প্রিয়ংবদা পর্ব ২

0
2434

#প্রিয়ংবদা 🧡
#দ্বিতীয়_পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

নিরিবিলি ভাঙা বাড়িটারই পাশে ভাঙা দরজার একটা ঘরের চেয়ারে হাত বাঁধা অবস্থায় বসে আছে হৃদিতা!
গলায় প্যাঁচানো ওড়নাটাও আর গায়ে নেই। সেই অপরিচিত যুবক তা বহু পূর্বেই গা থেকে টেনে সরিয়ে দিয়েছে।
হৃদিতা বাঁধা দেবার চেষ্টা করেও যখন বাঁধা দিতে পারেনি তখন খোলা চুল গুলো গলার দুদিকে মেলে দিয়েছে।
তার গায়ের সেই ওড়ানাই এখন তার হাতের বাঁধন।
ভয়ে হৃদিতার অন্তরাত্মা যখন শুকিয়ে আসার উপক্রম, তখন তার ভয়টাকে আরো তুঙ্গে তুলে দিতে সেই আদ্যোপান্ত অপরিচিত যুবকটি ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এসে চেয়ারে দু হাতলে হাতের ভর ছেড়ে একদম হৃদিতার মুখের ওপরে ঝুকে এসে দাঁড়ালো।
অজানা শঙ্কায় হৃদিতা চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিতেই ছেলেটি হাসলো।
সে হাসি হৃদিতার আড়ালে থেকে গেলেও হৃদিতার ভয়ার্ত মুখটা ছেলেটির চোখে গেঁথে গেল যেন।

ছেলেটা এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। একদম হৃদিতার সামনে।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে যাবার পরও ছেলেটার পক্ষ থেকে কোনরুপ অশ্লীলতার আভাস না পেয়ে আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাইলো হৃদিতা!
সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে চোখ পড়তেই চোখ ছলকে পলো কৌতুহলে।
তার মনে প্রশ্নেরা নাড়া দিল, কেন তাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে এই ছেলেটা? কে ও? কি চায়?
প্রশ্নঘুড়িরা হৃদিতার ভীত, সন্ত্রস্ত মস্তিষ্কময় বিচরণ করেও যখন উত্তরের দিশা পেল না তখন হৃদিতার মুখে কথা ফুটলো। সে কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কে আপনি? আমার সাথে এমন কেন করছেন? আমি কি কিছু করেছি? আপনাকে তো আমি চিনি পর্যন্ত না। আমি আপনার সাথে কি করতে পারি?”

ছেলেটা দু কদম পিঁছিয়ে দাঁড়াতেই হৃদিতা একটু স্বস্তি পেল। উত্তরের জন্য অপেক্ষা করার মাঝেই ছেলেটি জবাব দিল,
“গত এক সপ্তাহ ধরে দেখছি মিস! আপনি রেগুলার এই বৃদ্ধাশ্রমে আসছেন, একটা পার্টিকুলার টাইমেই আসছেন, ভেতরে থাকা কোন এক বয়স্কা বৃদ্ধার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ চারিতা শেষে আবার বেরিয়ে যাচ্ছেন।
রোজ রোজ এতটা সময় এখানে কি কারণে ব্যায় করছেন আপনি?
কি উদ্দেশ্য আপনার? আপনি কোন পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িয়ে নেই তো?”

