প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-১৪

0
887

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১৪.

‘মৃত্যু’ কী ছোট্ট একটা সহজ শব্দ, কিন্তু সত্যিকারেই কী এর অর্থ সামান্য? মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণী। একটা উক্তি আছে, মানুষ এমনভাবে বাঁচে যেনো তার কখনো মৃত্যু হবেনা। অথচ,মৃত্যুর পর মনে হয় যে তার কোনো কখনো পৃথিবী বুকে অস্তিত্বই ছিলো না। কতটা অস্তিত্বহীন হয় মানুষ মৃত্যুর পরে।

শামীউল্লাহ জামান থরথর করে কাঁপছেন। তার কল্পনাতেও কখনো তিনি এতো ভয়াবহ দৃশ্য দেখেননি। গায়ের প্রতিটি লোমকূপ তাঁকে জানিয়ে দিচ্ছে, সামনে ভয়ঙ্কর পরিণাম তার জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি কপালের ঘাম মুছলেন৷ বাড়ির সামনের
খাটিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। সেদিকে ঠিক ঠাক মতো তাকাতে পারছেন না তিনি। যতবার তাকাচ্ছেন, রূহ কেঁপে উঠছে। কী নিষ্ঠুর মৃত্যু দিয়েছে ছেলেটাকে! সবুজ নামের ছেলেটার কাটা মাথাটা পড়ে আছে খাটিয়ায়। তাও অক্ষত নয়। উপরিভাগটা কেটে চুল ফেলে দেয়া। বাকি শরীরটা যে কোথায় আছে কেউ হদীস জানেনা। এর থেকেও ভয়ের ব্যাপারটা হচ্ছে, সকাল ভোর ছয়টায় হঠাৎ করেই সদরদরজায় টুং করে কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলেছিলো মেহতিশার মা। একটা কার্টুন বক্স দেখে কৌতূহল বশত খুলেছিলেন। ভেতরের মাথাটা দেখা মাত্রই চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। শামীউল্লাহ জামান বক্সটা হাতিয়ে দেখলেন, সেখানে একটা চিরকুটও লেখা আছে। কাঁপা হাতে কাগজটা খুলে দেখলেন রক্ত দিয়েই সেখানে কিছু লিখে রাখা। পেচানো হাতে লেখা,

‘কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। তোর পাঠানো সামান্য ছেলেটার যদি আমি এই অবস্থা করতে পারি। চিন্তা কর, আমি তোকে কী করবো।’

ভেবে আরেকদফা গলা শুকিয়ে আসলো শামীউল্লাহ জামানের। এই কাজ যে কে করেছে বুঝতে পারছে না।
তবে সন্দেহের তীর একজায়গায় ঠিকই গিয়ে লেগেছে। তিনি তৎক্ষনাৎ ফোনটা হাতে নিলেন। ডায়ালে গিয়ে মেহতিশাকে কল করলেন।

ডক্টরের কাছ থেকে চেক আপ করিয়ে মাত্র বাসায় ফিরলো দর্পণ আর মেহতিশা। দর্পণের পায়ের অবস্থার জন্য প্রতি মাসে একবার করে চেকআপ করে
আনতে হয়। প্রত্যেক বার বাবার সাথেই আসে সে। এবার মেহতিশা নিজেই বললো, সেই সাথে আসবে।
ডক্টর দেখিয়ে বাসায় এসে গোসলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো দর্পণ। মেহতিশা দর্পণের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো গুছিয়ে দিলো। একজন সার্ভেন্ট প্রতি দিন দর্পণের গোসলের সময় তাকে সাহায্য করে। মেহতিশা যদিও সাথে সাহায্য করতে চায় কিন্তু দ্বিধায় এগিয়ে যেতে পারে না। অতএব, দর্পণ ওয়াশরুমে ঢোকার পর মেহতিশা বিছানা গুছিয়ে নিয়ে বের হচ্ছিল। পেছনে মোবাইলের রিংটোনে ফিরে আসলো।
মোবাইলটা উঠিয়ে “বাবা” নামটা দেখতেই কপালে ভাজ পড়ে। মেহতিশা দোনোমোনো করে কলটা রিসিভ করে। কানে ধরতেই ভেসে আসে উত্তেজিত কন্ঠ-

‘মেহতিশা, তুমি এখন থেকে আরও সাবধানে থাকবে! কোনোরকম ভুল করবে না। ‘

মেহতিশা ভড়কে যায়। বুঝতে না পেরে বলে,

‘কী হয়েছে বাবা? ‘

‘সবুজ মারা গেছে। ‘

‘কে সবুজ?’

