#প্রিয়ংবদা
#সপ্তদশ_পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়
দিন ফুরোলো, ক্লান্ত নীলরাঙা আকাশটা তলিয়ে গেল অপরাহ্নের অন্তরালে!টিমটিমে তারকালোকে সজ্জিত হলো কালচে গগণ!মেঘপরীদের আড়ালে আড়ালে লুকোচুরি খেলে যেতে লাগলো অষ্টমীর উজ্জ্বল বাঁকা চাঁদ!
হৃদিতার জ্বরের পারদও নামলো তখনই! আদৃত তখনও হৃদিতাদের বাড়িতে, তারই ঘরে বসে তার দিকে নিমগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে!প্রিয়তমার এমন অসুখে তাকে রেখে ফিরতে মন চায়নি বলেই এ ব্যবস্থা!
হঠাৎ হৃদিতার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম নজরে আসতেই ভ্রু কুচকে তাকালো সে।ভাবনা এলো,”জ্বরের গা ঘামবে কেন?”
পরক্ষণেই স্মরণ হল,”জ্বর নেমে গেলেই তো এমন হয়!তবে কি হৃদের জ্বর কমলো!”
আদৃত প্রায় লাফিয়ে দাঁড়ালো! দ্রুতপদে হৃদিতার কাছটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে কপালে হাত রাখলো, একে একে হাতের তালু তো আরেকবার হাতের উল্টোপিঠে পরখ করে নিল শরীরের উষ্ণতা! নাহ্,দেহ ঠান্ডা!আদৃতের ধারণাই তবে সঠিক!জ্বর নেমে গেছে!
আদৃত হাফ ছাড়ে!চাপা কষ্ট খামচে ধরা ঐ প্রণয়আভায় আলোকিত বুকটা থেকে একটা বিশাল পাথর নেমে গেল বলে মনে হয়!
আদৃত একবার পূর্ণদৃষ্টিতে অবলোকন করে প্রিয়তমার শয্যারত তনু!একদম নেতিয়ে পড়া লাউয়ের ডগার মতোই মনে হয় জ্বরের ধকলে ক্লান্ত,অবসন্ন নারীদেহটি!
আদৃত নজর সরায়!কেমন ঘোর লেগে যায়,মেয়েটার দিকে তাকালেই!
তবে দৃষ্টি খুব বেশিক্ষণ সংযত রাখা যায়না!আবার তাকায়!জ্বর নেমে গিয়ে ঘেমে যাওয়া আধভেজা দেহের দিকে তাকিয়ে আদৃত ফ্যানের সুইচটা চালু করতেই কড়কড় আওয়াজে তা শুরু করে আবর্তন!হৃদিতা তখন ওষুধের প্রভাবে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে!চোখের পাতা নড়ছেনা একটুও,ঘনঘন নিশ্বাসে বুকের পাজর স্পন্দন ছন্দে ওঠা নামা করে যাচ্ছে বিরতিহীন!
আদৃত হেলে পড়ে হৃদিতার দিকে, একদম মুখের ওপরেই!বিপরীত থেকে ভেসে আসা উষ্ণ নিঃশ্বাসে প্রেমিকহৃদয় নিষিদ্ধ ইচ্ছের জলপনা আঁকে,চোখ পড়ে শুকিয়ে যাওয়া অধরদ্বয়ে!আদৃত কেঁপে ওঠে!চোখ বুজে বিশাল শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলেও নেয় ক্ষণিকেই!
দৃষ্টি সরিয়ে গায়ের চাদরটা সরাতে নিতেই হাত সরিয়ে নেয়।মনে পড়ে, মেয়েটার গায়ে ওড়না নেই। চাদর সরিয়ে নেয়া যাবে না।
অতঃপর নিচু স্বরে ডাক পাঠায় টাপুর দেবীর উদ্দেশ্যে!
“আন্টি!একটু শুনবেন?”
