প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ২৭

0
2279

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ক্যান্টিনে বসে আছে নিষ্প্রাণ । তার সামনেই শ্রেয়া । শুষ্ক দৃষ্টি তার । নিষ্প্রাণ ভাবান্তরহীন । তার দৃষ্টি সূদুর । যেখানটায় বসে আছে আয়েন্দ্রি । শ্রেয়া কন্ঠে কাঠিন্যতা নিয়ে বলল–

“ছেলেদুটোকে এভাবে মারলে কেন?”

নিষ্প্রাণ মোলায়েম গলায় প্রত্যুত্তর করে–

“ওরা সীমান্তের কি অবস্থা করেছে দেখোনি?”

“দেখেছি।”

শ্রেয়া থামল । নিষ্প্রাণের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল। বদ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির দিকে। তড়াক করে ওঠে শ্রেয়ার মস্তিষ্ক । শ্রেয়া চট করে ফিরে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে । খুসখুসে গলায় বলল–

“শুধু কী সীমান্তের গায়ে হাত দিয়েছিল বলে তুমি ওদের মেরেছো?”

নিষ্প্রাণ বিগলিত হাসল । চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ছোট্ট করে অধরের কোণ প্রশস্ত করল । ঝুঁকে এসে শ্রেয়ার কানের কাছে ঠান্ডা স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল—

“ও আমার ধ্রুবতারার গায়ে হাত দিয়েছে । তাই।”

অকস্মাৎ চোখের পল্লব কেঁপে ওঠে শ্রেয়ার।

শহীদ মিনারের সিঁড়ির উপর বসে আছে আয়েন্দ্রি । নিষ্প্রাণ তার কাছে এসেই ঝপ করে বসে পড়ে । আয়েন্দ্রির তটস্থ চাহনি। গলা ঝেড়ে নিষ্প্রাণ বলল–

“এভাবে তাকাস কেন?”

আয়েন্দ্রি চাহনি শিথিল করে বলল—

“কিছু না।”

নিষ্প্রাণ জিজ্ঞাসু গলায় বলল—

“প্রাবিশ কোথায়? ও তো এখানেই ছিল!

আয়েন্দ্রি স্বাভাবিক কন্ঠে বলল—

“বৌদি এসেছে । ওকে আনতে গেছে।”

নিষ্প্রাণ আদুরে চোখে চেয়ে বলল—

“আমার ব্যাপারে কী ভেবেছিস?

আয়েন্দ্রি চট করে ধরতে পারলো না নিষ্প্রাণের কথা । ক্ষণকাল পরে বুঝতে পেরে নিরেট গলায় বলল—

“সম্ভব নয় ।”

নিষ্প্রাণের ভ্রু যুগল ললাটের মধ্যখান বরাবর কুঞ্চিত হয় । চোখের আদুরে চাহনি অনুপলেই শক্ত হয়ে আসে । তবে কন্ঠ স্বাভাবিক রাখে । বলল—

“তুই আমাকে কথা দিয়েছিস ধ্রুবতারা । আমি তোর কথা রেখেছি । তোর বিশ্বাস না হলে শ্রেয়াকে ডেকে আনছি আমি ।”

আয়েন্দ্রি বিতৃষ্ণ চোখে তাকাল । অসহনীয় গলায় চোখ, মুখ বিকৃত করে বলল—

“তুই কেন বুজতে পারছিস না! বাবা মেনে নেবে না এই সম্পর্ক ।”

নিষ্প্রাণ তাচ্ছিল্য হেসে বলল–

“কেন? আমি অনাথ তাই!

আয়েন্দ্রির রাগ ফুটে উঠল চোখে, মুখে । কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল—

“হ্যাঁ, তাই । কোনো বাবাই তার মেয়েকে কোনো অনাথ ছেলের হাতে তুলে দেবে না । তার উপর তুই এখনো স্ট্যাডি করছিস! বাবা চাইলেই এখন আমার বিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সে ছেলে তুই হতে পারবি না ।”

নিষ্প্রাণ মায়াময় চোখে চেয়ে গভীর আবেশে আয়েন্দ্রির হাতটা নিজের হাতে নেয় । তার হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে বলল—

“তুই ভালোবাসিস তো আমাকে? তাহলে অন্তত দুটো বছর সময় দে আমাকে । আমি সবটা সামলে নেবো।”

আয়েন্দ্রি ভরাট চোখে চেয়ে কৌতূহলী গলায় বলল—

“কী করবি তুই?

“কিছু একটা তো করব । তোকে পাওয়ার জন্য যা করতে হয় করব । পারবি না দুটো বছর দিতে আমাকে?

আয়েন্দ্রি ছোট্ট শ্বাস ফেলে । একটু ধাতস্থ হয়ে বলল–

“হুম।”

“মায়ের সাথে আমি কথা বলব?”