হৃদিতা ছোট ছোট চোখে ছেলেটার দিকে তাকালো।ছেলেটা তাকে নিষ্পৃহভাবে কি সুন্দর পাচারকারী বানিয়ে দিল ভেবেই ছেলেটাকে মঙ্গলে পাচার করে দেবার তীব্র ইচ্ছে গ্রাস করলো।তবে বাঁধা হাতজোড়ার দিকে চোখ পড়তেই সেসব ইচ্ছে কেই মঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়ে জবাব দিল,
“আমাকে দেখে আপনার পাচারকারী মনে হয়? আর আপনি যে রাস্তার বখাটে ছেলেগুলোর মতো আমাকে জোড় করে এমন একটা গাঁ ছমছমে জায়গায় নিয়ে এলেন, গায়ের ওড়না টোরনা খুলে নিলেন, এসব তো বিলক্ষণ কোন রেপিস্টের মতো কার্যকলাপ! তো? আপনি কি? চিইন রেপিস্ট? ”

ছেলেটার চোখমুখ রাগে লাল হয়ে এলো। দু হাত মুঠো করে চোয়াল শক্ত করে সে প্রায় ধমকে উঠলো হৃদিতাকে,
“জাস্ট শাট আপ! মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ! আপনি রোজ ঠ..আব মানে কাদম্বিনী দেবীর সাথেই কেন দেখা করতে আসেন? কি সম্পর্ক ওনার সাথে আপনার? বলুন?”

হৃদিতা অবাক চোখে তাকিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করে,
“আপনি দিদা মানে কাদম্বিনী দেবীকে কিকরে চেনেন, আর আপনি কি করে জানেন যে আমি ওনার সাথেই দেখা করতে আসি? আপনি কি আমাকে ফলো করেন মিস্টার? সত্যিই তো! নাহলে এক সপ্তাহ ধরে যে আমি ওনার সাথে দেখা করতে আসি, তা আপনি কি করে জানেন?”

ছেলেটা একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে আবার বলতে শুরু করে,
“আমার দাদু এই বৃদ্ধাশ্রমে কিছুটা অ্যামাউন্ট কন্ট্রিবিউট করেন। তাই বৃদ্ধাশ্রমের টুকিটাকি সব কথাই আশ্রম কমিটি আমাদের জানিয়ে রাখেন।
বেশ কদিন থেকে আপনার উপস্থিতি, ঘনঘন যাতায়াতে ওনাদের মনে কিছুটা সন্দেহ জাগায় ওনারা আমাকে জানান। আর তাই আমিও গত তিনদিন থেকে আপনাকে নজরে নজরে রেখেছি!সে জন্যই জানি।
ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং তো ইয়েস, আই হ্যাভ ফলোড ইউ!
এবার বলুন, কাদম্বিনী দেবীকে কি করে চেনেন আপনি? কি উদ্দেশ্য আপনার? ”

হৃদিতা কড়া দৃষ্টিতে একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে নিজের বাঁধা হাতের দিকে তাকালো।
সেদিকে তাকিয়েই জবাব দিল,
“আমাকে তো গত তিনদিন যাবৎ ধাওয়া করছেন। তো? আমার পিছু নিয়ে কি মনে হলো আপনার? আমি পাচাকারী দলের সদস্য? ”

ছেলেটা এবারে দুহাত বুকে গুঁজে বিরক্তিতে “চ” ধরনের শব্দ করে বললো,
“সব প্রশ্নের জবাবে আপনাকে পাল্টা প্রশ্ন কি করতেই হবে? কোন প্রশ্নের উত্তর কি আপনি সোজাসাপটা ভাবে দিতে পারেন না? এই তিনদিনে মাথাই নষ্ট করে দিয়েছেন আমার।
গত পরসু, বইয়ের দোকানে গেলেন, দোকানি জিজ্ঞেস করলো, বই নিতে গেছেন কিনা? আপনি উত্তর দিতে পারতেন যে হ্যাঁ গেছি। কিন্তু না। আপনি কি জবাব দিলেন?” বইয়ের দোকানে বই কিনতে আসবো না তো কি খই ভাজতে আসবো?”
কফিশপে ওয়েটার যখন কফির অর্ডার নিতে এলো, সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি খাবেন ম্যাম?’ আপনি বলে দিতেন কফি খাবেন! তা না। আপনি জবাব দিলেন,” কফিশপ এটা।তো কফি খেতেই এসেছি নিশ্চই!”
আরে বাবা, কফিরও কিছু শ্রেণীভেদ আছে নাকি? হট কফি, কোল্ড কফি, ক্যাপাচিউনো আরো কত কি! আপনি এমনই নাকি?
কোন প্রশ্নের জবাব কি সহজ সাবলীল উপায়ে দিতে পারেন না নাকি? ”

