“প্রাণস্পন্দন পর্বঃ৯

0
2891

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৯
লেখনীতে তাজরিয়ান খান তানভি

ক্লাস জুড়ে চলছে শিক্ষার্থীদের হৈ চৈ।গতকাল সন্ধ্যায় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে।সেই নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে।স্টেরিওকেমেস্ট্রির শিক্ষক কমলক্রান্তির আগমনেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় পুরো ক্লাস।শিক্ষার্থীরা যার যার জায়গায় বসে পড়লো।কমলক্রান্তি সাহেব ডেক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।শিক্ষার্থীদের মাঝে বহমান চাপা উত্তেজনা বুঝতে পেয়ে চমৎকার হাসলেন।হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললেন—

“কংগ্রেজুলেশন এভরিওয়ান।এইবারের রেজাল্ট আমাদের ডিপার্টমেন্টের রেকড গড়েছে।”

ক্লাস জুড়ে আবারও কিচিরমিচির শুরু হলো।কমলক্রান্তি সবাইকে শান্ত হতে বললেন।অতি গর্বের সাথে বললেন—

“এইবার আমাদের ডিপার্টমেন্টের হাইজেস্ট পয়েন্ট থ্রি পয়েন্ট নাইন এইট।আর তা অর্জন করেছে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত আর ভদ্র ছেলে নিষ্প্রাণ মুনতাসির।”

ক্লাসে সবাই একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে।অনেকের কাছেই নামটা নতুন।কমলক্রান্তি নিষ্প্রাণকে উঠে দাঁড়ানো আদেশ করলেন।ক্লাসভর্তি উৎসুক চোখ নিবদ্ধ হলো মাঝের সারির একদম পেছনের বেঞ্চে।তিন সারিতে বিভক্ত ক্লাসের কর্ণারের সারিতে প্রথম বেঞ্চে বসা আয়েন্দ্রি পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো ফর্সা,গোলগাল মুখের একটা ছেলেকে।মাথায় ঝাঁকড়া চুল,চোখে মৃদু পাওয়ারের চশমা।হলুদ,কালো মিশেলের চেক শার্টের হাতা গুটানো কনুই পর্যন্ত।হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলো নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্র গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আজকের আগে ছেলেটাকে দেখাই হয়নি।কমলক্রান্তি সবার সাথে নিষ্প্রাণকে পরিচয় করিয়ে দিলো।নিষ্প্রাণ প্রথম বর্ষ থেকে নয়,দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝিতে এসেছে এই ভার্সিটিতে।

নিষ্প্রাণের ধরা বাঁধা জায়গা সেই পেছনের বেঞ্চ।চুপচাপ সেখানেই বসে থাকে।টিচারদের প্রতিটা লেকচার শোনে গভীর অভিনিবেশে।তার পাশেই আছে বন্ধু সীমান্ত।খালি মাঠে ছক্কা হাঁকাবে নিষ্প্রাণ তা বুঝতে পারেনি সীমান্ত।নিষ্প্রাণ বসতেই তাকে খোঁচা মারতে লাগলো বিভিন্ন উদ্ভট কথা বলে।নিষ্প্রাণ লাজুক হাসে।তার সেই হাসিতে আটকে যায় আয়েন্দ্রির চোখ।
,
,
,
ব্রেক টাইমে ভার্সিটির মাঝে অবস্থিত শহীদ মিনারের প্রাঙ্গনে বসে আছে সীমান্ত।বিশ মিনিটের ব্রেকে দাপিয়ে উঠে সে।হাসি-ঠাট্টা সবকিছুতে যেনো একটু বেশিই এগিয়ে সীমান্ত।খোশমেজাজে বললো—

‘দুর শালা!সেকেন্ড ইয়ার পাস কইরা ফালাইলাম আর এখনো একটা মাইয়া জুগাইতে পারলাম না।জীবনটা পুরাই কচুপাতা।”

হো হো করে হেসে উঠে প্রাবিশ।মৃদু গলায় বললো–

“কেন মামা?ধরে রাখছে কে তোমারে?যাইয়া ঝুইলা পরো কারো গলায়।”

