প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-১৬

0
965

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১৬.

সুখময় প্রেমে অঢেল বর্ষণে মাখো মাখো সময় তখন।
সবটাই যেনো স্বপ্নের মতো সুন্দর। ভয়ঙ্কর সুন্দর। এ যেনো ছোটবেলার ফেইরিটেইলের রূপকথার গল্প। যেখানে রঙ বেরঙের লাল-নীল পরীরা জাদুর কাঠি দিয়ে দুঃখ কষ্ট মুছে দেয়। ছোঁয়া দিয়ে সুখের পরশ ছড়ায়।
দিনের শুরুটা হয় ভালোবাসার চুম্বনে ও শেষ প্রহরের
সমাপ্তি হয় অজস্র সুন্দর মুহুর্তে। কখনো বারান্দায় বসে তো আবার কখনো চন্দ্রবিলাস করে। সংসারের মধ্যমণি এখন মেহতিশা। দর্পণের বাবা,মা,নিশিতা তারা মেহতিশা বলতে পাগল। এমনকি দিয়াও এখন তেমন অপছন্দ করেনা তাকে। মেহতিশার সঙ্গে সময় পেলেই গল্পের আসর জমায়। মেহতিশার দিনগুলো হাসিখুশি ভাবেই কাটছে। যে বাড়িটা ও বাড়ির মানুষ গুলোকে সহ্য হতো না। লাগতো অসহ্যকর। এখন তাদেরই দিনদিন আপন মনে হয়। আগে যাদেরকে নিয়ে দুদন্ড মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেনি। এখন তাদের সঙ্গেই আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

কষ্টটা শুধু একজায়গায়ই। দর্পণের পা দুটো। সব সুখ গুলো ফিকে পড়ে যায় দর্পণের অসুস্থার নিকট। মেহতিশার বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে নিজের ভাগ্যল৷ কে দোষারোপ, হাহুতাশ করতো এই ভেবে যে একটা পঙ্গু লোকের সঙ্গে কীভাবে সারাজীবন কাটাবে সে! কিন্তু এখন সেই ভাবনা আর আসেনা। এখন মনে মনে কষ্ট হয় দর্পণের কষ্টে। প্রার্থনা করে, মানুষটা যেনো সুস্থ হয়ে ওঠে। সেই দিনটা হবে মেহতিশার কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন। যখন আর পাঁচটা মানুষের মতো দর্পণও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। ইচ্ছে মতো চলাচল করতে পারবে। এইজন্য মেহতিশা চিন্তা করলো, সে নিজেই এর দায়িত্ব নিবে ৷ এসব ভেবে ঘরে বসে মেহতিশা মোবাইলটা হাতে নিলো। কল করলো নিজের মামাতো ভাই মহসিনকে। যে কিনা কয়েকদিন আগেই লন্ডন থেকে এমবিবিএস করে এসেছে। এখন বেশ ভালো একটা হসপিটালের ডক্টর। মেহতিশা কল করলো তাকে। রিসিভ হতেই ওপার থেকে ভেসে এলো –

‘হেলো, বল মেহতিশা। কেমন আছিস?’

মেহতিশা মুচকি হেসে বললো,

‘ভালো আছি ব্রো। তুমি কেমন আছো? ‘

‘এই তো বেশ। ভাইকে তো ভুলেই গেছিস। ‘

‘আমি ভুলে গেছি! তুমি তো ব্যস্ত মানুষ। তোমার সাথে কথা বলতে এখন টিকিট কাটতে হয়। মোটা অঙ্কের ফিস না দিলে তোমার দেখা পাওয়া মুশকিল! ‘

‘হাহাহা, তুই আগের মতোই রয়ে গেলি। কথায় কথায় বমের মতো রেগে যাস৷ এমনিই কী আর সৌজন্যে তোকে চকলেট বম নাম দিয়েছিলো! ‘

হাসতে নিয়েও থেমে গেলো মেহতিশা। ওপাশ থেকে মহসিনও বুঝতে পারলো। সে বললো,

‘হ্যারে মেহতিশা, তুই তো পারতি সৌজন্যেকে একটা সুযোগ দিতে! ‘

মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

‘তুমি এই কথা বলছো কীভাবে !’