টাপুর দেবী রান্নাঘরে রাতের খাবার বানাচ্ছিলেন!আদৃতের ডাকেই তিনি তড়িঘড়ি করে ছুটে আসেন মেয়ের ঘরে। হাতে তখনো খুন্তি ধরে রাখা।
জিজ্ঞেস করেন,
“কিছু লাগবে বাবা?খিদে পেয়েছে?”
আদৃত নাসূচক মাথা নাড়ে!নিচু দৃষ্টিতে বিনীত স্বরে বলে,
“ওর গা ঘেমে গেছে আন্টি!চাদরটা যদি সরিয়ে দিতেন!আসলে গায়ে ওড়না নেই তো তাই আমি…! ”
কথা আটকে যায় এটুকুতেই!আর বলতেও হয়না অবশ্য!
টাপুর দেবী বুঝতে পারেন। সোফার ওপরে রাখা সাদা সুতির ওড়নাটা এনে জড়িয়ে দেন মেয়ের গায়ে।
আদৃত উল্টোদিকে ফেরে!
সেদিকে চোখ বুলিয়ে টাপুরদেবী হৃদিতার গায়ে ঢাকা দেয়া মোটা চাদরটা টান দিয়ে সরিয়ে রাখেন পায়ের কাছে।
আদৃত তখনো উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে!অঙ্গভঙ্গি যথেষ্ট সংযত!কোথাও কোন কলুসতা নেই!
টাপুর দেবী মুগ্ধ হন। বিমুগ্ধ অন্তরেই প্রস্থান করেন ঘর থেকে।
আদৃত এবারে ফিরে দাঁড়ায়।মেয়েটার ঘুমে বোজা চোখ দুটোতেই আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়! তারপর খুব যত্নে, অতি সন্তর্পণে আঙুল চালায় কোমড় ছড়ানো কালো কুন্তলে।হৃদিতা নড়েচড়ে ওঠে! পাছে ঘুম ভেঙে যায়,সে ভয়ে চলন্ত আঙুলগুলো থামিয়ে দেয় আদৃত!
হৃদিতা দুহাটু ভাজ করে গুটিসুটি মেরে পাশ ফেরে। আদৃত হাসে, অস্ফুটে বিবৃত করে,
“পাগলীটা!”
.
ডায়নিং রুম!চলতে থাকা ঘড়ির কাটা তখন দশের ঘরে ঘুরছে!ডিনারের উদ্দেশ্যেই বসে আছেন ঋতমবাবু!মুখশ্রী গম্ভীর!
মুখোমুখি চেয়ারটাতেই আদৃতের অবস্থান! টাপুরদেবী একে একে রান্নাঘর থেকে সব খাবার নিয়ে এসে টেবিলে সাজাচ্ছেন!
ঋতমবাবু তার জন্য অপেক্ষা না করেই কথা এগোয়,
“হৃদকে তুমি কতদিন হলো চেন আদৃত?সামান্য ক’দিনের পরিচয়েই একটা মেয়ের প্রতি এতটা দূর্বলতা তৈরী হলো কিকরে তোমার?বিষয়টা অস্বাভাবিক না?”
টাপুরদেবীর কানে পৌঁছোয় কথাটা। রান্নাঘরের দরজা দিয়েই একবার স্বামীর দিকে তাকান তিনি।
আদৃত তখনো সাবলীল! চেহারায় নেই কোন সঙ্কোচ,কোন আড়ষ্টতা! সে খুব স্বভাবিক স্বরেই জবাব দেয়,
“হৃদিতার প্রতি আমার যে দূর্বলতা তৈরী হয়েছে তার নাম ভালোবাসা আঙ্কেল!
