#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
নতুই জামাইয়ের আপ্যয়নে কমতি রাখলেন না ঝুমা বেগম।টেবিল ভর্তি খাবার সাজানো।ইলিশ মাছের দোঁপেয়াজা,আঁচারি গরুর মাংস,মুরগির রোষ্ট,সবজি,ডাল আরো নানারকম খাবার।মিষ্টান্ন হিসেবে দইয়ের সাথে পায়েশও করলেন তিনি।একাই খাচ্ছে নিষ্প্রাণ।তার পাশেই অনুগত সহচারীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আয়েন্দ্রি।কাউচে বসে আছেন আলফাজ সাহেব।নিষ্প্রাণকে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আরাজ।আরিশা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।ঝুমা বেগম রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে দেখছেন সব।
তৃপ্তিকর কন্ঠে বলে উঠে নিষ্প্রাণ—
“সত্যি মা,আপনার হাতে জাদু আছে বলতে হয়।এতো ভালো তো ধ্রুবতারাও রান্না করতে পারে না।ওই যে আপনার মনে আছে? প্রথম বার যখন আপনাদের বাসায় এসেছিলাম,ধ্রুবতারা নুডলস রান্না করে খাইয়েছিলো।কী বিশ্রি স্বাদ ছিলো!
ঝুমা বেগম ম্লান হাসলেন।নিষ্প্রাণ পাশে থাকা আয়েন্দ্রির দিকে তাকিয়ে আহত গলায় বললো—
“এখন নিশ্চয়ই ভালো রান্না করতে পারিস?বিয়ে বসতে চেয়েছিলি তো।ও তো আর তোকে আমার মতো ভালোবাসে না।যে তোর হাতে ওই অখাদ্য বিনা দ্বিধায় অমৃত মনে করে খেয়ে নিবে।”
আয়ন্দ্রি ঝাপসা চোখে মায়ের দিকে তাকালো।ফ্যাকাশে সে চাহনি।ঝুমা বেগম মুখে কাপড় গুঁজে চৌকাঠ থেকে সরে আসলেন।খাওয়া শেষে আলফাজ সাহেবের সাথে ড্রয়িং রুমেই বসে নিষ্প্রাণ।ঝুমা বেগম সুযোগ বুঝে আয়েন্দ্রিকে কক্ষের ভেতর নিয়ে আসলেন।ব্যস্ত হয়ে বললেন—
“দেখ আয়ু,ভয় পাস না তুই।ওই ছেলেটাকে কোনোমতে ঘুম পাড়িয়ে দে।তোর বাবা আর আমি থানায় যাবো।আরিশা আর আরাজ কে তোর মামা বাড়ি পাঠিয়ে দিবো।ওকে জেলে পুরে দিলে তোকে নিয়ে আমরাও এই শহর ছেড়ে চলে যাবো।ও আর কখনো তোকে খুঁজে পাবে না।”
হঠাৎ করেই চিনচিনে ব্যথা হয় আয়েন্দ্রির কলিজায়।কার কাছ থেকে পালাবে সে?বিছানায় ধুপ করে বসে আয়েন্দ্রি।নৈঃশব্দের ক্রন্দনে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ জল।বিতৃষ্ণা গলায় বুক ভরা কষ্ট নিয়ে বললো—
“কার থেকে পালাবো বলতে পারো?কোথায় পালাবো মা আমরা?তুমি কী জানো,বাবা যে ছেলেটাকে এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে।ওই যে শিমুল।ও নিষ্প্রাণের লোক।আরাজকে যে লোকটা সিটি কলেজে ভর্তি করাতে সাহায্য করেছে ও নিষ্প্রাণের লোক।আরিশার ডান্স ক্লাবে যে ছেলে ওকে টিজ করেছিলো ওর হাত পা ভেঙেছে নিষ্প্রাণের লোক।এইবার বলো কোথায় পালাবো আমি?সারককে উঠিয়ে নিয়ে গেছে নিষ্প্রাণ।সারারাত ওকে টর্চার করেছে।ওর অপরাধ ও আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে।বলো মা,কী করবো আমি?
ঝুমা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।ঝরঝর করে কাঁদছে আয়েন্দ্রি।মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখে।ঝুমা বেগম ঝড়ের বেগে বললেন—-
“যত কিছুই করুক ওই অসুস্থ ছেলের সাথে আমি তোকে ছাড়তে পারি না।”
হেঁচকি উঠে যায় আয়েন্দ্রির।বললো—-
“দোষ তো আমারই মা।ওই নিষ্প্রাণকে প্রাণ আমি বানিয়েছি।আমিই ওকে আমার জীবনে জায়গা দিয়েছি।যদি আমি জানতাম ও আমার জীবনের ধ্বংসাত্মক পুরুষ ওকে আমি কখনো আমার জীবনে জায়গা দিতাম না।দিতাম না মা,দিতাম না।”
“ধ্রুবতারা।”
নিষ্প্রাণের ভারী কন্ঠে কান্না গিলে নেয় আয়েন্দ্রি।মাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।অত্যন্ত দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সাথে দুই জনের সামনে এসে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।নিষ্প্রাণের চোখের দিকে তাকিয়ে কলিজা কেঁপে উঠলো ঝুমা বেগমের।নিষ্প্রাণ ঝরা হাসলো।বললো—
“মা,কী করছেন বলেন তো!এইভাবে কেউ জামাইয়ের খোঁজ নেয়?