“না। দরকার নেই । আমি মাকে বলব ।”

“ও কে ।”

আয়েন্দ্রির আঁখিপুট প্রসারিত হয় দূরের দৃশ্য অবলোকন করে । তার চোখের চাহনির তারতম্য দৃষ্টিগোচর হতেই সেইদিকে তাকায় নিষ্প্রাণ । একটা শুভ্র জামদানী পড়েছে জাহ্নবী । বাদামি রঙের রেশমি চুলগুলো খেলছে তার কাঁধে । যার বেশকিছু ছড়িয়ে আছে বাম চোখের উপর । দুধে আলতা রঙ যেন প্রভাকরের দীপ্ত কিরণে আরও উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিচ্ছে । গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে জাহ্নবী । মেয়েটাকে স্বশরীরে কখনো দেখেনি আয়েন্দ্রি । আজ দেখে মনে হলো পদ্মাসন থেকে নেমে এসেছি দেবী । চোখে পুরু কাজলের টান । ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী রঙের লিপস্টিক । আয়েন্দ্রি ঢোক গিলল । এত সুন্দরও মানুষ হয়!

আয়েন্দ্রি ফর্সা হলেও ততটা উজ্জ্বল নয় তার গায়ের রঙ । যেন নিভে যাওয়া মোমবাতি। চকিতে নিষ্প্রাণের দিকে তাকায় সে । নিষ্প্রাণের চোখে ততটা জৌলুস নেই যতটা সে আশা করেছিল । স্বাভাবিক চাহনি । সামনে এসে দাঁড়ায় প্রাবিশ আর জাহ্নবী । ঠোঁট ভরা হাসে জাহ্নবী । কী সুন্দর হাসে মেয়েটা! আয়েন্দ্রির মন নেচে ওঠে । নির্মল গলায় বলে উঠে জাহ্নবী—

“আয়েন্দ্রি? রাইট?

আয়েন্দ্রি অধর বিস্তৃত করে হাসল । নীরব সম্মতি দিলো । নিষ্প্রাণের দিকে তাকিয়ে সময় নিলো না জাহ্নবী । চট করেই বলল—

“নিষ্প্রাণ?”

“হুম ।”

আয়েন্দ্রি ভরাট চোখে তাকায় । সাদা মোম যেন রোদের তাপে গলে যাবে! বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে জাহ্নবীর চিবুকের গাঁথুনিতে । আয়েন্দ্রি সরব গলায় বলল—

“কেমন আছো বৌদি?”

লজ্জামিশ্রিত হাসল জাহ্নবী । প্রাবিশের দিকে নাজুক চোখে তাকিয়ে বলল—

“ভালো । তোমরা কেমন আছো?”

“ভালো।
হঠাৎ কী মনে করে?”

আয়েন্দ্রির করা প্রশ্নে মুখ খুলল প্রাবিশ । সরস গলায় বলল—

“একটা স্কুলে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল । তাই দেখা করতে এসেছে।”

“ও আচ্ছা ।”

জাহ্নবী খেয়াল করল নিষ্প্রাণ কোনো কথা বলছে না । নিজ থেকেই আগ্রহ নিয়ে বলল—

“আর ইউ টেনসড নিষ্প্রাণ?”

নিষ্প্রাণ অপ্রস্তুত হয় । তার মনে পড়ে আরিশার কথা । মেয়েটা পারবে তো!
স্বাভাবিক চোখে চেয়ে বলল—

“আই এম ফাইন ।”

জাহ্নবী স্বত:স্ফূর্ত হাসল । মুক্ত গলায় বলল—

“বাকিরা কোথায়?”

“আমাকেই খুঁজছিলে বুঝি?”

কুসুমের মিষ্টি গলায় বন্ধু মহলে খুশির জোয়ার আসে । তবে তার ধারাবাহিকতা টিকে না সীমান্তের জন্য । জাহ্নবী তাদের কোথাও বসে আড্ডা দেওয়ার প্রস্তাব রাখে । কিন্তু সীমান্তকে ছাড়া সব পানসে । তাই আপত্তি করল সবাই । জাহ্নবীকে পৌঁছে দেওয়ার নিমিত্তে ভার্সিটি প্রাঙ্গন ছাড়ে প্রাবিশ । কুসুম টগবগিয়ে বলল—

“মেয়েটা কিন্তু দারুণ! যদিও প্রাবিশ থেকে বছর তিনেকের বড়ো তবুও দু’জনকে দারুন মানিয়েছে ।”

“হুম ।”

কুসুম হঠাৎ করে বলে উঠে—

“কিরে নিষ্প্রাইন্না! এমন চিতল মাছের মতো ভ্যাটকাইয়া আছোস ক্যান?”