সীমান্ত আপত্তি করে বললো—

“আরে সবার গলায় কী ঝুইলা যাওয়া যাইবো নাকি?দেইখা,শুইনা ঝুলতে হইবো।”

প্রাবিশ অট্টহাসি দিয়ে বললো–

“হ মামা।যেই বডি বানাইছো!মাশাআল্লাহ্।ক্লাসের মুক্তা যদি তোমার বউ হয় তাইলে তো বিয়ের রাতেই হসপিটালে দৌঁড়াইতে হইবো।”

“চুপ!যতসব ছিঃ মার্কা কথাবার্তা।”

হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে প্রাবিশ শহিদ মিনারের সিঁড়িতে।তখনই একটি মিহি কন্ঠ শুনতে পায় প্রাবিশ।

“প্রাবিশ!

প্রাবিশ চোখে তুলে তাকাতেই দেখে আয়েন্দ্রি দাঁড়িয়ে আছে।মাথাভর্তি ঘন চুলে পনি টেইল করা।গাঢ় খয়েরি রঙের সেলোয়ার কামিজ।চোখে,মুখে অকৃত্রিম লাবন্যতার ছোঁয়া।প্রাবিশ মিষ্টি হেসে বললো–

“কী হয়েছে?কিছু বলবি?

প্রাবিশ আয়েন্দ্রির খুব ভালো বন্ধু।এক ডিপার্টমেন্ট আর পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় সম্পর্কটাও বেশ পোক্ত।আয়েন্দ্রি মুচকি হাসলো।মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোধক সম্মতি দিলো।প্রাবিশ বসে থাকা বাকি ফ্রেন্ডদের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।একরকম অগ্রাহ্য করেই চলে যায় আয়েন্দ্রির কাছে।বিরক্তি ঝুলে সীমান্তের চোখে,মুখে।

আয়েন্দ্রির কাছে দাঁড়িয়ে ফিকে কন্ঠে প্রশ্ন করে প্রাবিশ—

“কিছু বলবি?

আয়েন্দ্রির নরম চোখ জোড়া তাদের বন্ধু মহলে একবার ঘুরিয়ে এনে মিইয়ে গলায় বললো—

“নিষ্প্রাণ কোথায়?

প্রাবিশ পেছন ফিরে সীমান্তের দিকে তাকায়।সীমান্ত কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।প্রাবিশ চোখ ফিরিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো—

“আযান হয়েছে তো।নিষ্প্রাণ নামায পড়তে গেছে।”

“ও।আচ্ছা।ক্লাসে যাবি না?ক্লাস শুরু হবে তো।”

“হুম।চল।”

প্রাবিশ সীমান্তের দিকে তাকিয়ে বাকিদেরও আসার নিমন্ত্রণ দিলো।সীমান্ত কিড়মিড়িয়ে উঠে।মেয়ে মানুষের ন্যাওটা!
,
,
,
ক্লাশ শেষে নিষ্প্রাণকে খুঁজতে থাকে আয়েন্দ্রি।কিন্তু কোথাও নেই।ছেলেটা হুট করেই কোথায় যে যায়!

তিনতলার করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আয়েন্দ্রি খেয়াল করে প্রাবিশ,সীমান্ত,নিষ্প্রাণ সবাই মাঠে ক্রিকেট খেলছে।খেলায় তেমন আগ্রহ নেই আয়েন্দ্রির।কিন্তু আজ ইচ্ছে হলো।
নিচ তলার করিডোরে পৌঁছাতেই এক হ্যাঁচকা টান তৃণার।হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বললো–

“কোথায় যাচ্ছিস?ডাকছি শুনতে পারছিস না?