আর এই ভালোবাসা একটা অনুভূতি ! খুবই সুক্ষ্ম একটা চমৎকার অনুভূতি! আর যেকোন অনুভূতিই সময়নির্ভর নয়!সময়ের দীর্ঘতা কিংবা স্বল্পতার ওপরে কোন অনুভূতির সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস নির্ভর করেনা বলেই আমার ধারণা।
এই দেখুন না, ভালোবাসার নিকটস্থ একটি অনুভূতির নামই ভালো লাগা!এই ভালো লাগা কি কোন নির্দিষ্ট সময় ধরে বেঁধে সৃষ্টি হয়?উঁহু!ভালো লাগা সৃষ্টি হয় ইন্সট্যান্ট,একেবারেই রাতারাতি!
আপনি শপিংয়ে গেলে কিন্তু অনেক বেশি টাইম নিয়ে যান না, তবুও ঐ অল্প সময়েই আপনার অনেক অনেক কিছুই ভালো লাগে, লেগে যায়! তার ভেতর থেকেই ভালো লাগার তারতম্য বিচারে আপনি ক্রয় করেন!সেই হঠাৎ, হুট করে ভালো লাগা জিনিসগুলোই একসময় প্রিয় তালিকায় নাম লেখায়!
এবার,আপনি বলতেই পারেন, আপনার মেয়ে কোন পণ্য নয়!সে একজন মানুষ, রক্তমাংসে গড়া মানুষ!
তার প্রতি হঠাৎ করে পছন্দ হয়ে যাওয়া পণ্যের তুলনা কেন করছি!
উত্তরটা দিচ্ছি আঙ্কেল!ওকে কিছুর সাথে তুলনা করা যায়না, আমি পারবো না!আমি শুধু কথাটা এজন্যই বললাম,যাতে আপনি বোঝেন, সময়সীমার ওপরে ভালোবাসার সৃষ্টি হওয়া নির্ভর করেনা!
ভালোবাসা সৃষ্টি হয়,ভালো লাগা থেকে!আর ভালো লাগতে লাগে একটা কারণ, তা হোক খুব বিশাল কিছু বা খুব ক্ষুদ্র!
হৃদ আমাকে সেই কারণটা দিয়েছিল আঙ্কেল!তাই হয়তো ওর প্রতি এই প্রগাঢ় অনুভূতির আবির্ভাব!
হৃদ একজন খুবই ভালো মনের মেয়ে! যে কাউকে অল্পেই আপন করে নেবার ক্ষমতা রাখে ও!অনায়াসেই কাউকে ভালোবাসতে পারে!তবে ওর পারিপার্শ্বিকের কিছু মানুষের এটা দুর্ভাগ্য যে তারা ওর এই অপরিসীম ভালোবাসাটুকু পাবার যোগ্যতা রাখেনি!সেকারণেই হয়তো ওনাদের কাছে, ওর বাহ্যিক রুপটুকুই মুখ্য হয়ে ওর এই গুণটা থেকে গেছে অস্পষ্ট, অজানা!
আমার ক্ষেত্রেও তেমন হতে পারতো! হতেই পারতো!তবে তেমনটা হয়নি!আমার নজরে সবার আগে ওর কাউকে হুট করে আপন করে নেবার এই কোয়ালিটিটাই এসে গেছে, তা হোক কাকতালীয় ভাবে, তবে এসছে!
আপনারা হয়তো এতদিনে জেনে গেছেন, কাদম্বিনী দেবী, যাকে হৃদ দিদা ডাকেন, সে আর কেউ না। আমারই ঠাম্মি!আমার জীবনের আইডল, আমার দাদুর, একমাত্র ভালোবাসা!
প্রথম দেখায় যখন ওর মুখে শুনলাম ঠাম্মির সাথে ওর পরিচয়ের সূচনা,তখন আমার মনে হয়েছিল, এমন হুট করে রাস্তায় দেখা হওয়া একজন অপরিচিত বয়স্ক বৃদ্ধার প্রতি কিকরে একটা মানুষের এত টান, এত ভালোবাসা থাকতে পারে যার জন্য রোজ নিয়ম করে টানা তার সাথে দেখা করে তার একাকিত্ব কমাতে গল্প করা যায়, তাকে হাসানো যায়, তার আনন্দে হাসা যায়!?
