মাঝে উঁকি দিচ্ছে। একজন মায়াবতী কামিনী। যার দু’চোখে অকৃত্রিম মায়া, প্রেম, স্নেহ।
তার হাতের তালুতে দন্ডায়মান সফেদ রঙের মোমের শিখায় জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। চমকিত গলায় বলে উঠে নিষ্প্রান—

“তারা! নয়নতারা! তুমি ফিরে এসেছো?

মেয়েটি উষ্ণ হাসল। বলল–

“কেমন আছিস নিষ্প্রাণ?

কালবিলম্ব না করে নয়নতারা অপার্থিব অবয়বটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে অপলক চেয়ে থাকে নিষ্প্রাণ। মেয়েটা একটুও বদলায়নি! এমন কী করে হয়!
নয়নতারা সশব্দে হেসে উঠে। খুশমেজাজে বলল—

“আয়েন্দ্রিকে খুব ভালোবাসিস তাই না?

জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ভেদ করে নিষ্প্রাণের উৎসুক চাহনি নয়নতারার সুশ্রি মুখচ্ছবিতে। আগুনের শিখার জ্বলজ্বলে প্রতিচ্ছবি নয়নতারার চোখে। সেদিকেই বদ্ধদৃষ্টি নিষ্প্রাণের। নয়নতারা বিগলিত হাসল। স্নেহাসিক্ত গলায় বলল—

“ওকে আগলে রাখিস। আমার মতো হারিয়ে যেতে দিস না নিষ্প্রাণ। ওরা তো আমাকে বাঁচতে দিল না। তুই তোর ধ্রুবতারাকে তোর বুকের ভেতরেই রাখিস।”

টলটল করে উঠে নয়নতারার চোখ। ভিজে উঠে তার গলা। নিষ্প্রাণ টিমটিমে গলায় বলল—

“ওকে আমি ভালোবাসি। আমার ধ্রুবতারা ও। ওকে হারাতে দেবো না আমি।”

বিমুগ্ধ হাসল নয়নতারা। নিষ্প্রাণ অপরাধী গলায় স্বীকারোক্তি দেয়।

“আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি তারা। আমাকে ক্ষমা করেছ তুমি?

নয়নতারা খিলখিলিয়ে হাসে। ভয়চকিত চোখে আঁতকে উঠে নিষ্প্রাণ। নয়নতারা মৃতপ্রায় গলায় বলল—

“এতে তোর দোষ নেই।আমি তো নয়নতারা। সময় শেষে ঝরে গেলাম। ও তোর ধ্রুবতারা। কালো আকাশে সবসময় জ্বলবে। তোকে আলো দিবে। আমি ওই দূর আকাশ থেকে তোদের মিলন দেখব।”

নিষ্প্রাণ আবেগী হয়। তার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
মৃদু গলায় রোষানলে জ্বলে বলল—

“আমি ওদের কাউকে বাঁচতে দেইনি তারা। ওদেরকে ওদের পাপের শাস্তি দিয়েছি। ছাই হয়ে গিয়েছে ওরা সব। যেই বদ্ধ ঘর তোমার আর্তনাদ শুনে কেঁদেছে সেই ঘরেই ওদের জীবন্ত সমাধি করেছি আমি। চিৎকার করে বাঁচতে চেয়েছে ওরা। আমি শুধু শুনেছি।”

বক্র হাসে নিষ্প্রাণ। চকচক করে উঠে নয়নতারার চোখ। চট করেই বলল—

“বিয়ে করবি আমায়?

ধপ করে নিভে যায় মোমবাতির শিখা। নিষ্প্রাণ অধৈর্য হয়ে পড়ে। আঁধার হাতড়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চেঁচিয়ে উঠে–

“তারা! তারা!

দৈবাৎ আলো জ্বলে উঠে। নয়নতারা যেখানটায় দাঁড়িয়েছিল সেখানে। কিন্তু নিষ্প্রাণ ভড়কে যায়। নয়নতারার পুরো দেহপিঞ্জর রঞ্জিত। কাতর চোখে চেয়ে আছে সে। ওই চোখে বাঁচার আর্তনাদ। ঠিক সেদিনকার মতো। আচমকা জ্বলে উঠে আগুন। নয়নতারাকে ঘিরে ফেলে আগুনের বলয়। তার তীব্র আভায় ছিটকে সরে আসে নিষ্প্রাণ। ঘামতে শুরু করে সে। আগুনের লেলিহান শিখার উত্তাপে তার শরীরের উষ্ণতা বাড়তে থাকে। জ্বলন শুরু হয় চামড়াতে। নিষ্প্রাণ হাত বাড়ায়। বাঁচাতে চায় নয়নতারাকে। নয়নতারা হাসছে। হেসেই যাচ্ছে। আগুন গিলে নেয় নয়নতারাকে। নিষ্প্রাণের মনে হলো কেউ তার কলিজা খামছে ধরেছে। পানিবিহীন মাছির মতো অবস্থা তার। চিৎকার দিয়ে উঠে নিষ্প্রাণ–

“তারা আআআআআআ!

বিছানা থেকে উঠে বসে নিষ্প্রাণ। তার শরীর ঘামে ভিজে জবুথবু। স্বগতোক্তি করে বলল—

“স্বপ্ন! স্বপ্ন! তারা! আমার ধ্রুবতারা!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here