হতবুদ্ধি হয়ে যায় আয়েন্দ্রি।তার দৃঢ়চিত্ত ওই মাঠে।তাই অন্য কিছু তার কর্ণগোচর হচ্ছে না।তৃণা আয়েন্দ্রির বেস্ট ফ্রেন্ড কুসুমের কাজিন।তৃণা ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট।কোনোরকম টেনেটুনে আয়েন্দ্রিকে নিজের ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যায় তৃণা।তাদের ডিপার্টমেন্টে একটা প্রোগ্রামের আয়োজন করা হচ্ছে।আর তাতে গান গাওয়ার জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রি কোনোভাবেই রাজী হচ্ছিলো না।তাই তৃণা সেইসবে স্যারদেরকেও ইনভলব করে।বাধ্য হয়েই রাজী হতে হয় আয়েন্দ্রিকে।

গুটগুট পায়ে মাঠে এসে দেখে ঘাসের উপর শুয়ে আছে ক্লান্ত,শ্রান্ত প্রাবিশ আর সীমান্ত।সাথে তাদের অন্য ফ্রেন্ডরাও।নিষ্প্রাণকে কোথাও দেখলো না আয়েন্দ্রি।আয়েন্দ্রিকে দেখে উঠে বসে প্রাবিশ।পাশে থাকা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সীমান্ত থেকে বিদায় নেয়।ঘামে ভিজে থাকা টিশার্ট হালকা বাতাস আসতেই আলগা হয় শরীর থেকে।

ভার্সিটির গেইট থেকে বের হতেই আয়েন্দ্রিয় রয়ে সয়ে প্রশ্ন করে—

“নিষ্প্রাণ কোথায়?

প্রাবিশ একগাল হেসে বললো—

“যুবতীর মন আজ করে আনচান
দেখবার চায় তোমার ওই চাঁদ মুখখান।”

ধুম করেই এক কিল বসিয়ে দেয় প্রাবিশের পিঠে আয়েন্দ্রি।হো হো করে হেসে উঠে প্রাবিশ।মৃদু গলায় বললো—

“আছে।মসজিদে।”

ভার্সিটির সাথেই লাগোয়া এলাকার মসজিদ।মসজিদ দুই ভাগে বিভক্ত মসজিদের একপাশে এতিমখানা।এতিমখানার ভবন থেকে ভার্সিটি সম্পূর্ণ অবলোকন করা যায়।মসজিদের সদর দরজা বড় রাস্তার দিকে।কিন্তু এর ছোট একটা দরজা আজে পাশের রাস্তার দিকে যেখান থেকে সহজেই ভার্সিটি,কলেজ আর স্কুলের শিক্ষার্থীরা মসজিদে যেতে পারবে।এই ছোট্ট দরজাটার বামপাশে একটা মিষ্টির দোকান আর ডানপাশে লাইব্রেরি।আর উপরে ফটোকপির দোকান।প্রাবিশ আর আয়েন্দ্রি মিষ্টির দোকানের সামনে আসতেই বেরিয়ে আসে নিষ্প্রাণ।আসরের নামায শেষ করে বেরিয়েছে সে।নিষ্প্রাণকে দেখে থমকে যায় আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের সরল দৃষ্টি প্রাবিশের দিকে।স্মিত হেসে মোলায়েম গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—

“চলে যাচ্ছিস?

“হুম।”

চট করেই বলে ফেলে আয়েন্দ্রি—

“হাই!

মাথাটা হালকা ঘুরিয়ে আয়েন্দ্রির দিকে তাকাতেই নিষ্প্রাণের চোখ দুটো আবদ্ধ হয় আয়েন্দ্রির ঠোঁটে।আয়েন্দ্রির নিচের ঠোঁটের মাঝ বরাবর একটা লাল তিল।

কেঁপে উঠে নিষ্প্রাণের ভেতর মানব।অস্বাভাবিকভাবে ঘামতে শুরু করে নিষ্প্রাণ।অস্থির হয়ে উঠে সে।শ্বাস আটকে আসে।চোখ জ্বলতে শুরু করে।বড় বড় শ্বাস টানতে থাকে নিষ্প্রাণ।নিষ্প্রাণের এমন অদ্ভুত আচরণে ঘাবড়ে যায় প্রাবিশ।ভীত চোখে চেয়ে রয় আয়েন্দ্রি।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here