আয়েন্দ্রি কথা বাড়াতে চাইলো না।শক্ত কন্ঠে বললো—
“তুমি যাও মা।”
ঝুমা বেগম আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলেন।চলে যেতেই প্রশ্বস্ত গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—-
“শাশুড়ি মা,দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে যান।এন্ড ডোন্ট ডিস্টার্ব আছ।”
আয়েন্দ্রির সামনে এসে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি চোখ লুকোচ্ছে।কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে নিষ্প্রাণ—-
“কী বলছিলি তুই মাকে?
আয়েন্দ্রি চুপ করে রইলো।অতিষ্ঠ নিষ্প্রাণ জোর হাতে ধাক্কা মারে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রি অতর্কিত ধাক্কা সামলাতে না পেরে বিছানায় পড়ে যেতেই তার উপর ঝুঁকে যায় নিষ্প্রাণ।রোষানলে জ্বলে বললো—-
“তোকে না বলেছি রাগাবি না আমায়।কেন করিস এমন?
আয়েন্দ্রি শান্ত কন্ঠে বললো—
“প্রাণ,এইটা আমাদের বাড়ি।”
শ্লেষাত্মক হেসে বললো নিষ্প্রাণ—
“কিন্তু তুই তো আমার।”
,
,
,
আয়েন্দ্রির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে নিষ্প্রাণ।তার মন্ত্রমুগ্ধ চাহনি আয়েন্দ্রির মুখে।নিজের আঙুলে আয়েন্দ্রির ভেজা চুল মুড়িয়ে খেলছে।আয়েন্দ্রি নিরুত্তাপ।দরজায় দাঁড়িয়ে সংকীর্ণ গলায় অনুমতির আহ্বান করে আরিশা–
“ভেতরে আসবো?
আয়েন্দ্রির মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকায় নিষ্প্রাণ।আরিশাকে দেখে প্রফুল্ল হেসে বললো–
“কাম,কাম আরিশা।”
আরিশা গুটিগুটি পায়ে ভেতরে এসে দাঁড়ায়।অপ্রস্তুত হয় আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ এখনো আয়েন্দ্রির ভেজা চুল নিয়ে খেলছে।আরিশা অদ্ভুত দৃষ্টিতে বোনকে দেখে।হাঁটু অবধি ফ্রক পরা আরিশা ঘটনার গম্ভীরতা আঁচ করতে পারলো না।সে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো—
“আপু,সারক ভাইয়ার বাবা এসেছে।তোমাকে ডাকছে।”
নিষ্প্রাণ চুলের ডগা সোজা করে নাকের নিচে খাঁজটাতে ধরে নির্বিঘ্ন গলায় বললো—
“আরিশা!
বলোতো মোচ রাখলে আমাকে কেমন লাগবে?
আরিশা ভয়ে ভয়ে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে।যেদিন নিষ্প্রাণকে জেলে নিয়ে যায় পুলিশ সেদিন কিছু বুঝতে না পারলেও আয়েন্দ্রির পাগলের মতো কর্মকান্ড দেখে এতোটুকু বুঝতে পেরেছে এই ছেলে ভয়ংকর কিছু করেছে তার বোনের সাথে।আরিশা কোনো জবাব দিলো না।নিষ্প্রাণ আরিশার দিকে নজর ক্ষেপণ করে।চোখের ইশারায় আরিশাকে ডাকতেই আরিশা দ্বিধাগ্রস্তের মতো মেপে মেপে পা ফেলে এগিয়ে আসে।
নিষ্প্রাণ উজ্জ্বল হাসে।পকেটে হাত দিয়ে একটা প্যান্ডেন্ট বের করে আরিশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—
“এইটা তোমার জন্য।নাও।”
আরিশা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।নিষ্প্রাণ কন্ঠে গভীরতা টেনে বললো–
“নাও।শালি হিসেবে নয়।বোন হিসেবে দিলাম তোমাকে।আমার একটা কাজিন ছিলো।বেঁচে থাকলে হয়তো তোমার সমানই থাকতো।”
আরিশা টিমটিমে চোখে বোনের দিকে তাকায়।আয়েন্দ্রি অনমনীয় গলায় বললো—
“নিয়ে নে।”
বোনের কথা শুনে দেরি করলো না আয়েন্দ্রি।প্যান্ডেন্টটা নিয়েই পা বাড়ায় দরজার দিকে।নিষ্প্রাণ ভরাট গলায় সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বললো—-
“প্যান্ডেটটা ফেলে দিওনা আরিশা।তাহলে কিন্তু ভাইয়া খুব রাগ করবো।”
একটা ভয়ংকর ঢোক গিলে দ্রুত বেরিয়ে যায় আরিশা।নিষ্প্রাণ উঠে বসে।গায়ে দেওয়া কালো শার্টটা ঠিক করতেই আয়েন্দ্রি ভয়াতুর গলায় প্রশ্ন করে—
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?