ফিক করে হেসে ফেলে আয়েন্দ্রি । নরম হাসে নিষ্প্রাণ। চোখে সরলতা এনে আয়েন্দ্রিকে বলল—

“আমি মসজিদে গেলাম । তোকে বাসায় পৌঁছে দেবো আমি। একা যাবি না ।”

আয়েন্দ্রি চোখের ইশায়ার তাকে আশ্বস্ত করল । নিষ্প্রাণ যেতেই সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় কুসুম । ফিচেল হেসে বলল—

“কী চলছে রে তোদের দুইজনের মধ্যে?

“টেম্পু চলছে । তুই উঠবি?

কলহাস্যে বাতাস কাঁপিয়ে তোলে দুই বান্ধবী ।
,
,
,
তমসার চাদোয়া বিছানো বদ্ধ কক্ষে শুয়ে আছে নিষ্প্রাণ । অন্ধকার আচ্ছন্ন কক্ষে তার এলোমেলো দৃষ্টি । পা দুটো শান্ত ভঙ্গিতে দুলছে বিছানার পাটাতনের বাইরে । আয়েন্দ্রিকে পৌঁছে দিয়ে আসে তার বাড়িতে । কায়দা করে সুযোগ বুঝে আরিশার কাছ থেকে স্পাই ক্যামেরা আর তার কোচিং এর কিছু সহপাঠীদের বাবা,মায়ের নাম্বার নিয়ে আসে । নতুন সিম কিনে তা অন করে। আরিশার সহপাঠীদের মধ্যে যাদের বাবা, মা ওয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন তাদের নাম্বারে সেই ভিডিয়ো সেন্ট করে সিম ড্রেসট্রয় করে ফেলে । বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতিতে তার আঙুলের ছাপ মেলানো যাবে না । তার ব্যবস্থাও নিষ্প্রাণ করেছে ।

ভিডিয়ো তে শুধু ম্যাথ টিচার অলিকের মুখ আর কন্ঠই সবার দৃষ্টিগোচর হবে । নিষ্প্রাণের কথা মতো আরিশা কোনো কথা বলেনি ।
আবেশিত গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“জানো নয়নতারা, ওকে আমি নিজেই মারতাম । কিন্তু সময় নেই হাতে । দাদু ডেকেছে আমাকে । যেতে হবে আমায়।”

নিষ্প্রাণের পায়ের কাছে বসা নয়নতারার অপার্থিব অবয়বটি হেসে ওঠে । যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই । যাকে নিষ্প্রাণ তার দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখে । কল্পনা করে তার অবচেতন মনে ।

নয়নতারা মৃদু হাসল । ঝলমলে গলায় বলল—

“বড়ো দাদু বুঝি তোকে শাস্তি দিবে?”

নিষ্প্রাণ উঠে বসে । চকচকে চোখে চেয়ে দেখল মৃদুহাস্য অধরের নয়নতারাকে । তার হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি । সেই মোমবাতির অগ্নিশিখায় নয়নতারাকে পূর্ণ নজরে দেখে নিষ্প্রাণ । তাচ্ছিল্য হাসল সে । মুক্ত গলায় বলল—

“প্রিন্সিপ্যাল আমাকে ভার্সিটি থেকে কেন বের করেনি জানো?
দাদু মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ভর্তি করিয়েছে আমাকে । দাদু বলে আমি না কি অসুস্থ! আমি অসুস্থ নই তারা । আমি শুধু ওদের শাস্তি দিয়েছি ।”

নিষ্প্রাণ দরজার দিকে তাকায় । মোমবাতির আলোয় খুব অল্প পরিমাণে তা দৃশ্যত । ছোট্ট শ্বাস ফেলে সে । মোমবাতির শিখার দিকে মলিন চাহনি নয়নতারার । মৌনতা ভেঙে নিষ্প্রাণ বলল—

“আমার মাকে ওরা খুব কষ্ট দিয়েছে তাই না? আমি একটা দিনের জন্যও আমার মাকে কাছে পাইনি ।”

থামল নিষ্প্রাণ । জমে এলো তার গলা। জমাট গলায় ফের বলল—

“ভালোই হয়েছে মরে গিয়েছে, নাহলে আমিই মেরে ফেলতাম । নিজের হাতে মারতাম । ওই যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া ভালো । তোমাকেও পারিনি বাঁচাতে। তুমিও মরে গেলে । তাই ওদেরকেও আমি তোমাদের কাছে পাঠিয়েছি। ভালো করেছি না?”

নিষ্প্রাণ দাম্ভিক চোখে তাকাল নয়নতারার দিকে। ধপ করে মোমবাতির শিখা নিভে যেতেই অট্টহাসিতে রুদ্ধ সমীরণে ঝড় তোলে নয়নতারা ।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here