‘দেখ, সৌজন্যে তোকে কতটা ভালোবাসতো তা আমাদের কারোই অজানা নয়। ছোট্ট বেলা থেকে ছেলেটা তোকে না দেখলে পাগলের মতো করতো। আর তোরও যে ওকে অপছন্দ ছিলো, বলতে পারবি কখনো? ‘

‘অস্বীকার করবো না, সৌজন্যকে প্রথমে আমি শুধু মাত্র ভাইয়ের নজরে দেখলেও, ও যখন বিদেশ থেকে এলো তখন আমারও কিছু একটা ফিল হয়েছিলো। কিন্তু সেসবে আমি পাত্তা দেইনি। প্রথমত সৌজন্যে আমার চেয়ে বয়সে ছোট। তারপর.. ‘

‘তুই এখনো নিজেকে অনাথ ভাবিস!’

মেহতিশার চোখ টলমল করে। সে হাত দিয়ে চোখ মুছে বলে,

‘যতই হোক, আমি তো অনাথই। যদি নিঃসন্তান দম্পতি শামীউল্লাহ জামান আর আপন খালা ফেরদৌসি জামান আমাকে মা বাবা মারা যাওয়ার পর সেই বাড়ি না নিয়ে যেতেন তাহলে কী এই মেহতিশা বেঁচে থাকতো! ‘

গলা ভেঙে যায় মেহতিশার। নিজের আসল পরিচয় ভিন্ন। ফেরদৌসির বড় বোন শাওমির একমাত্র মেয়ে মেহতিশা। মেহতিশার জন্মদাতা পিতা মাঈনুল হোসেন বড় একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। তখন মেহতিশার এক বছর, তিনি একদল সন্ত্রাসীকে শাস্তি দিয়েছিলেন। তারই ক্ষোভে একরাতে মেহতিশার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় সন্ত্রাসীগুলো। মেহতিশাকে সেখানে থেকে উদ্ধার করে বাড়ির দারোয়ান। ফেরদৌসি বন্ধ্যা। আর শামীউল্লাহ জামানেরও কিছু সমস্যা আছে তাই দুজনই পরবর্তীতে মেহতিশাকে নিজের সন্তানের পরিচয় দিয়ে বড় করে তোলেন।

পুরনো কথা মনে পড়ে মেহতিশার। সে তো ছোট ছিলো তাই কিছুই তার মনে নেই। সবটা কিশোরী বয়সে থাকতে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাদী আর বড় চাচীর আলাপ করার সময় সে জেনে যায়। পরে কান্না করার জন্য সবাই তাকে এসব মজা করে বলেছে বলে সান্ত্বনা দিলেও, সত্যিটা বোঝার ক্ষমতা ছিলো মেহতিশার।

ফোনের ওপাশ থেকে মহসিন উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,

‘মেহতিশা, তুই কী পারতি না সৌজন্যেকে বলে একসাথে পালিয়ে আসতে। আমি নিজেই তোদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করে রাখতাম। তুই তো কখনো নিজের উপর অন্য কারো মত মানিস না। তুই যদি রাজি না হতি, রাগ দেখিয়ে চলে যেতি তাহলে কী পারতো কেউ তোকে বিয়ে দিতে? ‘

মেহতিশা ভাঙা গলায় বললো,

‘আমি চাইলেই পারতাম বাবার মুখের সামনে না করে চলে যেতে। কিন্তু আমি ওই পরিবারটার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। ছোটবেলায় বাবা যদি আমাকে নিজের পরিচয় দিয়ে লালন পালন না করতেন আমি মরে যেতাম হয়তো। ‘

