প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ২৬

0
2107

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বসার ঘরে নিষ্প্রাণকে দেখেই ভ্রু কুঞ্চন করে আয়েন্দ্রি। নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়েই নিষ্প্রাণকে দেখতে পাবে তা আয়েন্দ্রির কল্পনাতীত। আয়েন্দ্রির দিকে তাকিয়েই মলিন হাসে নিষ্প্রাণ। আলফাজ সাহেব তখন খাওয়ার টেবিলে। আয়েন্দ্রির ভীত সরল দৃষ্টি তার গতিপথ পালটে আলফাজ সাহেবের গম্ভীর মুখে এসে থামে। আলফাজ সাহেব একবার মেয়ের দিকে কঠোর চোখে তাকালেন। তারপর!
তারপর কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই নিজের খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন। আয়েন্দ্রি ব্যাপারটা ধরতে পেরে ভয়চকিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে নিষ্প্রাণকে—-

“তুই এত সকালে! এইখানে?”

সরব দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ। প্রাণখোলা হেসে বলল—

“তোকে নিতে এলাম। আজ তো ইমপর্টেন্ট ক্লাস আছে।”

আয়েন্দ্রি অরবে ঢোক গিলে বাবার দিকে তাকাল। ঝুমা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে খাওয়ার টেবিলে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন—

“বসো বাবা। খেয়ে নাও।”

চট করে উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠে আয়েন্দ্রি–

“তুই না খেয়ে এসেছিস?”

নিষ্প্রাণ আলতো হেসে প্রত্যুক্তি করে বলল—

“বুয়া তো তখনও আসেনি। তাই খাওয়া হয়নি।”

ঝুমাকে চকিতে ডেকে উঠে নিষ্প্রাণ।

“মা! আমি কিন্তু পেট ভরেই খাব। না করতে পারবেন না।”

আয়েন্দ্রি ভরাট চোখে চেয়ে অবাক গলায় বলল—

“তুই মাকে কী বলে ডাকলি?”

নিষ্প্রাণ ঝরা গলায় বলল–

“মা। তোর মাকে আমিও মা ডাকব। আমার তো মা নেই। চাচি, মামি, খালা ডাকতে ইচ্ছে হলো না। তাই মা ডাকলাম। তবে আঙ্কলকে বাবা ডাকব না। স্যার ডাকব। তুই চাইলে বাংলায় জনাব বলেও ডাকতে পারি।”

ফিক করে হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ। ভয়ে আয়েন্দ্রির শরীর জমাট বেঁধে যাচ্ছে। আর এই ছেলে আছে তার ফাজলামো নিয়ে!

খেতে বসে নিষ্প্রাণ। সকাল ন’টা। ক্লাস শুরু হতে ঢের দেরি। আলফাজ সাহেব অফিসে চলে গেলেন। খাওয়া শেষ করে সোফায় বসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি প্রশ্নের ডালা নিয়ে বসে নিষ্প্রাণের সামনে।

“তুই বাসায় কেন এসেছিস?”

নিষ্প্রাণ সোজা উত্তর করে—

“তোকে দেখতে ইচ্ছে হলো তাই।”

হাসল নিষ্প্রাণ। বদ্ধ হাসি। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই দেখল প্রভাহীন আননের আরিশাকে। ব্যস্ত গলায় ডেকে ওঠে নিষ্প্রাণ—

“আরিশা!”

স্থির হয় আরিশা। চড়ুই পাখির মন ভালো নেই। কিচিরমিচির নেই প্রভঞ্জনে। শান্ত, স্থিমিত সে। বিষাদগ্রস্ত অন্ত:করণ। আরিশা তাকাল। কী কাতর চাহনি। নিষ্প্রাণ ধীর পায়ে আরিশার সামনে এসে দাঁড়ায়। কোমল হাসে। সংকীর্ণ গলায় বলল–

‘কেমন আছো আরিশা?”

আরিশা জোরপূর্বক হাসল। ম্লান গলায় বলল —

“ভালো।”

নিষ্প্রাণ মৃদু হাসল। বলল—

“চলো, আজ তোমাকে ভাইয়া আর আপু মিলে কোচিং এ দিয়ে আসব।”

আর্তনাদ করতে ইচ্ছে হলো আরিশার। কিন্তু সে করল না। নিষ্প্রভ চোখে বোনের দিকে তাকাল। ছোট্ট করে বলল—

“আমি যাব না।”

ঝুমা ভ্রু নাচিয়ে শাষিয়ে উঠলেন–

“কেন যাবি না? কী হয়েছে তোর? কী ঢং শুরু করছোস?”

চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইলো আরিশার। কিন্ত সে নিজেকে গোপন করল। মায়ের কথার তীর তার কানে বিঁধলেও সে জবাব দিলো না। হাঁটু ভেঙে আরিশার সামনে বসে নিষ্প্রাণ। তাতেও আরিশার কাঁধ পর্যন্ত উচ্চতা নিষ্প্রাণের। সে মুগ্ধ হাসল। স্নেহের সাথে আরিশার দুই হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিজের হাতের পিঠেই চুমু খেলো। যেন তা পৌঁছে যায় আরিশার ভাঙা মনে। চেয়ে রইলেন ঝুমা। নিমেষহীন আঁখিতে। ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করে নিষ্প্রাণ–

“কোন ফুল পছন্দ তোমার?”

