প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৩২

0
2069

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

এক ঝাঁক মরা কাক দেখার মতো অভিজ্ঞতা হলো আয়েন্দ্রির। মাঠভরা ছেলেমেয়ের সামনে অভব্য ভাষায় কথা শোনাল শ্রেয়া। অমসৃন কন্ঠে শাসিয়ে তাকে মনের ক্ষোভ নিঃসৃত করল। আয়েন্দ্রির ভেজা আঁখিপল্লব নিগূঢ়ভাবে ওঠানামা করছে। তার অগোচরেই টুপটুপ করে পড়ছে শীতল জল। শ্রেয়ার বজ্র কন্ঠ—

“এতই যখন ওর গলায় ঝুলতে ইচ্ছে হলো তাহলে মাঝখানে আমাকে কেন টানলে? লজ্জা করছে না তোমার?”

আয়েন্দ্রি অশ্রুসজল চোখে চেয়ে আছে। তার কথা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে তার স্বরনালীতে। ভেজা গলায় বলল—

“আমার কথা শোনো শ্রেয়া।”

“কী শুনব? কেন শুনব? তুমি আসলেই একটা…।”

অজানা কেউ মুখ চেপে ধরে শ্রেয়ার। লাল দুই চোখে পানি জমেছে তার। ঘার ফিরিয়ে মানুষটাকে দেখে হকচকিয়ে যায় শ্রেয়া। নিষ্প্রাণ!

নিষ্প্রাণ আরেক হাত দিয়ে আয়েন্দ্রির হাত চেপে ধরে। সরল দৃষ্টিতে চেয়ে বলল—

“কান্না বন্ধ কর্।”

জোর করে কান্না বন্ধ করার দরুন স্বরনালী থেমে থেমে কম্পিত হচ্ছে আয়েন্দ্রির। শ্রেয়ার মুখ থেকে হাত সরায় নিষ্প্রাণ। দুর্বোধ্য গলায় বলল—

“তোমার আমার মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি যার জন্য ধ্রুবতারার দিকে আঙুল উঠাবে তুমি। মাইন্ড ইট।”

শ্রেয়া রাগে ফেটে পড়ে বলল—

“তাহলে কী ছিল ওইসব?”

নিষ্প্রাণ অকপট হাসল। রহস্যচ্ছলে বলল—

“ইটস আ প্র্যাঙ্ক! চল্ ধ্রুবতারা।”

রাগে গজরাতে থাকে শ্রেয়া। চোখ দিয়ে অগ্নিনালা বেরোচ্ছে। ঝনঝন করছে তার কলেবর।
,
,
,
শহিদমিনারের সিঁড়িতে বসে আছে আয়েন্দ্রি। কোনোরকম ভাবাবেগ ছাড়াই আয়েন্দ্রির দিকে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির নিটোল নেত্রযুগল দিয়ে শ্লথ ধারায় স্বচ্ছ, শীতল, নোনতা জলের নহর গড়াচ্ছে। নিষ্প্রাণ চোরা হাসল। মেয়েটা এত কাঁদে কেন? তার নয়নতারা কখনো কাঁদতো না!
নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। অপ্রত্যাশিত কাজ করল। দুই হাতে আয়েন্দ্রির চোখের জল মুছে দিলো। আঁজলাতে মুখ টা নিয়ে ঘুরিয়ে তার দিকে ফেরালো। ডাসা ডাসা, চঞ্চল দুই চোখে নিষ্প্রভ। নিষ্প্রাণ মোলায়েম গলায় বলল—

“কাঁদিস না। ভালো লাগছে না আমার।”

আয়েন্দ্রি আলগোছে নিষ্প্রাণের হাত সরায়। চিন্তিত মুখটা নিচু করে। অপরাধবোধ ঘিরে ধরে তাকে। নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকে। ওড়নার কোণা নিয়ে আঙুলে পেচাতে থাকে। নিষ্প্রাণের অনাড়ম্বর দৃষ্টি। আয়েন্দ্রি অনুতপ্ত গলায় বলল—

“সরি।”

নিষ্প্রাণ টিমটিমে গলায় বলল—

“এখন সরি বলছিস কেন? কে বলেছিল তোকে পাকনামি করতে?”