মহসিন কথা আর বাড়ালো না। সে নিরস গলায় বললো,

‘আচ্ছা। বাদ দে। আর বল হঠাৎ আজ কী মনে করে কল দিলি? ‘

‘ওহ হো! আমি ভুলেই গেছি। তুমি তো জানোই দর্পণের পায়ের অবস্থা কী। তুমি তো অনেক ভালো ডক্টর। কী ধরনের ট্রিটমেন্ট নিলে দ্রুত সেরে উঠবে তা বলো। ‘

‘হুম, আচ্ছা শোন। আমি আগে রিপোর্ট দেখবো। তুই কালকে আমার কাছে আসবি, রিপোর্ট দেখে আমি ঔষধ দেবো। ‘

‘ঠিক আছে ভাইয়া, রাখছি তাহলে। কালকে আসবো আমি। ‘

তারপর দিনই রিপোর্ট দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে আসে মেহতিশা। দর্পণকে নিজ হাতে ঔষধ খাওয়ায়। এবার সেও দেখবে কীভাবে দর্পণ সুস্থ না হয়!

দুপুরের খাবারটা রান্না করে মেহতিশা তখন টেবিলে সাজাচ্ছে। দিয়া বসে মোবাইল টিপছিলো। লালিমা শেখ ফল কাটছিলেন। আর দর্পণ অফিসের ম্যানেজারকে কিছু কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। সারাক্ষণ বাসায় থাকলেও দর্পণ কাজের দিকে সম্পূর্ণ নজর রাখে। পাই টু পাই হিসাব দিতে হয় প্রতিটি কর্মচারীকে।
অনলাইনে প্রেজেন্ট নেয় শিক্ষকের মতো সে। সিসি টিভি ক্যামেরায় নজর রাখে চারজন কর্মকর্তা। অতএব, কাজ থেকে অব্যাহতি নেই কারো। দর্পণ তখন গম্ভীর অভিব্যাক্তিতে কথা বলছে। চমকে উঠলো ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভেঙে যাওয়ার। সবাই বিস্মিত চোখে তাকালো সেদিকে। কাঁচের প্লেটটা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর পাশেই অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে মেহতিশা। দর্পণ নিজে উঠতে না পারায় লালিমা আর দিয়াকে বললো ওঠাতে। মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে তার চিন্তায়। তড়িঘড়ি করে ওঠানো হলো মেহতিশাকে। আধা ঘণ্টার ভেতরেই ডক্টর এসে হাজির হলো। কিছু টেস্ট করে উনি মুচকি হেসে দর্পণের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘শুভেচ্ছা! বাবা হচ্ছেন আপনি। প্রাথমিক টেস্টে তাই বোঝা যাচ্ছে। আপনারা আরেকবার হসপিটালে গিয়ে টেস্ট করিয়ে নিবেন। ‘

দর্পণের অভিব্যাক্তি বোঝা গেলো না৷ লালিমা খুশিতে অজ্ঞান মেহতিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দিয়াও খুশি হলো খুব। ওরা ভাবলো দর্পণ হয়তো মেহতিশাকে একা চাচ্ছে। তাই দরজা বন্ধ করে ওরা বেরিয়ে গেলো।

ওরা বের হওয়ার পর দর্পণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেহতিশার দিকে তাকালো। মুখে ফুটে উঠলো বক্র হাসি। সে নিজের হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। একটা লাথি মেরে হুইলচেয়ারটা সরালো। স্বাভাবিক পায়ে হেঁটে বিছানায় বসলো, মেহতিশার কপালের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। পাশেই টেবিলের উপর রাখা ঔষধের পাতা গুলো ছুঁড়ে মারলো জানালা দিয়ে। মুচকি হেসে বললো,

‘বউজান, প্রসঙ্গ যখন আপনি তখন ভীষণ স্বার্থপর আমি।’

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

(নেট অনেক স্লো ছিলো বলে গল্প আপলোড হয়নি। তাই এখন নেট ভালো থাকায় দিয়ে দিলাম। আর হ্যা, শনিবার থেকে রোজ গল্প পাবেন৷)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here