প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-১৮

0
890

“প্রিয় দিও বিরহ”

১৮.

আমরা মানুষ ভালোবাসার বড্ড পাগল। যেখানে এক টুকরো ভালোবাসা পাই সেখানে অনড় হয়ে যাই। ভালোবাসাময় মানুষটাকে অন্ধ হয়ে বিশ্বাস করি। চোখে ভালোবাসার পট্টি বেঁধে ভালোবাসি। ধ্যান জ্ঞান সব হয় ওই মানুষটা৷ মেহতিশা সে দলের মানুষ। যে কিনা অল্পতেই রাগে, অল্পতেই হাসে,অল্পতেই ভালোবাসে। এ ধরনের মানুষরা নরম মনের হয় সাধারণত ভেতর থেকে। বাহির দিয়ে শক্ত। মেহতিশাকে প্রথম দেখলে যে কেউ নাকউঁচু রূপবতী মেয়ে ভাবতে বাধ্য। কিন্তু মেহতিশার সঙ্গে কয়েক দিন যে কেউ থাকলেই বুঝতে পারবে সে অত্যন্ত মসৃণ মনের। রেগে মাঝে মাঝে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও পরে কেঁদেকেটে একাকার হয়। দিয়ার তাই মনে হয়। দিয়া একটু ইন্ট্রোভার্ট ধরনের। সে সবার সাথে কথা বলে মিশতে পারেনা।

মেহতিশাকে যেদিন সে এ বাড়িতে প্রথম দেখলো তখন তা-ই ভেবেছিলো। মেহতিশার ফর্সা নিখুঁত চেহারাটা দেখে মনে মনে নিজেকে কেমন একটা ছোট মনে হচ্ছিল। আসলে, প্রতিটা মেয়েই নিজের চেয়ে সুন্দর কোনো মেয়েকে সামনে দেখলে তুলনা করে আপনা-আপনি। দিয়া সেদিন কথা বলতে একটুও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনি মেহতিশাকে দেখে। একে তো সোনালী পাকা ধানের মতো গায়ের রং, বড় টানা চোখ,আর কাটকাট নাক। যেনো কোনো বলিউড সিনেমার নায়িকা। দিয়ার গায়ের রঙটা তার মায়ের মতো। একটু কালচে ধরনের। মুখের গঠন যদিও সুন্দর। কিন্তু, আবার উচ্চতা কম। নিজেকে নিয়ে একটা হীনমন্যতায় ভোগে সে। সবার সামনে তেমন একটা আসেনা। অনেক গুলো দিন কেটে যাওয়ার পর মেহতিশা যখন দিয়াকে খেয়াল করে। তখন মেহতিশা নিজেই সেধে কথা বলেছিলো। তাই একটু লজ্জাই পেয়েছিলো সে। দিয়া ইন্টার পাশ করে এবার অনার্সে ভর্তি হলো। নিজের থেকে বয়সে বড় একজন তার ঘরে এসে নিজ থেকে কথা বললো ভেবে একটু লজ্জিত হলো। তারপর নিজ থেকেই টুকটাক কথা বলতো। একটু মিশে যাওয়ার পর ভালোই লাগতো৷ সারাদিন ঘরবন্দী থেকে দমবন্ধ লেগে যায় ওর। যেদিন শুনলো মেহতিশা প্রেগন্যান্ট। সেদিন থেকে আরও বেশি খুুশিমনে এসে গল্প করতে লাগলো দিয়া। বিকাল হতেই রোজ এটা ওটা খাবার নিয়ে এসে রুমে বসে মেহতিশা আর দিয়া মুভি দেখে ল্যাপটপে। বিকেল হলো যখন তখনই দিয়া বই রেখে পপকর্ণ ভেজে মেহতিশার রুমের দিকে গেলো। মেহতিশা তখন ফোনে বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলো।
একা বসে বসে বোর হওয়ার থেকে তাই ভালো হবে বলে মনে হচ্ছিল। দর্পন সেই যে এক ঘন্টা থেকে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলছে। মেহতিশা কোনো কাজ না পেয়ে কথা বলছিলো। দর্পণ এখন সব কাজ থেকে ছুটি দিয়েছে তাকে ৷ দুই একটা কাজ করলেও দর্পণের রাগ দেখে কিছু করার সাহস পায়না৷ মেহতিশার কেনো জানি মনে হয় দর্পণ মেহতিশা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর অনেক রাগ দেখায়। মাঝে মাঝে তো মেহতিশার মনে হয় সে বুঝি এই বাচ্চাটার সৎ মা। যে কিনা বাচ্চাটাকে একটুও চায়না। উনিশ থেকে বিষ হলেই দর্পণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এই যেমন, সকালেই পানি খেতে গিয়ে কিছুটা পানি ফ্লোরে পড়ে গেছিলো। সেটা খেয়াল করেনি মেহতিশা। আবার ওই পাশ দিয়ে হাঁটার সময় পানিতে পা রাখার আগে দর্পণ তাকে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। তারপর কিছুক্ষণ আরও ওকে বেখেয়ালি, আনমনা, কেয়ারলেস বলে বকাঝকা করলো। মেহতিশা এক পলকের জন্য থমকে গিয়েছিলো। টলমল চোখে তাকালো। দর্পণ পরমুহূর্তেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওকে জড়িয়ে ধরে সরি বললো। তখন মেহতিশা সব ভুলে খেয়ে ফেললো। এতো সুন্দর করে সরি বললে কী আর রেগে থাকা যায়!