অনুদ্বেগ হাসে নিষ্প্রাণ।হৃষ্ট গলায় বললো–
“তোর না হওয়া হবু শশুরের সাথে দেখা করতে।”
আয়েন্দ্রির কিছু একটা হলো।দ্রুত গিয়ে নিষ্প্রাণের শার্ট খাঁমচে ধরে বললো—
“কোনো পাগলামি করবি না তুই।”
আয়েন্দ্রির দুই হাত আলতো করে ছাড়িয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বললো—
“করবো না।প্রমিজ।বললাম না আমি ভালো হয়ে গেছি।কিচ্ছু করবো না আমি।”
তবুও যেনো ভয় কমলো না আয়েন্দ্রির।বসার ঘরে সারকের বাবার একদম সামনেই বসলো নিষ্প্রাণ।ভদ্রলোক চশমার ফাঁক গলিয়ে নিষ্প্রাণকে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন।দ্বিধান্বিত গলায় বললেন—
“তুমি?
নিষ্প্রাণ ভুবন ভোলানো হাসলো।বললো—
“আয়েন্দ্রির স্বামী।কাল রাতেই আমাদের বিয়ে হয়েছে।আমরা দুই জন দুই জনকে ভালোবাসি।সরি।ওর চেয়ে আমি ওকে বেশি ভালোবাসি।”
ভদ্রলোক ভীষণভাবে চমকালেন।কাল রাতেই যার হবু স্বামীকে কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলো সেই মেয়ে সেদিন বিয়েও করে ফেললো!
কেমন অদ্ভুত লাগলো বিষয়টা ভদ্রলোকের কাছে।নিষ্প্রাণ ব্যপারটা সহজ করার জন্য বললো—
“স্যার এখন কেমন আছেন?
ও আপনি আমাকে হয়তো চেনেন না।স্যার আমর খুব পছন্দের শিক্ষক ছিলেন।আমি স্যারের ভার্সিটিতেই পড়তাম।স্যারের সাথে যা হয়েছে তা একদম ঠিক হয়নি।চিন্তা করবেন না।আর এই বিয়েটা আমি করেছি।আমার শশুড়বাবার এতে কোনো হাত নেই।আপনি স্যারকে আমার নামটা বলবেন।স্যার বুঝে যাবে।আমার নাম নিষ্প্রাণ মুনতাসির।ব্যাচ দুই হাজার পনেরো।কেমেস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট।”
ভদ্রলোক অবিশ্বাস্য নজরে শ্রবণ করলেন পুরো কথা।কিন্ত হকচকিয়ে বললেন—
“তুমি কী করে জানো সারকের কথা?
নিষ্প্রাণ মোলায়েম হেসে বললো—
“আরিশা বলেছে।”
আরিশা ভড়কে যায়।সে তো ভেতরে গিয়ে কিছু বলেনি।ভদ্রলোক একরাশ প্রশ্ন নিয়ে চলে গেলেন।শুধু নামটা মনে রাখলেন।নিষ্প্রাণ উঠে দাঁড়ায়।ঝুমা বেগমকে সালাম করে বললো—
“আসি মা।”
ঝুমা বেগম আয়েন্দ্রির চুপসে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে মিইয়ে গলায় বললো—
“আয়ু না হয় আজ রাত এখানেই থাক।তুমি ওকে কাল নিয়ে যেও।”
মুচকি হাসলো নিষ্প্রাণ।আদর ভরা কর্তৃত্বসুরে বললো—-
“পঁচিশ বছর তো আপনাদের সাথেই কাটালো।বাকি জীবনটা না হয় আমার সাথেই কাটাক।কথা দিচ্ছি,আগলে রাখবো আপনার মেয়েকে।এই নিষ্প্রাণের প্রাণস্পন্দন করে রাখবো।”
নিজের কথা শেষ করে দরজার কাছে গিয়ে দমকে যায় নিষ্প্রাণ।গম্ভীর গলায় বললো–
“তাড়াতাড়ি আয় ধ্রুবতারা।আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি।”
চলবে,,,