আয়েন্দ্রি ঠোঁট ফুলিয়ে নিষ্প্রাণের দিকে তাকায়। গাঢ় দৃষ্টি। অপ্রকট অনুভূতি। সপ্রতিভ বাসনা। নিষ্প্রাণ আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসে আয়েন্দ্রির। আয়েন্দ্রির লজ্জা হয় না। ভালো লাগে তার। নিষ্প্রান তার হালকা ভর আয়েন্দ্রির কাঁদের দিকে হেলিয়ে দেয়। রহস্য হাসে!

চিত্রভানু আজ লজ্জিত। লুকোতে চায় নীলাভ কাদম্বিনীর আড়ালে। লুকোচুরি হাসি তার। আচমকা দাপিয়ে উঠে, পূনরায় নুইয়ে যায়। প্রভঞ্জনে নেই তপ্ততা। মৃদু শীতলতায় কাতর সে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে সে সর্বাঙ্গের রোম!

নিষ্প্রাণ চাপা সুরে কানের কাছে বলল—

“বিয়ের পর এসব কান্না টান্না চলবে না। যা কান্নাকাটি করার বিয়ের আগেই করে নে।”

আয়েন্দ্রি চোখের পাতা সংকোচন করে। ব্যস্ত হয়ে বলল—

“কেন?”

“কান্নাকাটি ভালো লাগে না আমার। তাই।”

বিগলিত হাসে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের চশমার গ্লাসে নিজের মুখটা দেখতে পায়। কাঁচ ভেদ করে ওই দুই ভরাট চোখে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রি। গভীর, শান্ত দুই চোখ। এক নিমিষেই কুহেলিকায় আচ্ছন্ন করে আয়েন্দ্রিকে! আয়েন্দ্রির ধ্যাণ ভাঙে কুসুমের সরস গলায়—

“কীরে কবুতরের জোড়া! জায়গা তো আরো আছে। এমন সেঁটে বসে আছিস কেন?”

আয়েন্দ্রি লজ্জামিশ্রিত হাসে। সীমান্তের কার্বন কপি এসেছে। যেন সীমান্তের অপূর্ণতা পূরণ করতে কুসুমের এই নতুন রূপ!

জবাব দিলো নিষ্প্রাণ।

“কেন? হিংসে হয় তোর?”

কুসুম তরল মেজাজ দেখিয়ে বলল—

“হিংসে হবে কেন? বিয়ের আগেই লটর-পটর করা এই তোগো প্রেমিক যুগলের কাম!”

“লটর-পটর আবার কী?”

কুসুম হার মেনে বলল—

“জানি নাতো। কাল যখন সীমান্তের সাথে কথা বললাম, ও বলল তোদের দুই জনের মধ্যে না-কি লটর-পটর চলে! তাই বললাম।”

ছোট্ট করে হাসে নিষ্প্রাণ। উঠে দাঁড়ায় সে। স্বাভাবিক গলায় বলল—

“আমি গেলাম। যাবি না কোথাও।”

নিষ্প্রাণ যেতেই ঝুপ করে আয়েন্দ্রির পাশে বসে কুসুম। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল—

“এই ফেসে গেছে নিষ্প্রাণ তাহলে?”

আয়েন্দ্রি ব্রীড়িত! অবনত শিয়রে অস্পষ্ট সুরে বলল—

“হুম।”

কুসুম এক আকাশ উচ্ছলতা নিয়ে তীরের বেগে প্রশ্ন ছুড়ে—

“আঙ্কল মেনে নিয়েছে সব?”