ঠাম্মির সাথে ওর সবরকমের আচরণের কথাই মোটামুটি কানে আসতো আমার, বৃদ্ধাশ্রমের লোকেরাই বলতো!সেখান থেকেই জানতে পারি, ও নিজের ঠাম্মির মতোই ট্রিট করে ওনাকে! আমি অবাক হই প্রথমটা, আমি তো ভেবেছিলাম ও কোন খারাপ উদ্দেশ্যেই হয়তো করছে এমনটা, তবে তা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আমার মনে ওর একটা জায়গা তৈরী হয়ে যায়, ও করে নেয়!খানিকটা সম্মানের,খানিকটা ভালো লাগার!
তারপরে ওর সাথে আমার প্রতিটা সাক্ষাৎ, সেই ভালো লাগার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে থাকে একটু একটু করে!আর একটা সময় বুঝে যাই ভালো লাগাটা আর ভালো লাগাতে সীমাবদ্ধ নেই, ভালোবাসায় রুপান্তর হয়ে গেছে!
আমার ভালোবাসাটা তাই পরিচয় অথবা সময়ের স্বল্পতায় আটকে পড়েনি আঙ্কেল!সময়ের সুতোকে উপেক্ষা করে খুব অল্প সময়ে, অল্প আলাপেই হৃদের প্রতি জন্মানো আমার ভালোবাসা বেড়ে গেছে চক্রবৃদ্ধি হারে!”
আদৃত কথা থামিয়ে শ্বাস ফেলে!ঋতমবাবু মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্য করেন তার চেয়ে বয়সে এত ছোট ছেলেটির ভাবনার গভীরতা!
টাপুর দেবী রান্নাঘর থেকে শুনছিলেন সবটাই!সব শুনে ওনার ঠোঁটেও হাসি ফোটে, মাতৃহিয়ার খুব বৃহৎ একটি চিন্তা ধুলিস্যাৎ হয় পলকেই!
তিনি ভাতের বাটিটাতে বড় একটা হাতা রেখে খাবার ঘরের ভেতরে আসেন। আদৃতের সাথে ঘটে দৃষ্টিবিনিময়!
তিনি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসেন, উত্তরে হাসে আদৃতও!
ভাতের বাটিটা টেবিলের ওপরে রেখে খাবার বেড়ে দেন, দুজনের পাতে!
ঋতমবাবু মৃদু হেসে আদৃতকে খাবার শুরু করতে ইশারা করেন। আদৃত সায় জানায়!ভাতের দলাগুলো হাত দিয়ে ভেঙে নিয়ে তরকারিতে মাখিয়ে মুখে পোরে!
এক কামড় মুখে পুরতেই চাপা হেসে ঋতমবাবু বলে ওঠেন,
“হৃদকে বিয়ে করতে তোমার কোন আপত্তি আছে কি?থাকার কথা নয় যদিও, তবুও মেয়ের বাবা তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম!তুমি বিয়েতে রাজি?”
আদৃত চোখ তুলে দেখে!হালকা হেসে উত্তর দেয়,
“আপনার মেয়েকে আপনি না দিলেও আমি বিয়ে করতাম আঙ্কেল, ও না চাইলেও করতাম। তুলে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান টজ্ঞান করে হলেও করতাম।
আমার ওকে ছাড়া চলবে না এটা বোঝার পরে তেমন করতেই হতো!
আর এখন যার মেয়ে তিনিই যখন বিয়ে দিতে রাজি,তখন তো না করার প্রশ্নই আসে না!
আমিও জানি আপনার করা প্রশ্নের উত্তরটা আপনার জানা তবুও আমিও আপনার মেয়ের হবু বর তো, তাই জানা উত্তরটাই আপনাকে আরেকবার জানালাম!”
ঋতমবাবু হেসে ফেলেন, সাথে হাসেন টাপুর দেবীও!
