প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-১০

0
977

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১০.

গরমে খাঁ খাঁ করা নিস্তব্ধ দুপুর। মাঝে মাঝে দুই একটা কাক ডেকে ডেকে উঠছে। স্টাডিরুমটা পুরনো দিনের হলেও বেশ ঝা চকচকে। বিশাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বুকশেলফটা। সেখানে প্রথম সারিতেই
সসজ্জিত হয়ে নজর কারছে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ দ্বিতীয় সারিতে একে একে নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্রের নানান উপন্যাস শোভা পাচ্ছে। যদিও মনোরোম পরিবেশ। তবুও, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে মেহতিশার। সামনের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে কাঁপা হাতে সম্পূর্ণটা শেষ করে ফেলে। তৃষ্ণার জোয়ারে ভাসছে গলদেশ। যেনো তেনো তৃষ্ণা নয়।
ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। সামনেই শামীউল্লাহ জামান চশমা চোখে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। হাত দিয়ে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছেন।

মেহতিশা সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে ছাঁদে গিয়ে ঘুরছিলো। দর্পণ ঘরেই তখন। আশফিন এসে কোথা থেকে দৌড়ে বলল,

‘তিশাপি, তোমাকে বড় চাচ্চু ডাকছে তার স্টাডিরুমে। ‘

মেহতিশা ভাবুক গলায় বলল,

‘কীজন্য ডাকছে জানিস?’

‘সেটা তো বলেনি। ‘

‘আচ্ছা তুই যা, আমি আসছি। ‘

মেহতিশা ঘেমে ওঠে। এরকম জরুরি তলবে কেন ডাকলো! এমন ভাবেই আজ থেকে দশ দিন আগে ডেকেছিলেন তিনি। জীবনের মোড় আচমকা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। না চাইতেও বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয়েছিলো, নাহলে এতোদিনে বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে সুদূর জার্মানে থাকতো সে। নিজের আর্কিটেক্ট হওয়ার সপ্ন পূরণ করতো। যেতে পারেনি শুধু মাত্র এই বিয়ের জন্য। তাই তো এতোটা রাগ কাজ করে দর্পণকে দেখলে। যতবার তাকায় ততবার মনে হয়, যদি দর্পণ তার জীবনে না আসতো তাহলে এসব সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে দূরে গিয়ে ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে পারতো। হাহ! মেহতিশা তারপর ভাবতে ভাবতে স্টাডিরুমে এসে বসে। না জানি কী বলবে! ভেবে ভেবে অস্থির লাগে তার।

শামীউল্লাহ টানা দশ মিনিট তাকিয়ে থাকার পর স্মিত হেসে বললেন,

‘ভয় পাচ্ছো নাকি মা?’

মেহতিশা ঘাবড়ে বলল,

‘ককই নাতো! ‘

‘হাহাহা, যাকগে। ‘

তিনি ফাইলের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে মেহতিশার দিকে বাড়িয়ে দিলেন৷ মেহতিশা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে সেটা হাতে নিলো। পিলে চমকে উঠলো তার। একটা ডিভোর্স পেপারের এপ্লিকেশন । মেহতিশা বিস্মিত চোখে বাবার দিকে তাকালে তিনি বললেন,

‘চমকাচ্ছো কেনো? তোমাকে তো আগেই বলে দিয়েছি, এই বিয়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই দলিল গুলো হাতে আনা। সেগুলো আনলে তবেই তো আমরা সেই ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ গুলোকে সাহায্য করতে পারবো।’

মেহতিশার চোখ দু’টো ঘোলা হয়ে আসে। মাত্র তিনদিনের সম্পর্কে এক অদ্ভুত টান অনুভব হচ্ছে তার। ছয় মাস হলেই দর্পণ নামের মানুষটার থেকে আলাদা হয়ে যাবে, ভাবলে মনটা কেমন করে ওঠে।
সে ঘোলা চোখে করুণ দৃষ্টিতে বলে,

