প্রিয় অসুখ পর্ব-১৫

0
672

প্রিয় অসুখ
পর্ব ১৫
মিশু মনি
.
১৬
রাত এগারো টা।

বিছানায় শুয়ে আনমনা হয়ে ভাবছে শ্রবণা। হুট করেই আলাদিনের প্রদীপ পাওয়ার মত জীবনে অভাবনীয় কিছু পরিবর্তন চলে এলো। ডিপ্রেশন জিনিসটা নিজের ভেতর থেকে উধাও হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে সমস্ত না পাওয়ার বেদনা। পুরোটা বিকেল মায়ের সাথে মন খুলে আড্ডা দিয়েছে ও। শুধু শীতুলের বিষয় টাই এড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া নিজের যত কথা আছে সবই বলা হয়ে গেছে। এখন নিজেকে অনেক বেশি হালকা লাগছে শ্রবণার। শীতুলের মাকে সত্যিই নিজের মা মনে হচ্ছে। মাকে হারিয়ে আবার পাওয়ার মাঝে যে কি সুখ! শীতুলকে পাওয়ার চিন্তাটাও মন থেকে দূর হয়ে গেছে। শীতুলকে নিয়ে আর নতুন করে কিছু ভাবতে চায় না শ্রবণা। যা হবার তাই হবে।

এমন সময় দরজা খুলে মা ঢুকলেন ঘরে। শ্রবণার কাছে বসতে বসতে বললেন, ‘কি রে একা ভয় করবে? না মা থাকবো সাথে?’

শ্রবণা মাকে জাপটে ধরে বললো, ‘আপনি থাকুন মা। অনেকদিন মাকে জড়িয়ে ঘুমাই না, মায়ের শরীরের গন্ধ নেই না।’
– ‘মা জিনিস টা যে কি, যার নেই শুধু সেই বুঝবে রে।’

শ্রবণা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো, ‘হুম যেমন আমি এখন বুঝি। কোনোদিনো মাকে বলিনি আজকে তোমার রান্নাটা আমিই করি, তুমি খাও। কোনোদিনো মায়ের শাড়িটা ধুয়ে দিয়ে বলিনি, সবসময় তো তুমিই আমার টা করতে আজ নাহয় আমি করলাম। আজ বুঝি মায়ের শূন্যতা। কিন্তু করতে চাইলেও এখন আর উপায় নেই।’

মা শ্রবণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘পাগলী রে, মন খারাপ করিস না। আমি তো আছি। আমি তোর মা না?’

শ্রবণার চোখে পানি চলে এলো। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। গলা ভিজে আসছে। মা শ্রবণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘ঘুমাস না?’
– ‘এত তারাতাড়ি তো কখনো ঘুমাই না। দেরিতে ঘুমানোটা অভ্যেস হয়ে গেছে।’
– ‘এখন থেকে তারাতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে এই বলে দিলাম।’
– ‘আচ্ছা মা। এখন থেকে তাই করবো। খুশি?’
– ‘আমারও আজকে ঘুম আসছে না। চল মুভি দেখি।’

শ্রবণা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। মুভি দেখার কথা শুনে মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। মা মুভি দেখতে খুবই পছন্দ করতো। মাঝেমাঝে শ্রবণাকে এসে বলতো, ‘তোর ল্যাপটপে একটা মুভি দে না দেখি।’ শ্রবণা রাগ দেখিয়ে বিদায় করেছে। আজ মাকে বড্ড মনে পড়ে যাচ্ছে। কেউ আর এমন বায়না করবে না। ইস! মা না থাকাটা যে কি নির্মম কষ্টের।

মা শ্রবণাকে নিয়ে শীতুলের ঘরে চলে এলেন। শীতুল ল্যাপটপে সিনেমা দেখছে আর হাসছে। শ্রবণাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললো, ‘মহারানীর ঘুম নেই?’