আদৃত চোখ নামিয়ে লাজুক হেসে মাথা নোঁয়ায়!ভাতের থালায় আবারো হাত রাখতেই ঋতমবাবু পুনরায় গম্ভীর বদনে প্রশ্ন করেন,
“আর তোমার পরিবারের লোকেরা আদৃত?তারা কি মানবেন? যতই হোক, আমার মেয়ে তো কালো!ওর মনটা তোমার সামনে প্রকাশ পেলেও বাকিদের কাছে তো অন্য সবার মতোই অপ্রকাশিত,বাকি সবার মতো তোমার পরিবারের লোকও ওর রুপটাই খুঁজবে সবার আগে!তখন?তখন যদি না মনেন ওনারা?কি করবে?”
আদৃত আবারো মাথা তোলে।মিলিয়ে যায় লাজুক আভা! ঋতমবাবুর চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে স্বগোতক্তি করে,
“আমার পরিবার যাদের নিয়ে, তারা ওকে ঠিকই মানবে আঙ্কেল! আমার পরিবার জানেও ওর ব্যাপারে!আর যাদেরকে আমি আমার পরিবার ভাবিনা, তারা হৃদকে যা দিয়েই বিবেচনা করুক, আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার!ও আমার সাথে থাকবে সারাজীবন! আমার যখন ওর কোন কিছু নিয়ে কোন সমস্যা নেই, তখন আর কারো ওকে নিয়ে সমস্যা হলে আমার কিছু যায় আসে না, কিচ্ছু না!
তাই তখনো আমি ওকেই বিয়ে করবো। আপনারা না দিলে জোড় করে করবো, তবুও করবো!”
ঋতমবাবুর চেহারার গাম্ভীর্য কেটে যায় মুহুর্তেই!তার বদলে সেখানে আবারো ভর করে একগাল হাসি!প্রসারিত ঠোঁটে উনি খেতে শুরু করেন,শুরু করে আদৃতও!
টাপুর দেবী তদারকি করেন কারো কিছু লাগবে কিনা!আদৃত হাত নেড়ে অসম্মতি জানাতেই ঋতমবাবু আদৃতকে তাগাদা দিয়ে বলে ওঠেন,
“বেশি করে খাও ইয়াং ম্যান!আমরা চাইলেও আমার মেয়ে সত্যিই চাইবে না তোমাকে বিয়ে করতে!তখন জ্বরের ঘোরে যা যা বলেছে সেসব ভুলে যাও!
ও অতি উত্তমমাপের ঘাড়তেড়া!তোমাকে প্রচুর জ্বালাবে তাতে নিশ্চিত থাকো!
সেসব সহ্য করার জন্য হলেও খাও!পরে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করার সময় গায়ের জোড় যোগাতেও সহায়তা করবে!”
আদৃত হেসে দেয়। তাল মেলান ঋতমবাবু আর টাপুর দেবীও!
আর তারপর?তারপর,সব দুশ্চিন্তা ভুলে গমগমে হাসির আসরে পরিণত হয় ডায়নিংয়ের প্রতিটা কোণ!
.
পৃথিবীর বুকে আলো ফুটেছে!প্রভাতের লাল টুকটুকে সূর্য, চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার তীব্র দিপ্তী!তারই আলোয় ঘুম ভেঙে উঠেই দিগ্বিদিকে ছন্নছাড়া উড়ে বেড়াচ্ছে শত শত চেনা অচেনা পাখি!প্রত্যেকের কন্ঠই সরব, তবে আলাদা ডাকে, আলাদা গানে!আকাশজুড়ে উড়ন্ত সেই বিহঙ্গ দলের ক্রমাগত কলকাকলিতেই মাতোয়ারা প্রথম সকাল!
