“প্রিয় দিও বিরহ ”
৮.
মুঠোভর্তি শিউলি ফুল। ভেসে আসছে মন মোহনী সুরভী। হয়তোবা ফুলগুলো ধন্য হচ্ছে গৌড় বর্ণের সুশ্রী সুদর্শনা নারীর স্পর্শে। তবে, নারীটির হয়তো ভীষণ মন খারাপ। হাতের ফুলগুলো নাকের ডগায় এঁটে আখিঁজোড়া বন্ধ করে গাঢ় শ্বাস টেনে নেয়। শিউলী ফুল মেহতিশার বড্ড প্রিয়। সে উঠে দাঁড়ায়। দুপুরে খেয়ে লম্বা ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলো যখন ঘুম ভাঙে তখন বিকেল পাঁচটে। এতোটা সময় ঘুমিয়ে শরীর ভার হয়ে আছে। উঠে চোখ কচলে টেবিলের দিকে নজর এঁটে বসে। ভ্রু কুঞ্চন হয় মুহুর্তেই। একটা শিউলী ফুলের মালা রাখা সঙ্গে গুটিকয়েক সদ্য শিশির ভেজা শিউলী ফুল। মেহতিশা সযত্নে সেগুলো হাতে তুলে নেয়। ছলাৎ করে একফালি দীর্ঘ শ্বাস বেরোয় বুকের অন্তস্তল থেকে। মেহতিশা জানে কে এই ফুলের প্রেরক। এই সুন্দর সফেদ ফুলগুলোই হয়ে ওঠে বেদনার কারণ। মেহতিশা উঠে যায় বিছানা ছেড়ে। মুঠোফোনের ওপর একবার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে তাকায়। নাহ! আসেনি কোন কল। আর না এসেছে দর্পণ। মেহতিশা সেদিকে বেশি ভাবেনা। বুকে শিকলবন্দী করে আবেগকে। আবেগ নিয়ে পড়ে থাকলে মেহতিশা বাস্তবতায় হেরে যাবে। কী দরকার সেখানে হারানোর। মেহতিশা দ্বিধা অনুভব করে। তার মনে হয় দর্পণ সত্যিকারেই একটা আরশিজাল। যার চোখের দিকে তাকালে একসমুদ্র ভালোবাসার অনল প্রবাহিত হয় রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যার মুখের মায়াজালে আবদ্ধ হতে তীব্র লোভ জাগে। যাকে মেহতিশা শত ইচ্ছেতেও দূর দূর করতে পারে না। এটাকে ভালোবাসা বলা যায় কিনা জানেনা মেহতিশা। জানতে চায়না বলেই ভাবতে চায় না। ভয় হয় বড্ড। যদি সত্যি সত্যি ভালোবাসা নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে! তবে যে কতগুলো মানুষকে দেয়া প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে। মেহতিশা তো দর্পণের কাছে এসেছেই ধ্বংস করতে। মেহতিশা বিশ্বাস করে,
‘মানুষকে ভেতর থেকে ধ্বংস করার প্রধান হাতিয়ার হলো ভালোবাসায় আসক্ত করে হৃদয়ভঙ্গ করা।’
–
মেহতিশা মুখ হাত ধুয়ে আসে। মোবাইল হাতে নিয়ে বের হয়। সবাই হয়তো তারই অপেক্ষায় ছিলো। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে আশফিন আর মারিয়া লুডু খেলছে। শামীউল্লাহ জামান নিজের স্টাডি রুমে। তিনি একজন পেশাগত উকিল ছিলেন। রিটায়ার্ডের পর নিজস্ব ব্যাবসা শুরু করেন। শামীউল্লাহ আর তার ছোট ভাই শফিকুল দুজন মিলে অনেক টাকা ইনভেস্ট করে একটি কোম্পানি খুলেন। সেটা একটা টেক্সটাইল কোম্পানি। বেশ জনপ্রিয়। মাসে কোটি টাকা আয় হয় সেখান।