“প্রাণ কথা বলেছে বাবার সাথে। তেমন কিছু বলেনি। তবে মেনে নেবে মনে হচ্ছে।”

উল্লাসিত গলায় হৈ হৈ করে ওঠে কুসুম।

“ইশ! কবে হবে তোদের বিয়ে? নিষ্প্রাণ হাঁদারামটাকে বরবেশে দেখার অনেক শখ আমার!
এই, আগে বলতো ওই গুঁমড়ো মুখো চিতল মাছটাকে তুই পটালি কী করে?
আরে চশমা পড়তো মনে হয় যেন মানুষ না চোখে পড়ে ওর! তুই ভেবে দেখেছিস! দেড় বছর একই ডিপার্টমেন্টে থেকেও ও তোকে কখনো দেখেইনি। ভাবা যায়!”

কুসুমের কথায় অলক্ষিত হাসে আয়েন্দ্রি।
,
,
,
আয়েন্দ্রির মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিপাত নিষ্প্রাণের। উঁহু! মুখ নয়। আয়েন্দ্রির ঠোঁট। তার ওই গোলাপের পাঁপড়ির মতো নরম ওষ্ঠাধর প্রতিক্ষণে ঘায়েল করে নিষ্প্রাণকে! আর ওই লাল তিল!
উফ! যেন এখনই নিষ্প্রাণের সর্বস্ব গ্রাস করে নেবে!

সুপের কিছু অংশ লেগে আছে আয়েন্দ্রির ঠোঁটে। টিশু দিয়ে তা মুছে নেয় আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের সুক্ষ্ম দৃষ্টির কারণ জানার জন্য প্রশ্ন করে—

“কী দেখছিস এভাবে?”

নিষ্প্রাণ শীতল গলায় বলল—

“তোর ঠোঁট।”

বৃহৎ ঢোক গিলে আয়েন্দ্রি। আশেপাশে সন্ধিৎসু চোখে তাকায়। বড় নিঃশ্বাস ফেলে অপ্রতিভ গলায় বলল—

“বাজে কথা বলিস কেন তুই?”

“সত্য বলেছি। তোর ঠোঁট যে আমাকে পিপাসার্ত করে। এই তৃষ্ণা আমি কী করে মিটাই?”

আয়েন্দ্রি ব্যস্তসমস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে। নিষ্প্রাণের হাত ধরে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসে। পিচডালা সড়ক পথের ফুটপাত দিয়ে নির্বিঘ্নে হাঁটছে দুজন। দৈবাৎ বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“রিকশা নে।”

“কেন?”

“আমি বলেছি তাই।”

দ্বিরূক্তি করল না নিষ্প্রাণ। রিকশায় পাশাপাশি বসতেই নিষ্প্রাণের এক হাত জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আয়েন্দ্রি। উত্তরোত্তর তার হৃদপ্রকোষ্টে উত্তাল, অসহ, দুর্বার ঢেউ খেলে যাচ্ছে। নিষ্প্রাণের হৃদস্পন্দন অনুরণিত করছে আয়েন্দ্রির দেহযষ্টি। তিরতির করে কাঁপছে তার ঠোঁট। আয়েন্দ্রি ভীত হয়! শঙ্কিত হয়!
এমনতো আগে কখনো হয়নি। নিষ্প্রাণ অতি মাত্রায় স্বাভাবিক। চলন্ত রিকশার সাথে মৃদু প্রভঞ্জন যেন তার উদ্দাম ফিরে পেয়েছে। নিষ্প্রাণের ঘন চুল উলুথুলু। হাতে চাপ লাগতেই আয়েন্দ্রির দিকে তাকায়। পেলব গলায় বলল—

“কী হয়েছে?”

আয়েন্দ্রি আড়চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো। কিছু হয়নি বুঝিয়েছে সে। গূঢ় হাসে নিষ্প্রাণ। মাথাটা হেলিয়ে আয়েন্দ্রির মাথার সাথে ঠেস দেয়। আদুরে গলায় বলল—

“বিয়েটা হতে দে। তার আগে আমায় কলঙ্কিত করিস না!”

আয়েন্দ্রি লজ্জায় সিদিয়ে যায়। বদ্ধ অনুভূতিতে তার মরমর প্রাণ। যার স্পন্দন বয়ে বেড়াচ্ছে এই প্রাণহীন মানুষটা।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here