শরতের আবছা কুয়াশার আড়াল, মিলিয়ে যাচ্ছে বিন্দু বিন্দু শিশিরে! হালকা হাওয়ায় দুলে উঠছে গাছের পাতা, সেই হাওয়ার রেশেই পাতায় জমা শিশির কণা গড়িয়ে পড়ছে, এক পাতা থেকে আরেক পাতায়!টিপ টিপ!
হৃদিতার ঘরের স্বচ্ছ কাচের জানালার পাল্লাটা একপাশে চাপানো!বন্ধ পাশটাতেও জমে আছে কুয়াশা বিদায়ী শিশির,এলোমেলো ফোঁটায় অদ্ভুত নকশা এঁকে!
জানালার খোলা পাশটা দিয়ে মৃদুমন্দ সমীরণ দুলিয়ে তুলছে পর্দা, কপালে ওড়া-উড়ি করছে হৃদিতার ছোট ছোট চুল!
পুব আকাশের প্রভাকর ততক্ষণে লালচে খোলসের বাইরে বেরিয়ে এসছে!ধারণ করেছে হলদে আভা!সেই কাঁদা হলুদ রঙের সূর্যের স্বর্ণরঙা রোদরশ্মি জানালা গলে লুটোপুটি খাচ্ছে ধুলোমাখা মেঝেতে, হৃদিতার বন্ধ চোখের পল্লবে!
রোদ্রালোকের সেই নিঠুর অত্যাচারেই ভেঙে যায় হৃদিতার ঘুম!চোখ মেলে তাকায় পিটপিট করে!
মাথাটা কেমন ভার!হৃদিতা চোখ বোজে আবারো। কয়েক মিনিট বসে থেকে আস্তে করে নামে বিছানা ছেড়ে!
জানালা দিয়ে একনজর বাইরের প্রকৃতি দেখে নেয় মুগ্ধ নয়নে!তারপরে মায়ের খোঁজে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
তবে ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই চোখ কপালে তুলে তাকায় সে!
আদৃত তখন সেখানে বসেই খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছে! হৃদিতা সে অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখেই বিহ্বল নয়নে তাকিয়ে রয় বেশ কিছুক্ষণ! তারপরে ঘোর ভেবে সদ্য ঘুম থেকে ওঠা চোখ দুটো ডলে নেয় দুহাতে।
তবে পূর্বে দেখা দৃশ্যের নড়চড় হয়না। আদৃত এখনো তাদের বাড়িতে, তাদেরই ড্রয়িংরুমে বসে তাদেরই খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছে!
হৃদিতা কপাল কুচকে দুহাত কোমরে গুঁজে একপ্রকার বাঘিনীর ন্যায় হুংকার তুলে বলে,
“এই!আপনি এখানে কি করছেন?”
আদৃত চমকে গিয়ে সোফা থেকে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয়!হৃদিতা হনহনিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াতেই নিজের বুকে থুথু ছিটিয়ে নেয় সে। তারপর অত্যন্ত গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হৃদিতার ওপরে!
হৃদিতা সেসবে পাত্তা না দিয়ে আবারো চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
“এই আপনার সাহস তো কম না। আপনি আমাকে এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়ে আবার আমার বাড়িতেই বসে আছেন?মানে কি?বেরোন আমার বাড়ি থেকে!বের হন!”
আদৃত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে!মাথায় আসে একটা কথাই,
“আঙ্কেল একদম ঠিক বলেছিল, এ অতিউত্তম মানের ঘাড়তেড়া!একদম!নিঃসন্দেহে! ”
হৃদিতা ভ্রু কুচকে তাকায়! জিজ্ঞেস করে,
“কি বিরবির করেন?জোড়ে বলুন!”
আদৃত চোখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়!সে দৃষ্টিতেই ক্ষনিকের তরে আটকে যায় হৃদিতা। আদৃত এবারটা প্রত্ত্যুত্তর করে,
“আমি এটাই বলছিলাম যে আপনি আস্ত একটা ডাকাত!”