‘আরে! যাকে আমি দর্পণের দিকে নজর রাখতে বলেছিলাম। ‘

‘আশ্চর্য! বাবা, আমি তোমাকে বলেছি দর্পণের উপর আমরা সন্দেহ করে কিছু করতে পারিনা। তুমি আমাকে বিয়ে দিয়েছো শুধু মাত্র সন্দেহ করে। মেনে নিলাম,সেই কাগজটা যদি আমি পাই তাহলে দর্পণ অপরাধী কিন্তু না পেলে আমি কখনোই বিশ্বাস করবো না সে এমন কিছু করেছে আর না চাচাকে মেরেছে। আর দর্পণ যদি ভুল কিছু না করে আমি তাকে কখনোই ছাড়বোনা। ‘

রাগান্বিত কন্ঠে সম্পূর্ণ কথাটা বলে নিজেই চমকে উঠলো মেহতিশা। বুঝতে পারলো, দর্পণ নামক রহস্যময় মানুষটার সঙ্গে থাকতে থাকতে কতোটা মায়ামমতা জন্মে গেছে। সে কী দর্পণকে ভালোবেসে ফেললো! ধ্যান ভাঙে শামীউল্লাহ জামানের কথায়।

‘মেহতিশা! ভুলেও এমন কিছু করবে না তুমি। আমাকে তুমি যেমনটা কথা দিয়েছো তেমনটাই হবে। তোমার কাছে সময় ছয় মাস। তারপর আশা করি বাকীটা তোমাকে বুঝিয়ে দিতে হবেনা। ‘

শামীউল্লাহ জামান ফোন রাখলেন ক্রোধ নিয়ে। রাগ উঠে গেলো তার। কী বোকা মেয়েটা! দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন তিনি। মেয়েটাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন নিজ হাতে। মেহতিশা ঠিক নারকেলের মতোন। বাহিরে শক্ত রাগী দেখালেও দুটো মিষ্টি কথায় গলে পানি হয়ে যায়। সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে। বড্ড ভালোওবাসেন তিনি। পৃথিবীতে সে একজন খারাপ মানুষ হতে পারেন। কিন্তু খারাপ বাবা বলা যায় না। পরিস্থিতির চাপে পড়ে মেহতিশাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। তবে, জোর দিয়ে হলেও সেখান থেকে বের করে আনবেন। বোকা মেয়েটা হয়তো নিজেও বুঝতে পারছেনা, কী ভয়ঙ্কর ফাঁদেই না সে পা দিয়েছে। পুরো দাবা খালায় সামন্য একটা গুটি মাত্র মেহতিশা।

চোখ দুটো টলটল দীঘির জলের মতো উপচে এলো মেহতিশার। নাক ফুলিয়ে কান্না দমালো সে। বিয়ের কদিন আগ থেকে এ পর্যন্ত কী কর্কশ আচরণই না করছেন তিনি। অথচ, ছোট বেলায় একটা ফুলের টোকাও গায়ে লাগতে দেননি তিনি। পদে পদে বুঝিয়ে দিচ্ছেন,পর কখনো আপন হয়না। মেহতিশা তবুও চুপ থাকে। তবে রাগ দমাতে পারেনা। দর্পণকে সে সেই প্রথম দিন থেকেই প্রচন্ড ধমকা ধামকির উপর রেখেছে। পায়ে পায়ে দোষ ধরেছে। সন্দেহ নিয়ে কথা শুনিয়েছে অযথাই। কিন্তু সত্যি হলো, এ পর্যন্ত কোনো সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পায়নি। তাহলে শুধু শুধু কেনো সে দর্পণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে? এর তো কোনো মানেই হয়না। নিজের মনকেই সবশেষে প্রশ্রয় দেয় মেহতিশা। এখন মনে মনে দর্পণকে আগের মতো সন্দেহ চোখে দেখেনা। বিশ্বাস যেনো অন্তঃকরণে ঠাই পেয়েছে পাকাপোক্ত ভাবে। সে বিশ্বাস নিজ হাতে সযত্নে রোপণ করেছে দর্পণ। সেখানে হাজার হাজার সন্দেহজনক তীরও ঠুনকো মেহতিশার কাছে। এতোটা বিশ্বাস কীভাবে নিজের প্রতি তৈরি করেছে দর্পণ কে জানে! এখন মেহতিশার মনে হয় সে প্রেমে পড়েছে। দর্পণ নামক মিষ্টি হাসির মানুষটার দিকে তাকালে এখন আর কোনো বিরক্তি কাজ করেনা। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকতে প্রাণভরে ভালোবাসতে।