নিষ্কম্প গলায় উত্তর দেয় আরিশা।

“গোলাপ।”

“গোলাপে কাঁটা কেন থাকে বলোতো?”

“জানি না।”

নিষ্প্রাণ শুধু আরিশার মনে যুঝতে থাকা সমস্যার ইতি ঘটাতে নিজের মত করে তার ব্যাখ্যা দিলো।

“গোলাপের কাঁটা তাকে দুষ্ট মানুষদের হাত থেকে বাঁচায়। কথায় বলে না, গোলাপ নিতে হলে কাঁটার আঘাত তো সইতেই হবে। তুমিও গোলাপের অনুরূপ। তোমার বাবা, মা, ভাইয়া, আপু এরা সবাই সে কাঁটা যা তোমাকে দুষ্ট মানুষদের হাত থেকে বাঁচাবে। বাগানে বেঁড়া কেন দেয় জানো? ছোট বাচ্চা আর পশুদের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য। মানুষকেও এই জন্যই পরিবার দেয়। পরিবার আমাদের জন্য সেই বেঁড়া। সমাজের প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে তারা আমাদের রক্ষা করবে। তাই আমাদের আপনজনদের ওপর ভরসা রাখতে হবে। রাখবে তো?”

ছোট্ট করে হাসে আরিশা। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—

“হুম।”

“গুড। আর মনে রাখবে, পৃথিবীতে যদি সমস্যা থাকে তাহলে তার সমাধানও আছে। আমাদের শুধু ঠান্ডা মাথায় সেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
যাও, তৈরি হয়ে এসো। উই আর গেটিং লেট।”

ক্ষণেই হেসে ফেলে আরিশা। তার মনে সুপ্ত সাহসের সঞ্চার হলো। কোচিং এ যাওয়ার জন্য ব্যস্ত ভঙ্গিতে তে কক্ষের দিকে ছুটে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিষ্প্রাণ। বিমুগ্ধচিত্তে নিষ্প্রাণকে দেখছিল ঝুমা। শুনছিল তার মুখ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ। আয়েন্দ্রিকে উদ্দেশ্য করে নিষ্প্রাণের কর্তৃত্বভরা আদেশ–

“তুই ও তৈরি হয়ে নে। আরিশাকে কোচিং এ দিয়েই সোজা ভার্সিটি যাব।”

দ্বিরূক্তি করলো না আয়েন্দ্রি। আরিশার জন্য এই সাহসটার প্রয়োজন ছিল। আয়েন্দ্রি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে তার বাবাকে জানাবে। খানিক অবাকও হলো সে। যদিও নিষ্প্রাণের কথাগুলো সরাসরি আরিশার সমস্যাকে ইঙ্গিত করে না। তবুও তার খটকা লাগল।নিষ্প্রাণ কেন এত সকালে আসলো? আরিশাকে কেন এইসব বলল?
,
,
,
রিক্সায় নিষ্প্রাণের পাশেই বসেছে আরিশা। মৃদু আলোড়নে কম্পিত হচ্ছে তার কোমল দেহ। বদন জুড়ে নির্লিপ্ততা। নিষ্প্রাণ সাহস যোগানের জন্য বলল–

“ভয় পেয়ো না।”

আরিশা ক্ষীণ সুরে বলল—

“আমার ভয় হচ্ছে।”

নিষ্প্রাণ বাঁকা হেসে বলল–

“ভয় পেলে থাক। আমি দেখে নেবো।”

আরিশা প্রতিবাদ করে বলল–

“না। আমি পারব।”

নিষ্প্রাণ ছোট্ট হাসল। নিরুত্তাপ গলায় বলল—

“সাবধানে থাকবে। তুমি কোনো কথা বলবে না। ভিডিয়ো এডিট করা যাবে না। তাহলে সবাই ফেইক ভাববে। তোমাকে যেন ভিডিয়োতে শো না করে। ওকে?

“হুম।”

নিষ্প্রাণ আরিশার ব্যাগে স্পাই ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আরিশা ভীতসন্ত্রস্ত। ভয় এখনই তার হাত, পা কম্পিত হচ্ছে।
,
,
,
আরিশাকে নিয়ে কোচিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ। সরব গলায় বলল–

“বি স্ট্রং। ভয় পেয়ো না। যাও ভেতরে।”

দ্বিরূক্তি করলো না আরিশা। আরিশা চলে যেতেই আয়েন্দ্রিকে নিয়ে হাঁটা ধরে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি দ্বিধান্বিত। তার ইচ্ছে হচ্ছে নিষ্প্রাণের সাথে ঘটনাটা শেয়ার করতে। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য দোটানায় সে পারছে না। মুহূর্তেই মোবাইলের রিং বেজে ওঠে নিষ্প্রাণের। রিসিভ করেই বিগলিত হাসে। ফুরফুরে মেজাজে বলল—

“ওয়েট করো। আমি আসছি।”

কল কেটে রহস্য হাসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে–

“কে কল করেছে?”

নিষ্প্রাণ একগাল হেসে বলল–

“তোর সতীন।”

খলখলিয়ে হেসে উঠল নিষ্প্রাণ।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here