হৃদিতার দৃষ্টির ঘোর কাটে!অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে ওঠে,
“কিহ্!কি বললেন আপনি?আমি ডাকাত?আপনার তো খুব সাহস?আমার বাড়িতে বসে আমাকেই ডাকাত বলেন?কোন সাহসে?”
আদৃত একটা ছোট আড়মোড়া ভেঙে বলে,
“অবভিয়াসলি আমার সাহসে, আর ডাকাত কে ডাকাত বলতে খুব বেশি সাহসের প্রয়োজন পড়েনা। ডাকাত যেখানেই থাক সে, ডাকাত!”
হৃদিতা আবারো চেঁচায়, আগুন ঝড়া চাহুনি তাক করে আদৃতের দিকে,
“এই কি ডাকাতি করেছি আমি, যে আমাকে ডাকাত বলেন?কি ডাকাতি করেছি?”
আদৃত এবারে উঠে দাঁড়ায়! দুহাত পকেটে গুঁজে হৃদিতার চোখে চোখ রাখে। জবাব দেয়,
“প্রথমে তো আমার মনটা ডাকাতি করে নিয়েছেন!সেটা তবু মানা যেত!তবে এখন তো আঙ্কেলের গোটা বাড়িটাই ডাকাতি করে নিচ্ছেন!আমার জানা মতে এ বাড়ি আঙ্কেলের। আঙ্কেলের বাড়িতে আঙ্কেলের পারমিশন নিয়ে থাকাতে কোন রকম সাহসের দরকার আছে বলে তো মনে হয়নি!
এখন তার বাড়িটাকে নিজের বাড়ি বলে চালিয়ে সেখানে আমার থাকার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা কি ডাকাতি নয়?অবশ্যই ডাকাতি!এটা রিতীমতো জোচ্চুরি! ”
হৃদিতার আগুন নজর মিঁইয়ে যায়! বোকা বোকা দৃষ্টি মেলে আদৃতের দিকে চেয়ে থেকে প্রশ্ন ছোড়ে,
“বাবা আপনাকে এখানে থাকতে বলেছে?”
আদৃত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই হৃদিতা আবারো গোটা বাড়ি মাথায় তুলে চিৎকার করে ওঠে,
“মাআআআআআআআআআ-বাবাআআআআআ”
আদৃত কানে হাত চেপে ভ্রু কুচকে হৃদিতার দিকে তাকাতেই চুপ করে যায় সে।
আদৃত এবারে বলে ওঠে,
“আঙ্কেল-আন্টি মন্দিরে গেছেন। আপনার নামে পূজো দিতে!কাল অত জ্বর আসার পরে রাতেই আবার কমে গেল তো, তাই!চেঁচাবেন না প্লিজ!আশেপাশে কেউ শুনলে ভাববে আমি আপনাকে ফোর্স করছি!”
হৃদিতা গাল ফুলিয়ে আদৃতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“আমাকে একা আপনার মতো ভয়ানক প্রাণীর সাথে রেখে চলে গেল? এটা কোন কথা? ”
আদৃত হালকা হেসে কপালের সামনে চলে আসা চুলগুলোকে বাঁহাতে পেছনের দিকে উল্টে দিতে দিতে উত্তর দেয়,
“আমি আপনার সাথে ভয়ানক কিছু করিইনি এখনো হৃদ!তাতেই এত বড় একটা উপাধি দিয়ে দিলেন। ” ভয়ানক প্রাণী”
এবারে যখন ভয়ানক ভয়ানক কাজগুলো আপনার সাথে করা হবে তখন কি বলবেন হৃদ?ভেবে নিন তো!”
হৃদিতা চুপসে গেল গ্যাস ছাড়া বেলুনের মতো! মাথায় ঘুরপাক খেল অনেক অনেক ভয়,অনেক প্রশ্ন!আদৃত বুঝতে পেরে আড়ালে হাসলো। হৃদিতার ভয়কে বাড়িয়ে দিতে বললো,
“আচ্ছা, আপনি তো খুব সাহসী হৃদ!কখন থেকে টিকটিকিটা আপনার কাঁধের ওপর বসে আছে, আপনার তাতে কোন হেলদোল নেই!বাহ্,মারাত্মক সাহস!”