দিয়া ঘরের দরজায় নক করতেই মেহতিশা কল কেটে দিয়ে বললো,

‘বোকা মেয়ে, তোমার আসার জন্য নক করার দরকার নেই তো। ‘

দিয়া মুচকি হেসে ভেতরে এলো। বিছানায় এসে বসেই রোজ যে কথাটা সবার আগে বলে তাই বললো-

‘ছোট ভাবি,ছোটু কবে আসবে! ‘

মেহতিশা হেসে উঠলো৷ প্রতি দিন যে কেউ এক কথা কীভাবে বলে বোঝেনা ও৷ মেহতিশা দিয়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

‘এখন তো সবে আড়াই মাস। আরও অনেক দিন বাকী। এই দেখতে দেখতে চলে যাবে। ‘

দিয়া উৎফুল্ল হয়ে বললো,

‘আমার মনে হয় আমাদের একটা ছোট রাজপুত্র আসবে। ‘

‘হাহাহা,এতো তাড়াতাড়ি তুমি কীভাবে জানলে! ‘

‘আমি জানি, রাজপুত্রটা আসলে আমি তাকে অর্পণ বলে ডাকবো। ‘

মেহতিশা থমকে যায়। দিয়া চোখ মোছে। অর্পণ নামের বড় ভাইটাকে সে আজও খুব মিস করে দু’টো বছর সে নেই। কষ্টে বুকে ব্যাথা করে দিয়ার। একমাত্র ঐ বড় ভাইটাই ছিলো যে তাকে খুব বুঝতো। এখনও বাহির থেকে আসলে লেবুর ঘ্রাণ পেলে দিয়া অস্থির হয়। কারণ এক সময় ঐ অর্পণ ভাইটাই তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। বাহির থেকে আসলে লেবুর শরবত বানিয়ে রসিক গলায় বলতো,’দিয়ু,নে শরবতটা খেয়ে বলতো কেমন হয়েছে! আমি কিন্তু অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি। ‘ দিয়া অনেক হাসতো তখন। অর্পণও মজা করে বলতো,হেঁসে নে হেঁসে নে, আমি যখন থাকবো না তখন এই অমৃত কেউ খাওয়াবে না তোকে। দিয়া এখনও সেসব মনে করলে কাঁদে।

মেহতিশা বুঝতে পারলো ওর মনটা খারাপ হয়ে গেছে। তাই মন ভালো করতে বললো,

‘জানো দিয়া, তোমার ভাইটা আমাকে সময় পেলেই বকে। ভীষণ পঁচা তোমার ভাই। ‘

দিয়ার তখনও মনটা আঁধারে নিমজ্জিত। সে আঁধারিয়া কন্ঠে বললো ,

‘তুমি মনে কষ্ট নিওনা আপু। আসলে দর্পণ ভাই ভয় পায় তো তাই এমন করে। আগের বার যখন নিশিতা আপু এমন প্রেগন্যান্ট ছিলো তখন.. ‘

মুখ ফসকে কথাটা বলে নিজেকেই বকলো দিয়া। মেহতিশা তখন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে উৎকন্ঠিত হয়ে বললো,

‘প্রেগন্যান্ট ছিলো! তাহলে সেই বাচ্চাটা এখন কোথায়? ‘

দিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,

‘নেই। ‘

‘নেই মানে?’

‘মারা গেছে। ‘

কত সহজেই দিয়া বলে ফেললো মারা গেছে। কথাটা হজম করতে অনেক কষ্ট হলো মেহতিশার। সে দিয়ার হাতটা চেপে ধরে বললো,

‘কীভাবে মারা গেছে?’

‘সে অনেক কথা। নিশিতা আপু তখন চার মাসের প্রেগনেন্ট। চেক আপের জন্য অর্পণ ভাই তাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলো। রাস্তায় গাড়ি কীভাবে যেনো নষ্ট হয়ে যায়। অর্পণ ভাই,গাড়ি ঠিক করার জন্য একটু দূর থেকে ম্যাকানিক ডাকতে গেছিলো। এসে দেখলো কে যেনো নিশিতা ভাবিকে রাস্তায় পিটিয়ে ফেলে রেখেছে। অর্পণ ভাই এসে পাগলের মতো তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। কিন্তু ততক্ষণে বাচ্চাটা মারা গেছে পেটেই। তারপর থেকে নিশিতা ভাবি পাগলপ্রায়।’

চোখজোড়া ভেজা দিয়ার। ক্ষতগুলো বোধ হয় এখনি সারেনি। মেহতিশা থমথমে মুখে বললো,

‘তারপর? অর্পণ ভাইয়া কীভাবে মারা যায়? ‘

দিয়া কিছু বলতে নিয়েও চুপ করে যায়। বোধ করে, এতোগুলা কথা বলাও ঠিক হয়নি। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘তুমি এসব নিয়ে আর ভেবো না। ভাইয়া ভয় পায়, যদি তোমার সাথেও এমন হয়! তাই তুমি সাবধানে থেকো। ‘

মেহতিশা তখনও অস্থির পরবর্তীতে কী হয়েছে তা জানতে। কীভাবে অর্পণ ভাইয়া মারা গেছে, আর নিশিতা আপুর বাচ্চাটাকে কে মারলো! শত শত প্রশ্ন ওর কানে চিৎকার করছে। মেহতিশা দিয়াকে শেষ আরেকটা প্রশ্ন করলো,

‘দিয়া, এতোটুকু বলো কীভাবে মারা গেছিলো অর্পণ ভাইয়া!’

‘আমি আর বলতে পারবো না ভাবি। বারণ আছে। ‘

‘কে বারণ করেছে? ‘

‘ভাইয়া। ‘

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here