‘বাবা, এর কোনো বিকল্প নেই? ‘

‘মানে! এক মিনিট তুমি আবার অন্য কিছু ভাবছো না তো? মেহতিশা কান খুলে শুনে রাখো, তোমাকে এই বিয়ে দেয়ার কারণ হচ্ছে তুমি দর্পণকে তোমার জালে আবিষ্ট করে ধ্যান সরিয়ে সেই পুরনো কোম্পানির সব কাগজপত্র নিয়ে চলে আসবে। দর্পণ বিন্দু মাত্র টের পাওয়ার আগেই আমরা সব সামলিয়ে ফেলবো। তোমাকে আর কিছু করতে হবে না, তোমাকে এরপর আমি জার্মান পাঠিয়ে দেবো। তবে হ্যা, যদি তুমি কাগজপত্র যদি না আনতে পারো তাহলে জার্মানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখো না। মনে রাখবে, দর্পণ শুধু আমাদের ক্ষতিই করেনি সঙ্গে তোমার মেঝো চাচার প্রাণও নিয়েছে। আমার ভাইটাকে প্রাণে মেরেছে এর হেস্তনেস্ত তো হবেই। ‘

মেহতিশা মূর্তির মতো মাথা নাড়িয়ে উঠে যায়। গায়ে তেমন শক্তি পাচ্ছে না সে। ঘর থেকে বের হতে হতে বিরবির করে বলে,

‘আজ যদি সত্যিকারেই তোমার মেয়ে হতাম তাহলেও কী আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে?’

গাড়ির চাকা আবারও ঘুরছে। পথযাত্রা শেখ মহলের উদ্দেশ্যে। নাইওরের পালা শেষ হয়েছে। এবার মেহতিশা ও দর্পণ ফিরছে নিজ নীড়ে। আসলে, শুধু দর্পণের। মেহতিশার মতে সে নীড়হীনা। সে ভেলার মতো ভাসতে থাকে এদিকে ওদিকে। বেশি ভার হলেই ডুবে যায়। আবারও কোনো রৌদ্রস্নাত দিনের অপেক্ষায়।
বাসায় ফিরে সবার সাথে কথা বলে ঘরে আসে মেহতিশা। দর্পণ হুইলচেয়ার চালিয়ে ওয়াশরুম থেকে বাহির হয়। হাত মুখ ধুয়ে এসে খাবারের থালা হাতে নেয়। মেহতিশা হঠাৎ করেই বলে,

‘আমাকে দিন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ‘

দর্পণ চকিতে তাকায়। মনে মনে কিছুটা সন্দেহ হলেও ভীষণ খুশিও হয়। মেহতিশা হাসিমুখে এগিয়ে আসলো। হাতে প্লেটটা নিয়ে এক লোকমা ভাত তুলে মুখের সামনে ধরলো৷ দর্পণের চোখের ভাষা পড়তে পারলো মেহতিশা। বুঝতে পারলো, দর্পণ ভাবছে সে হা করলেই মেহতিশা খাবার সেদিনের মতো ফেলে দেবে।
মেহতিশা ফিক করে হেঁসে বলল,

‘আজ ফেলবো না জনাব। ‘

দর্পণ একটু ভরসা পেয়ে হা করে। মেহতিশা সযত্নে মুখে তুলে দেয়। দর্পণ ভাবে, তবে কী ধীরে ধীরে মেহতিশা তাকে মেনে নিতে শুরু করলো! যদি সত্যি হয় তাহলে, এসব ভেবে মনে প্রচুর আনন্দ অনুভব করে সে। দর্পণ মেহতিশা দু’জনেই খাবার শেষ করে নেয়। বহুদিন পর যেনো দর্পণ মন খুলে কথা বললো মেহতিশার সঙ্গে। মেহতিশার প্রাণোচ্ছল বাক্য দর্পণের লুকানো বাচ্চামো স্বভাব বের করে আনলো। সব কাজকর্ম শেষে রাতে শোবার সময়, দর্পণ একটু দ্বিধা রেখে এক পাশে শুয়েছিলো। মেহতিশা লাইট নিভিয়ে
টুপ করে দর্পণের হাত জড়িয়ে বাহুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। দর্পণ মুচকি হাসলো। মেহতিশার মাথায় হাত রেখে মনে মনে বলল,’ভালোবাসি’। অথচ অপর দিকে মেহতিশা বাঁকা হেসে বলল,

‘আম সরি দর্পণ শেখ। ‘

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here