শ্রবণা কিছু বললো না। নিরবে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো। শীতুল শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলো। মনোযোগ সিনেমার দিকে। শ্রবণা নরম গলায় বললো, ‘ফরেস্ট গাম্প মুভিটা আছে? আমার মায়ের খুব পছন্দের ছিলো। আজ আমার দেখতে ইচ্ছে করছে।’

শীতুল অবাক হয়ে শ্রবণার দিকে তাকালো। শ্রবণার চোখে মুখে কি যে মায়া এসে ভর করেছে। মাকে মনে পড়লে বুঝি এত মায়াবী লাগে! মেয়েরা বোধহয় ছেলেদের থেকেও মাকে বেশি অনুভব করতে পারে। শীতুল মাথা ঝাঁকিয়ে মুভি বের করতে করতে বললো, ‘বাবাকে মনে পড়ে না?’

শ্রবণার স্পষ্ট উত্তর, ‘মনে পড়ার মত বাবা উনি কখনোই ছিলেন না।’
– ‘বাবাকে ঘৃণা করো?’
– ‘না। বাবাদেরকে ঘৃণা করা যায় না। তবে পছন্দ করতে পারি না।’
– ‘হুম। বসো, মুভি দেখো।’
– ‘মাঝেমাঝে নিজেকে আমার ফরেস্ট গাম্প মনে হয়। আমার গল্প শোনার কেউ নেই।’
– ‘ধরে একটা থাবড়া দেবো, গালের সব দাঁত নড়বড়ে হয়ে যাবে কিন্তু পড়বে না। বুঝবি কি কষ্ট। আর যদি এসব কথা বলিস, ফালতু মেয়ে।’

শীতুলের শাসন দেখে অবাক হয়ে গেলো শ্রবণা। মুহুর্তেই ফিক করে হেসে ফেললো। মা শ্রবণাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লেন। শীতুলকে বললেন, আজ তুই বসে বসে মুভি দেখবি। আমরা শুয়ে থাকবো।
– ‘যথা আজ্ঞা মা জননী।’

শীতুল বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে গিয়ে বসলো। মায়ের কথামতো রুমের লাইট নিভিয়ে তিনজনে মিলে মুভি দেখায় মনোযোগ দিলো। কেউ কোনো কথা বলছে না। মাঝেমাঝে মা দু একটা মহান উক্তি শোনাচ্ছেন। শ্রবণার মুভি ছাড়া অন্য কোনোদিকে মনোযোগ নেই।

হঠাৎ শীতুলের নজর আটকে গেলো একটা দৃশ্যে। পুরো ঘর অন্ধকার। শুধু ল্যাপটপের সামনে শ্রবণার মুখটা আর মায়ের মুখটা আলোকিত। দুজনকে খুবই মায়াবী লাগছে। শ্রবণার চোখ কোনো অজানা কারণে ছলছল করছে। নিশ্চয় মায়ের সাথে জড়িয়ে থাকা কোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। এই বুঝি টুপ করে গড়িয়ে পড়বে। শীতুল অনেক্ষণ চোখ সরাতে পারলো না। শ্রবণার ছলছল চোখের সৌন্দর্যে বুদ হয়ে রইলো। অন্যরকম মায়া অনুভব করছে শ্রবণার প্রতি। মেয়েরা কাঁদলে তাদেরকে ভালো দেখায় না, কিন্তু ছলছল চোখে অপূর্ব লাগে। সমস্ত মায়া যেন সেই চোখে এসে চোখের জলে আটকে থাকে।

শ্রবণা আচমকা চোখ ঘোরাতেই অন্ধকারে বসে থাকা শীতুলের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। যদিও শীতুলের মুখটা তেমন আলোকিত নয়, তবুও আবছা আলোয় শ্রবণার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে শীতুল ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। বুকটা ধক করে উঠলো শ্রবণার। চোখের পাপড়ি ফেলতেই জল গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। হন্তদন্ত হয়ে সেই জল মুছলো ও।

রাত একটা বেজে গেলে মা বললো, ‘আমার তো ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু করছে। চোখ মেলে রাখতেই পারছি না। আমি বরং গিয়ে ঘুমাই।’