হৃদিতা অবাক হয়ে বললো,
“ও মাই দুগ্গা মা! কি লোক আপনি মশাই? আমার পিছু নিয়ে তো পুরো সব ঘটনা মুখস্থ করে নিয়েছেন।
শুধু বৃদ্ধাশ্রমে কি করছি জানার জন্যই এরকম টা করলেন? নাকি আরো কোন কারণ আছে?কাহিনি কি হুম?”

ছেলেটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আমতা আমতা করতে করতে জবাব দিল,
“ননননা, মানে অন্য কি কারণ থাকবে? এটাই কারণ। এবারে যা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলুন, আর ডিরেক্ট উত্তরটাই দেবেন। নো মোর কোশ্চেন অ্যাগেইন!”

হৃদিতা একটা ছোট হাই তুলে উত্তর দিল,
“আমার হাত খুলে দিন আগে। হাতে ব্যাথা পাচ্ছি। আর ব্যাথা পাওয়া অবস্থায় আমার মুখ থেকে প্রশ্ন ছাড়া উত্তর বেরোয় না।”

ছেলেটা বিরক্তিতে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে হৃদিতার হাতের বাঁধনটা খুলে দিল।
তারপরে আবার হৃদিতাকে উত্তর দেবার তাগাদা দিতেই সে জবাব দিল,
“আগে প্রমিস মি! আপনি আমাকে আমার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবেন।আপনার বেঁধে টেধে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করার চক্করে আমার কত্ত দেরী হয়ে গেছে দেখেছেন? সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি একা একা এখন কি করে ফিরবো? ফলো করেছেন যখন তখন নিশ্চই আমার বাড়ি চেনেন।না চিনলেও সমস্যা নাই। আমি চিনিয়ে দেব।
এবারে বলুন পৌঁছে দেবেন তো?”

ছেলেটা মাথা নেড়ে সায় জানালেও হৃদিতা মানলো না। নাছোরবান্দা হয়ে বললো,
“না না। এভাবে হবে না।প্রমিস মি। নাহলে যদি সব শুনে আপনি না করে দেন!নো নো। আই ক্যান্ট টেক এনি রিস্ক! প্রমিস করুন!”

ছেলেটা কোমরে দুহাত রেখে কৌতুক করে বরলো,
“আমি যদি এখন প্রমিস করিওবা, তাতে কি?যদি প্রমিস না রাখি আমি? তো? সব শুনে প্রমিস করার পরও আমি না করতে পারি!”

হৃদিতা গাল ফুলিয়ে উত্তর দিল,
“আপনি প্রমিস ব্রেক করে তো দেখুন। দেখবেন কি করি!হুহহহ”

ছেলেটা বিদ্রুপ করে হেসে বললো,
“আচ্ছা, তো কি করবেন? কি করতে পারবেন আপনি? পুচকে একটা মেয়ে, নাক টিপলে দুধ বেরোবে তার আবার কত বড় বড় কথা! ”

হৃদিতা মুখ কুঁচকে জবাব দিল,
“এই এই, কে পুঁচকে মেয়ে হ্যাঁ? আমি? আপনি জানেন আমার বয়স কত? ”

ছেলেটা দুই ভ্রু উঁচিয়ে জবাব দিল,
“কত? শুনি!”

হৃদিতা খ্যাপা বাঘিনীর মতো উত্তর দিল,
“১৭ বছর ৮ মাস ১৯ দিন! আমি মোটেও পুঁচকে না হুম! আর নাক টিপলে কারো দুধ বেরোয় না। নাক টিপলে তো সর্দি বেরোয়। ইউ ডোন্ট নো?”