আদৃতের বলতে দেরী, হৃদিতার লাফাতে দেরী নেই!সে এক লাফে দুজনের মাঝের দুরত্বটুকু মিটিয়ে দিয়ে ঝুলে পড়ে আদৃতের গলায়!চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
“টিকটিকি!আদৃতবাবু,বাঁচান!”
আদৃত হকচকিয়ে যায়! সে ভয় পাওয়ানোর জন্যই কথাটা বলেছিল তবে হৃদিতা যে ভয়ে এমন কিছু করে বসবে তা ভাবতেই পারেনি সে!
আদৃত আস্তে করে বলে,
“ভয় কি হৃদ!আমি আছি তো!”
হৃদিতা চোখ বুজে নেয়!দু ফোঁটা জল গড়ায় তখনই। মনে পড়ে, ঐ বৃষ্টি বিকেলে বাজ পড়ার আওয়াজে হৃদিতা যখন ভয় পেয়ে চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করেছিল,তখনও আদৃত এভাবেই বলেছিল,
“ভয় কি হৃদ!আমি আছি তো!”
হৃদিতা আদৃতের পিঠের শার্ট খামচে নেয় আরো বেশি করে। আদৃত ব্যাথা পায়,তবে কিছু বলে না। থাক ওভাবেই!
হঠাৎ ঘাড়ে ফোঁটা ফোঁটা জলের আভাস পেয়ে হৃদিতাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সোজা করে দাঁড় করায় আদৃত!
প্রিয়তমার এমন আকস্মিক ক্রন্দনে দিশেহারা হয়ে প্রশ্ন করে,
“কাঁদেন কেন?ভয় পেয়েছেন?আমি তো মজা করে বললাম হৃদ। আপনি দেখি এখনো বাচ্চাদের মতো অবুঝ। মজাও বোঝেন না। টিকটিকি কি স্থির হয়ে থাকার জিনিস। আপনার কাঁধে থাকলে আপনি টের পেতেন না?পাগল!”
হৃদিতা আবারো জড়িয়ে ধরে আদৃতকে। আদৃত অবাক হয়!তবুও প্রেয়সীকে হালকা আলিঙ্গনে বাঁধতে ভোলে না প্রেমিক মন!
হৃদিতা নাক টেনে বলে ওঠে,
“আপনি আছেন বলেও থাকেননি আদৃতবাবু!আমার এড়িয়ে যাবার পরিবর্তে এড়িয়েই গেছেন প্রতিনিয়ত!কিন্তু এমন কথা কি ছিল?আমার অবহেলার বিনিময় কি অবহেলাই হবার কথা ছিল?ছিল না!একদম না!
আপনি কথা রাখেননি আদৃত বাবু!আমাকে ভালোও বাসেননি!
আমার অভিমান হয়েছে আদৃতবাবু!খুব খুব খুব অভিমান!আপনি ভাঙতে পারেননি!
আপনি কথা রাখেননি!”
আদৃত হাসে!হৃদিতার চুলের ভাজে আঙুল ডুবিয়ে উত্তর দেয়,
“আমি আপনার অভিমান বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি হৃদ,কথা রাখতেও ব্যর্থ হয়েছি!
তার জন্য খুব খুব খুব করে সরি হৃদ!তবে যদি ভালোবাসার কথা বলেন, তবে জেনে রাখুন,
আমি আপনাকে যতটা ভালোবেসেছি,আঙ্কেল-আন্টির বাইরে ততটা ভালো আপনাকে আর কেউ বাসেনি হৃদ!কেউ না!”
#চলবে!
[কাল অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম হঠাৎ!তার জন্য গল্প দিতে পারিনি!দুঃখিত!]