মেহতিশা এগিয়ে আসলো সোফার দিকে। পা উঠিয়ে আরাম করে বসলো। টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে কোনো একটা নিউজ। সেদিক থেকে নয়ন সরায়। নিচে দুজনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখতে থাকতে। আশফিনের আর এক উঠলেই জিতে যাবে। এদিকে মারিয়ার দুটো গুটি এখনো কাঁচা। বারবার চেষ্টা করছে জিতবার। মাঝে মাঝে ন্যাকা সুরে কান্না করে আশফিনের মনোযোগ সরাচ্ছে। তবে শেষমেষ আশফিনই জিতলো। মারিয়া গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে পা দাপাতে দাপাতে চলে গেলো। আর আশফিনের অট্টহাসিতে ফেটে চৌচির হলো হলরুম। এসব নিত্যনৈমত্যিক কার্যক্রম। বরাবরই নিরপেক্ষ মেহতিশা। মুচকি হেসে মোবাইলে মনোনিবেশ করে।
হঠাৎই সোফায় কম্পন অনুভব হয়। পাশ ফিরে তাকায় মেহতিশা। চমকায় না যদিও৷ চশমা পড়া টসটসে ফর্সা রঙের ছেলেটা তার দিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে।
হয়তো বহুদিনের তৃষ্ণা মেটাবার আকন্ঠা। মেহতিশা গম্ভীর গলায় বলে,
‘কেমন আছিস সৌজন্য? ‘
অপরপক্ষে সৌজন্য বিরক্ত হয়। চোখের চশমা খুলে হাতে নিয়ে বলে,
‘তোমাকে কতবার বলবো আমাকে তুই বলবে না?’
মেহতিশা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে,
‘তিন বছরের ছোট তুই। আপনি করে বলতে হবে? ‘
‘না। তবে তোমার মুখে তুই সুন্দর দেখায় না তিশা। ‘
‘তোকে না বলেছি, আমাকে নাম ধরে না ডাকতে। আপু বল। ‘
‘কখন এসেছো? ‘
মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। স্পষ্ট কন্ঠস্বরের কাছে বলে,
‘তুই আমার ঘরে গিয়েছিলি কেনো? মেয়েদের ঘরে ঢুকতে নেই। আমি এখন বিবাহিত জানিস?’
‘জানি। ‘
ছোট করে বলেই উঠে যায় সৌজন্য। কিছুটা ক্ষোভ আর একবুক হাহাকার নিয়ে হলরুম ছাড়ে। মেহতিশা জানে, যখন মেহতিশার বিয়ে হয় তখন সৌজন্য হোস্টেলে ছিলো। মূলত ওকে জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছিলো চাচীমা৷ বাসার সবাই জানে, সৌজন্যে ছোট্ট বেলা থেকে কতোটা পাগল মেহতিশার জন্য।
সৌজন্যও মেহতিশার চাচাতো ভাই। এই বাড়ির বড় ছেলে৷ মেহতিশা সবার বড়। তারপর চাচার বড় ছেলে সৌজন্য হয়। যে মেহতিশার তিন বছরের ছোট। এরপর একে একে মারিয়া আর আশফিন। মেহতিশার ঘরে খুব ভোরেই একমুঠো শিউলী ফুল তুলে রেখে আসতো সৌজন্য৷ সেই ধারা আজও বজায় রেখেছে।
ভালোবাসা হয়তো মানুষকে সত্যিই বড় বোকা বানিয়ে ফেলে। সেখানে একবার ডুবলে আত্মসম্মান, বোধ বুদ্ধিও বিসর্জন দেয় মানুষ। আবেগে ভেসে টুকরো হয়। সৌজন্য প্রচন্ড বুদ্ধিমান ছেলে। তবুও মেহতিশা অন্য কারো হয়ে গেছে জেনেও পাগলামি করে। মেহতিশা মনে মনে কৌতূহল নিয়ে নিজেকেই সুধায়-
‘আসলে ভালোবাসা কী? কেনো মানুষ প্রাণ আহুতি দিতেও দু’বার ভাবেনা? ভালোবাসার এতো শক্তি! আশ্চর্যজনক! ‘
চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।
(কালকে ইনশাআল্লাহ একটা বোনাস পার্ট আসবে।)