ছেলেটা মুখের হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন। নাক মুখ শিটকে সে জবাব দিল,
“ছিঃ রিডিকিউলাস থট। ”

হৃদিতা আড়ালে মুচকি হেসে আবার বললো,
“আর প্রমিস ব্রেক করলে কি হবে জানেন? প্রমিস ব্রেক করলে আপনি রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো গুয়ে মুখ থুবরে পড়বেন। তারপরে হলুদাভ গুয়ে জর্জরিত দুর্গন্ধময় মুখটা নিয়ে ঘুরে বেরিয়েন হিমুর মতো হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে।হাহহহ্।”

ছেলেটা পূর্ববৎ নাক মুখ কুচকে বললো,
“হোয়াট? হোয়াট কাইন্ড অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ দিস? গু! ছি! এটা কি ধরনের ভাষা? আর হিমুর সাথে গু! ইয়াক! হোয়াটেভার এটার কি সম্পর্ক? হিমু তো হুমায়ুন আহমেদের লেখা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র!”

হৃদিতা বহুকষ্টে হাসি চেপে রেখে বললো,
“দিস ইজ আ খাঁটি বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ। পিওর বেঙ্গলি, ইউ নো! আর গু শুনে এত ছি ছিক্কার করা তো কিছু নেই। আপনি খাবার খাওয়ার পর প্রয়োজনীয় অংশ পরিশোষিত হয়ে যে অবশিষ্টাংশ আপনার পশ্চাৎদেশ দ্বারা নির্গত হয় সেটাই তো গু। মানে এটা আপনার দেহেরই অংশ। তো এটাকে এত ঘৃণা করার কি আছে?
আর হুমায়ুন আহমেদের সাথে গুয়ের অনেক সম্পর্ক।
উনি ওনার বিভিন্ন লেখনীতে সরাসরি গুয়ের নাম উল্লেখ করেছেন।
বিশেষতঃ উনি ওনার এক উপন্যাসে লিখেছিলেন, হিমু হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে তার কারণ, হিমু সবসময় খালি পায়ে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় থাকা গুয়ে তার পা আটকেও যেত কখনো কখনো। গুয়ের রঙ যাতে বোঝা না যায় সেজন্যই হিমু হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পড়তো, কারণ গুয়ের রঙ হলুদ।
হুমায়ুন আহমেদের মতো অতো বড় মাপের সাহিত্যিক যেখানে বিনা দ্বিধায় গুয়ের কথা তার রচনা সম্ভারে উল্লেখ করে গেছেন, সেখানে আপনি এটাকে কটু দৃষ্টিতে কেন দেখছেন? হোয়াই?”

ছেলেটার নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে হৃদিতা বহু কষ্টে হাসিটা আটকে রাখলেও হৃদিতার কথা শুনে ছেলেটার ভিড়মি খাবার যোগাড়।
সে বুঝলো, এই মেয়ে ডেঞ্জারাস। এর সাথে কথা বাড়ানোই বিপদের সমূহ লক্ষণের মাঝে অন্যতম।
তাই আর গাঁইগুঁই না করে সে বললো,
“ওকে ওকে, প্রমিস। বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসবো! এবারে বলুন!প্লিজ।”

