প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-৬

0
890

“প্রিয় দিও বিরহ ”

৬.

গলদেশ বেয়ে যাচ্ছে চপচপে লহু। তাজা রক্তের থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুতুরে গন্ধ। ছটফট করে মেহতিশা।
প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। লাফ দিয়ে উঠে বসে। সারা শরীর কাঁপতে থাকে। মেহতিশা নিজের শরীরের দিকে চোখ বুলায়৷ নাহ, সব ঠিক আছে। তাহলে সব স্বপ্ন ছিলো! এতোটা বাস্তব রূপে! কীসের সংকেত ছিলো এটা? গলা শুকিয়ে কাঠ। চারদিকে অল্প আলোয় ভূতূড়ে দেখাচ্ছে৷ মেহতিশা পাশ ফিরে তাকায়। কোনো মানুষের অস্তিত্ব বুঝতে পেরে লাফিয়ে দূরে সরে। দর্পণের চিন্তিত মুখ দেখা যায়। দর্পণ অস্থির গলায় বলে,

‘কী হয়েছে বউজান? খারাপ লাগছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? ‘

দর্পণ মেহতিশার হাত টান দিয়ে কাছে নিয়ে আসে। মেহতিশার এলোমেলো সুরতহাল৷ এখনো ভয়ে ঘাবড়ে আছে। বুকের মাঝে ধরাস ধরাস করে কাঁপছে। মেহতিশার মুখের হাবভাবে বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই কোনো ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছে। দর্পণ মেহতিশার মাথাটা টেনে বুকে রাখে। মেহতিশা সরে আসতে চায়, পারেনা বিপরীতমুখী শক্তির সাথে। দর্পণ মেহতিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘ভুলে যান বউজান, স্বপ্ন ছিলো। ‘

মেহতিশা ক্লান্ত হয়ে সিটিয়ে যায়। গলায় বারবার হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, ঠিক এখানটায় কিছুক্ষণ আগে মনে হচ্ছিল কেউ দড়ি বেঁধে টানছে। অথচ, এখন কিছুই নেই। আচ্ছা দর্পণ কখন এলো? মেহতিশা মৃদু কন্ঠে বলল,

‘আপনি কখন এসেছেন? ‘

‘আধাঘন্টা হলো শুয়েছি। সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল আপনার বাবার বাড়িও তো যেতে হবে। ‘

‘আপনি সেসময় অমন ব্যবহার করলেন কেনো? ‘

‘কেমন ব্যবহার করেছি? ‘

‘ঐ যে আপনার বান্ধবীর সামনে। ‘

‘কিছুই তো করিনি। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। চোখ বন্ধ করুন। ‘

‘আমি ঘরে এসেছি সাড়ে দশটায়। আপনি এতোটা সময় কোথায় ছিলেন? ‘

‘কিছু কাজ করছিলাম। ‘

‘মিথ্যা কথা। ‘

‘আমি মিথ্যা বলিনা বউজান। বড্ড বেশি প্রশ্ন করেন আপনি। ‘

মেহতিশার চুলের ভাঁজে নিজের সকল স্নেহ মিশিয়ে দিতে থাকে হাত দিয়ে দর্পণ। আবেশে ঘোর লেগে চোখ বন্ধ হয়ে যায় মেহতিশার। ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকে পুনরায়। ঘড়ির কাটা একের কাছে পৌঁছাতে থাকে। দর্পণ মেহতিশার ঘুমন্ত চেহারার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে হাসে। হাতের শাহাদাত আঙুল উঁচু করে মেহতিশার কপাল থেকে ধীরে ধীরে গলদেশে নামিয়ে আনে, জিহ্বা নেড়ে বলে,