কিন্তু, বাবার কারণে বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে অক্ষম হয় সে। মেহতিশা মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস রেখে ঠিক করেছে।
সে ততোদিন পর্যন্ত দর্পণকে মনের কথা বলবে না, যতদিন না দর্পণকে সে নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারে। মেহতিশা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, দর্পণ কখনোই এতোটা হিংস্র হতে পারেনা। আচ্ছা, যে মানুষটা হুইলচেয়ার ছাড়া উঠতেও পারেনা সে কীভাবে এতো বড় কাজ করবে!আজ রাতই সে তল্লাশি করবে। তারপর বাবার সামনে হাসিমুখে বলবে, “বাবা, আমি বলেছিলাম না, দর্পণ খুব ভালো একজন মানুষ। সে কখনোই এমন করতে পারেনা। ” ভেবে আলতো হাসে সে।

আঁচলে টান লাগতেই পেছনে ফেরে। দর্পণের স্নিগ্ধ নিষ্পাপ মুখটা চোখে পড়ে। মেহতিশা হাসি লুকিয়ে বলে,

‘চুল মোছেননি কেনো? ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘

‘আপনি মুছে দিন। ‘

মেহতিশা লজ্জা পায়। দ্বিধা কাটিয়ে সাইড থেকে টাওয়াল উঠিয়ে নেয়। ঝুঁকে টাওয়ালটা নিয়ে মুছে দিতে থাকে। দর্পণের মুগ্ধ দৃষ্টি জোড়া তখন মেহতিশার দিকে আবদ্ধ। মেহতিশা মনোযোগ দিয়ে যত্ন করে চুল মুছে দিচ্ছে। দর্পণ আচানক মেহতিশার কোমর টেনে কোলে বসিয়ে নিলো। মেহতিশা ধরফর করে উঠতে নিলেই দর্পণ, মেহতিশার হাত দুটো চেপে ধরে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে তাকায়। মেহতিশা দৃষ্টি নত করে রাখে।
অস্বস্তিতে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে দর্পণ। দুষ্ট ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে দেয় মেহতিশার কোমল গালে। ক্ষণকাল কেটে যায়। মেহতিশা একটু স্বাভাবিক হয়ে একটা প্রশ্ন করে,

‘আপনি প্যারালাইজড কবে থেকে দর্পণ?’

দর্পণের চোয়াল শক্ত হয়। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘দুই বছর ছয় মাস থেকে। ‘

মেহতিশার কলিজায় কামড় লাগে। ঠিক দুই বছর ছয় মাস আগেই তো মেঝো চাচার মৃত্যু হয়েছিলো!

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

(ভাবছিলাম কথাটা বলবো না। তবে কিছুটা বাধ্য হয়েই বলছি, আমার পুরনো পাঠকরা জানেন যে এই গল্পটার আগে যত গল্প ছিলো সবগুলোই আমি রোজ দিতাম। সমস্যা না হলে নিয়মিতই। কিন্তু এই গল্পটা একদিন, দুইদিন পর পর দিচ্ছি। কারণটা হচ্ছে, আমি এক বসায় লিখতে পারছিনা৷ আমি মোবাইল বা পড়াশোনার জন্য চশমা ব্যবহার করি। কয়দিন আগেই সেটার পাওয়ার বেড়েছে। এখন চশমা পড়লেও আমার চোখে পুরোপুরি সেট হয়নি। হঠাৎ করেই মাথা ব্যাথা শুরু হয়, চোখ ঝাপসা দিয়ে আসে। জানি, ছোট পর্ব পড়তে ভালো লাগে না। আমারও ছোট পর্ব দিতে ভালো লাগে না। কিন্তু যখন দুইদিন কেটে যাওয়ার পরও আমি ঠিক ভাবে তাকিয়ে লিখতে পারিনা তখন বাধ্য হয়েই দেই। একটু কষ্ট করুন ক’টাদিন। চার পাঁচ দিন পর থেকে আমি ইনশাআল্লাহ বড় করেই দিবো। “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here