হৃদিতা মুচকি হেসে বলতে লাগলো,
“আসলে কদিন আগেই, আমি কলেজ থেকে ফিরছিলাম। ঐ সময় দিদা মানে কাদম্বিনী দেবী আর ঐ আশ্রমের আরেকটা দিদা হাঁটতে বেরিয়েছিল।
কি যেন চিন্তা করছিলাম আমি তাই পেছন থেকে আসা একটা গাড়িকে লক্ষ্য করিনি।
ঐ সময় গাড়িটা আমাকে ধাক্কা দিতে যাবেই তার আগেই দিদা আমাকে নিয়ে সরে আসে। তবে দিদার হাতের কনুইতে অনেকটা ছঁড়ে যায়।
ঐদিনই প্রথম দেখা। পরে আমি সামনের একটা ফার্মাসি থেকে কিছু ওষুধ আর ব্যান্ডেড নিয়ে ওনার ক্ষতটা ক্লিন করে দিয়ে ওনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে দিই। পথে ওনার সাথে কথা বলে খুব অদ্ভুত একটা টান, মায়া অনুভুত হয় আমার।
বাড়িতে গিয়ে মা কে সবটা জানাই, এটাও জানাই, আমি রোজ একবার গিয়ে দিদার সাথে গল্প করে আসবো।
সবটা শুনে মাও বারণ করেনি।
পরেরদিন দিদার কাছে এসে ওনার সাথে গল্প করে জানতে পারলাম, বহু বছর হলো, দিদা এখানে, পাঁচ-ছ বছর তো হবেই! বড্ড একা লাগে নিজেকে।
আমার কষ্ট হলো। তাই রোজ আমি কিছুটা সময় দিদার সাথে কাটিয়ে ওনার একাকিত্ব টুকু দুর করে একটু আনন্দ দেবার চেষ্টা করি।আমারো সময়টা কেটে যায়।
কোন বন্ধুও নেই আমার, তাই একটু গল্প করারও সুযোগ পাই। এই যা।
আর কিছু না।আমি কোন পাচারকারী টারি না।”

ছেলেটা হালকা হেসে উত্তর দিল,
“আচ্ছা। দুঃখিত। আপনাকে একটু হয়রানিতে পড়তে হলো। তবে সবটা জানা খুব দরকার ছিল আমার।
বুঝতেই পারছেন, এতগুলো বয়স্ক মানুষ থাকে এখানে। তাই আর কি!”

হৃদিতা হালকা হেসে বললো,
“ইটস ওকে। বাট একটু না আপনি আমাকে অনেক বেশি হয়রানিতে ফেলেছেন। যাই হোক, চলুন, এবারে বাসায় দিয়ে আসুন!”

ছেলেটি আর কথা বাড়ালো না। সম্মতি জানিয়ে হৃদিতার সাথে বাইরে এলো।
তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলেও গেল আগের মতোই।
এই একঘন্টার টানা ঝগড়া, খুনসুটি কোনটাই দুজনের জীবনে কোন স্থায়ী দাগ কাটলো না।যে যে তাদের নিজের অভ্যস্থ জীবনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
.
হৃদিতা যখন বাড়িতে ঢুকলো, ঘড়িতে তখন ৭ টা বেজে ৪৫ মিনিট।পা টিপে টিপে মায়ের সামনে যাতে কোনভাবেই না পড়তে হয় সেই উদ্দেশ্যে সে বাড়ির মূল ফটকে দাঁড়াতেই পিলে চমকে তাকালো। মা খুন্তি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
হৃদিতা শুকনো ঢোক গিলে বাড়ির ভেতরে উঁকি মারলো, তাকে বাঁচাবার একমাত্র অবলম্বন বাবার সন্ধানে ব্যাস্ত নয়নজোড়া দিশেহারা হয়ে পড়লো।তবে বাবার দেখা পাবার আগেই টান পড়লো কানে।
টাপুর দেবী অর্থাৎ হৃদিতার মা তাকে কানে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতেই হৃদিতার বাবা ঋতমবাবু স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। হাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দ মাঠ” বইটি ধরে নাকের ডগায় নামানো চশমার ফাঁক গেলে পুস্তক মধ্যস্থ শব্দগুলো উদ্ধার করার মাঝপথেই স্ত্রীকে আদুরে মেয়ের কান ধরে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখে তিনি চমকে উঠলেন,
হাতের বইখানি ডায়নিং টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখেই তিনি হাঁটা দিলেন স্ত্রীকে থামিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করতে।উপন্যাসের পাতায় লুকোনো মনোরম শব্দগুচ্ছ উদ্ধারের চেয়ে তা অধিক মাত্রায় বেশি জরুরী।