‘আপনাকে আমি নিঃশ্বাস থাকতে আর ছাড়ছি না বউজান। ‘

প্রভাতের কুহেলিকার আচ্ছন্ন ডাক। আকাশের প্রথমাংশে আঁধার কাটিয়ে অরুনের প্রগমন। পাখিদের কলরব। কাঁধের একটু নিচ পর্যন্তে ভেজা চুলগুলো মুছে হেয়ার ড্রেয়ার দিয়ে শুকিয়ে নেয় মেহতিশা। মনটা ভারি উৎফুল্ল। তাই হয়তো আনমনেই গলা ছাপিয়ে গুণগুণে গান বের হচ্ছে। ঝলমলে পায়ে আনন্দ নিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয়। বাহির থেকে ঘরে আসলো দর্পণ। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে আনন্দের কারণ। মৃদু হেসে ফেলে সে। মেহতিশা সেদিকে তাকায়। প্রথম বার নিজ থেকে উৎসাহিত হয়ে বলে,

‘আপনার ব্যাগপত্রও গুছিয়ে রেখেছি। আমার জামা কাপড় গোছানোও শেষ। কখন রওনা হবো আমরা? ‘

দর্পণ হাসিমুখে বলল,

‘শান্ত হন বউজান ৷ আমরা নাস্তা খেয়ে রওনা দেবো। ‘

মেহতিশা খানিকটা লজ্জা পায়। বুঝতে পারে বেশি উত্তেজিত হয়ে গেছে সে। অস্বস্তি লুকাতে বলে,

‘আচ্ছা, আমি নিচে যাচ্ছি। আপনি যাবেন? ‘

‘নিয়ে চলুন, আপনাকে ছাড়া ঘরে একা থাকা বড়ই বেদনাদায়ক। ‘

সরল স্বীকারোক্তিতে কপট রাগ দেখিয়ে মেহতিশা বলে,

‘ঢং!’

দর্পণ হাসে। মেহতিশা আলতো পায়ে এগিয়ে এসে দর্পণের হুইলচেয়ারটা নিয়ে যেতে থাকে ডাইনিং রুমে।
বিয়ের দিন মেহতিশা দ্বিতীয় তলার রুমে থাকলেও পরবর্তীতে নিচতলায় শিফট করে। হুইলচেয়ার উপর থেকে নিচে নামাতে একটু সমস্যা হয়ে যায়। মেহতিশা আর দর্পণ ডাইনিং টেবিলে এসে বসে। দর্পণের বাবা নিয়ামত শেখ, আর লালিমা শেখ একসাথে বসে গল্প করছিলেন। মেহতিশা আশেপাশে তাকায়। কী আশ্চর্য! এতো বড় বাড়িটায় মাত্র এই কয়েক জন লোকের বাস। টেবিলে আরেকটা মেয়েও বসে আছে।
মেহতিশা জানে এটা হচ্ছে, দর্পণের ছোট বোন দিয়া। অবাকই হয়, দিয়া মেহতিশার সঙ্গে একটিবারও কথা বলেনি। কী কারণে, জানেনা মেহতিশা। জানতেও চায়না। কার্যসিদ্ধি করে বাড়ি ত্যাগ করাই তার মূল উদ্দেশ্য। কে কী করলো তা দিয়ে ওর কী? তবুও কৌতূহল জাগে মাঝে মধ্যে। মেহতিশা নিজের প্লেট থেকে কাবাবটা তুলে নেয়। কামড় বসানোর আগেই দর্পণ আঁটকে দিয়ে বলে,

‘ওটা রাখুন। ওটায় গরুর গোশত আছে। আপনি এটা নিন।’

বলেই মুখের সামনে একটা চিকেন বল তুলে দেয় দর্পণ। মেহতিশা প্রথমে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগলেও পরে হা করে। কিন্তু মুখে নেয়ার আগেই কে যেনো দর্পণের হাতটা ছিটকে সরিয়ে দেয়। মেহতিশার সামনে রাখা প্লেটটা তুলে মেঝেতে আছাড় মারে। মেহতিশা হতভম্ব হয়ে তাকায়। ভীত চোখে সামনে তাকিয়ে দেখে সাদা শাড়ি পরিহিত একজন মহিলা। মেহতিশার দিকে তেড়ে এসে ডান হাতটা মুচড়ে ধরে। ক্ষোভ প্রকাশ করা গলায় বলে,

‘খুন করতে এসেছিস? আবার কাকে খুন করবি? আর কার কোল খালি করবি তোরা? ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here