শীতুল বললো, ‘মা, তুমি এখানেই ঘুমোও। আমি ওই রুমে গিয়ে ঘুমাবো। শ্রবণা তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।’
– ‘এখনো ঘুম আসছে না।’
– ‘আমারও আসছে না। মা তো ঘুমাবে।’

মা উঠে বসতে বসতে বললেন, ‘তাহলে তোরা মুভি দ্যাখ, আমি গিয়ে ঘুমাই। শ্রবণার ঘুম পেলে চলে আসিস।’
– ‘আচ্ছা মা। আমিও যাই?’
– ‘মুভি দ্যাখ। শেষ করে আসিস।’

মা শ্রবণাকে রেখে বেরিয়ে গেলেন। এত রাতে অন্ধকার ঘরে শীতুলের সাথে একা বসে আছে ভাবতেই পারছে না শ্রবণা। বুকের ভেতর ধুকধুকানি বাড়ছে। চারদিক এত বেশি নিস্তব্ধ যে মুভির সাউন্ড বন্ধ করে দিলে শীতুলের নিশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শোনা যাবে। শ্রবণা ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে।

শীতুল বললো, ‘আমি তোকে তুই করেই বলবো। আপনি তে আমার বিরক্তি চলে আসে।’
– ‘আচ্ছা আপনার যা ইচ্ছে।’
– ‘তুমি আমাকে তুই বলতে পারিস। এই যা, তুমি আর তুই এক হয়ে গেছে। হা হা হা।’

শ্রবণাও মুচকি হাসলো। এখন আর সিনেমার দিকে মনোযোগ নেই। শীতুলের উপস্থিতি ওর হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেমন যেন ছটফট লাগছে। নাহ, এখানে আর থাকা যাবে না। কিন্তু এখানে থাকতেও ভালো লাগছে।

শীতুল বললো, ‘দ্যাখ, ডিপ্রেশন জিনিসটা আমরাই টেনে আনি। তুই জাস্ট ভাববি তুই অনেক ভালো আছিস। অন্য সবার থেকে অনেক সুখে আছিস। তাহলেই আর কোনোকিছু নিয়ে মন খারাপ হবে না। এমনও অনেক মেয়ে আছে যারা ইয়াতিম। বাবা মা কেউ নেই। ওরা রাস্তায় ঘোরে আর ভিক্ষা করে। ফুল বিক্রি করে। ওদের তুলনায় তো ভালো আছিস। এসব ভাবলে আর কষ্ট হবে না দেখিস।’

শ্রবণা চুপ করে শুনলো শীতুলের কথা। এখন আর একটুও কষ্ট নেই মনে। মনে হচ্ছে সব পেয়ে গেছে। অন্তত মা কে তো পেয়েছে ই, পাশাপাশি শীতুলকে প্রতিদিন সারাক্ষণ দেখতে পারছে এটাই বা কম কিসে?

শীতুল জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ভাবছিস?’
– ‘নাহ তেমন কিছু না। যাই বরং গিয়ে ঘুমাই।’
– ‘ঘুম চলে এসেছে? যা তাহলে। সকাল সকাল উঠিস। বাসার পাশে শিউলি গাছ আছে। ফুল কুড়াবো।’
– ‘সত্যি!’
– ‘হুম। আমার সব’চে পছন্দের ফুল।’

শ্রবণা খুশি মনে হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে থেকে পড়ে গেলো। শীতুল হাত ধরে টেনে তুলে বললো, ‘দেখে চলবি না?’
– ‘হ্যাঁ, এখন থেকে চলবো।’
– ‘শ্রবণা, তোর চোখ দুটো অনেক মায়াবী রে।’

আচমকা এমন কথা শুনে হৃদস্পন্দন হুট করেই অনেক বেড়ে গেলো। লজ্জায়, উত্তেজনায়, বিস্ময়ে এক ছুটে নিজের ঘরে চলে এলো শ্রবণা। শীতুল কি সত্যিই তাহলে ধীরেধীরে শ্রবণার প্রেমে পড়তে আরম্ভ করেছে.. কে জানে! উফফ্! হার্টবিট হচ্ছে, খুব জোরে বিট হচ্ছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here