টাপুর দেবী ততক্ষণে মেয়ের পিঠে খুন্তির দু ঘা বসিয়ে দিয়েছেন। হৃদিতা অসহায় চোখে দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে আরেকবার সন্ধানী চোখে বাবার খোঁজ করলো, এবারে তার খোঁজ সফলও হলো।।
ঋতমবাবু তড়িঘড়ি এসে স্ত্রীর থেকে মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
“কি করছো কি টাপুর? মেয়েটাকে মারছো কেন? এত বড় মেয়েকে এভাবে মারো তুমি কোন লজিকে! কি করেছে ও? নাহয় একটাদিন একটু দেরী করে ফেলেছেই। দরকার ছিল হয়তো।তাই বলে ওকে মারতে হবে?”

টাপুর দেবী ফুঁসে উঠলেন,
“না মারবো না! তো কি করবো তোমার আদুরে মেয়েকে?সারা দিন টইটই করে রোদে, বৃষ্টিতে ঘুরে চেহারার কি হাল করেছে একবার দেখেছো? এমনিই কালো। তার ওপরে এভাবে দিনকে দিন গায়ের রঙ আরো চটে যাচ্ছে। এমন চললে কে বিয়ে করবে মেয়েকে? বলো? ও যা করে, কিছুতেই তো বাঁধা দিই না। একটু তো আমার কথাটাও শুনতে পারে তাইনা। দুপুর থেকে না খেয়ে আছে, সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হতে বসলো, অথচ, মেয়ের আসার নাম নেই। তাছাড়া এই সন্ধ্যা বেলা একা একা ফিরলো, যদি কেউ কিছু করে দিত? কোন বিপদ হতো তো? দিনকাল ভালো না তাকি জানেনা ও?”

হৃদিতা সিক্ত চোখে একবার বাবার দিকে তো আরেকবার মায়ের দিকে তাকালো। ঋতমবাবু মেয়ের অসহায় মুখখানি দেখে স্ত্রীকে বললেন,
“আচ্ছা, হয়েছে, ভুল করে ফেলেছে আজকে আর হবেনা। এবারের মতো ছেড়ে দাও। ”
টাপুর দেবী আর কথা বাড়ালেন না। হাতে খুন্তিটা কিচেন কেবিনেটের ওপরে রেখে মেয়ের জন্য খাবার বাড়তে লাগলেন।

ঋতমবাবু মেয়েকে এবার আদুরে কন্ঠে বললেন,
“হৃদ। মা? আর মন খারাপ করেনা সোনা। মাই তো। মায়েরা যতটা বকে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভালো বাসে। তুমি তো জানো তাইনা? যাও। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও আচ্ছা? তারপর তোমার সাথে অনেক গল্প করবো!”

বাবার কথায় হাসি ফোটে হৃদিতার মুখে। সে ধীর পায়ে তার রুমের দিকে পা বাড়াবার মাঝেই আবার বাবার গলা শুনতে পায়। কৌতুহল দমাতে না পেরে দরজারই এক পাশে লুকিয়ে পড়ে। শুনতে পায়, বাবা, মাকে বলছেন,
“কতটুকু বয়স মেয়েটার? এখনো অবধি ১৮ তেই পা দেয়নি। এখনি ওর বিয়ে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করার কি কোন মানে হয়? আর জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবটাই তো ভাগ্য। বিধাতা নির্ধারিত। ওর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে টাপুর।
তুমি আমি, সারা জীরন চিন্তা করেও এর সমাধান করতে পারবো না। তারচেয়ে বরং প্রার্থনা করো, যেন মেয়েটার ভাগ্যে সুখ হয়। ভগবান প্রদত্ত কৃষ্ণবর্ণের জন্য যেন ওর সুখের ভাগে কমতি না হয়। বাবামায়ের প্রার্থনা বিফলে যায় না টাপুর!”

স্বামীর কথায় টাপুর দেবী দুর্বল হাসলেন। তবে যতই মনকে বোঝাক মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা যে তার কিছুতেই টলেনা।
সে আর যাই হোক, আমাদের সমাজ ব্যাবস্থার ওপর বিশ্বাসী নন। এ সমাজ যে মেয়েদের খুঁতটাই সবার আগে দেখে।
যদিও কালো গায়ের রঙ কোন খুঁত নয়। এটা সৃষ্টিকর্তার দান। তবুও মানুষ যে তা বুঝবে না। কখনো না।
টাপুর দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা বাবার কথোপকথন শুনে হৃদিতা এক ধ্যানে কিছু একটা ভাবে।
জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে কৃষ্ণ কালো আকাশ। কালো চাদরে ঢাকা আকাশের বুকে ছড়ানো অগুন্তি নক্ষত্ররাজি দেখে সে নিজের মনে প্রশ্ন করে,
” আচ্ছা, দিনের পরে যদি রাত না থাকতো, আর রাতের আকাশটা যদি কালো না হতো, তবে কি চাঁদ তারারা এই আকাশের বুকে তাদের সৌন্দর্যের মহিমা প্রকাশ করতে পারতো? পারতো না তো! দিনের আলোয় যেমন চন্দ্র, নক্ষত্রের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না, রাতের আকাশ কালো না হলেও তেমনই হতো। আর এই বিশাল চরাচরের মানুষ বঞ্চিত হতো সোমরাজ আর নক্ষত্রসম্ভারের এমন মোহনীয় রুপ থেকে।
তাহলে লোকে কেন কালোকে গ্রহণ করেনা? কেন?

হঠাৎ কাদম্বিনী দেবীর বলা কিছু কথা হৃদিতার কানে বাজে। হৃদিতার মনে হঠাৎ একটা সুপ্ত ইচ্ছে মাথা চড়া দেয়। আচ্ছা, তাকে কি কেউ কৃষ্ণকায়া ডাকতে পারেনা? ভালোবেসে আপন করে নিতে পারেনা?
আবার সে ভাবে, দিদাকে কি দাদু ভালোবাসতে পেরেছিল, আপন করতে পেরেছিল!? কৃষ্ণকায়া সম্বোধনটা কি ভালোবাসার ছিল, নাকি বিদ্রুপের?
হৃদিতা উত্তর খুঁজে পায়না।
অতঃপর ভাবুক মস্তিষ্কে সে একটি শব্দের জপ করে যায় অবিরত,
কৃষ্ণকায়া, কৃষ্ণকায়া, কৃষ্ণকায়া!

#চলবে!

[পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা!
প্রথমতঃ দুয়েক পর্ব পড়ে কোন মন্তব্য করবেন না। গল্প সাজাতে হলে অনেক অপ্রয়োজনীয় কথাও গল্পের মাঝে তুলে ধরতে হয়। পাঠকদের হয়তো তা নিছকই গুরুত্বহীন মনে হবে তবুও সেসবের ক্ষীণপরিমাণ গুরুত্ব আছে,থাকবে।
আজকের পর্বটাও এমনই একটা পর্ব!

আর দ্বিতীয়তঃএই গল্পে আমি খানিকটা কঠিন, ও রাসভারী শব্দের ব্যবহার করছি। এটা গল্পের প্রয়োজনেই।
আর এই গল্পটা উপন্যাস হিসেবে লেখা হবে।
আশা করি বুঝতে পারবেন।

পরিশেষে সকলকে শেষ অবধি গল্প পড়ে পাশে থাকার অনুরোধ করা হলো। গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।
ধন্যবাদ সবাইকে। হ্যাপি রিডিং!🧡 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here