#প্রেমমানিশা(০৯)
বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে ফারহান, হাতে তার সিগারেট। অন্ধকারের মাঝে ধোঁয়া উড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে । মস্তিষ্কে অনবরত ঘুরতে থাকা প্রশ্নগুলো তার কাঁধ বোঝায় নুজ্য করে দিয়েছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ফারহান এখনও একটা অদৃশ্য ঘোরের মাঝে আছে। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না সানার মতো বিদেশিনী রূপের অধিকারী রমণীও তাকে পছন্দ করতে পারে,তাকে ভালোবাসতে পারে।
তার মধ্যে এমন কি আছে যা সানাহ্কে আকৃষ্ট করেছে । ওর তো বাংলা সাহিত্যে ডিগ্রি আছে, খাটি বাঙালি সে। তাহলে সানাহ্ তার মতো পুরো দস্তুর বাঙালিকে কি করে পছন্দ করে ? সানার রুচি তো বিভিন্ন বড় বড় PhD ডিগ্রিধারী অফিসার তাই নয় কি ? তাহলে ?
আর যদি সানাহ্ তাকে অযাচিত কারণে পছন্দ করেও থাকে তাহলে তার কি করা উচিত ? সানার অনুভূতিকে সম্মান করে এই বিয়েতে মত দেওয়া উচিত নাকি শুধু নিজের দিকটা ভেবে সানাহ্কে কষ্ট দিয়ে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া উচিত। এটা কি আদৌ সম্ভব তার দ্বারা ? সে কি পারবে সানার মত কোমল হৃদয়ের মেয়েকে কষ্ট দিতে ?
ফারহানের মস্তিষ্ক গড়বড় করতে শুরু করেছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। মস্তিষ্কের সঙ্গে মস্তিষ্কের বিবাদ চলছে। একদিকে মন বলছে বিয়েতে মত দিতে আরেক দিকে বিবেক বলছে কেন সে মত দিবে ? সে কি সানাহ্কে ভালোবাসে ? ভালো না বাসলে বিয়ে করে সানাহ্কে সারাজীবন কষ্ট দেওয়ার কি মানে দাঁড়ায় ? পারবে সে সানার সঙ্গে এভাবে অন্যায় করতে ?
দ্বন্দ্বে দ্বন্দ্বে ফারহান দিশেহারা। নাহ্ সে কিছুই ভাবতে পারছে না আর ভাবতে চায়ও না। বিয়ে নিয়ে চিন্তা করলেই তার মাথা ব্যাথা ধরে যাচ্ছে। পারছে না সে এত চাপ সইতে। কাল মাথা ঠান্ডা করে ফুরফুরে মেজাজে সানার সঙ্গে কথা বলা বলে তার কাছ থেকে সময় চাওয়া যাবে, আসলে খোলাখুলি কথা বলা দরকার। সবই এখন নির্ভর করছে আলোচনার উপর।
–—
‘ আপাই আজ না অবর বিয়ে হয়ে গেছে জানো ? ‘
অতসীর কথা শুনে মুচকি হাসার চেষ্টা করলো সানাহ্ তবে সে পারলো না মিথ্যে হাসি হাসতে। ব্যর্থ চেষ্টা এড়িয়ে সহজ গলায় বললো ‘ ছেলেটাকে চিনে অবনি ? ওর যে বিয়ের কথা চলছে সেটা তো আগে বলিস নি। তাহলে গিয়ে ওর বিয়ের গিফট দিয়ে আসতাম….…ফর্মালিটি ইউ নো…… ‘
‘ নাহ্ অব জহিরকে চিনে না। অবর বরের নাম জহির… মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ওরা যখন অবকে দেখতে আসে তখন কিছু না বললেও পরের দিন জহিরের বোন ফোন করে বলে যে জহিরের মায়ের অবকে পছন্দ না হলেও জহির বিয়ে করলে অবকেই করবে। আমি নিজেই তো কাল জানলাম…… ভাবিনি আজই বিয়ে হয়ে যাবে। শুধুই কি ফর্মালিটি পূরণ করতে যেতে ? আপাই তুই এমন কেন ? তোর কোনো বান্ধবী নেই, কখনও কাউকে নিজের বান্ধবী করিসনি..…আবার আমার বান্ধবীদেরও এড়িয়ে চলিস !! কেন ? ‘
অতসীর কথায় অন্ধকারের মাঝেই রাতের নিস্তব্ধতায় নীরব রইলো সানাহ্..…জবাব দিলো না কিংবা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। রাতের নিস্তব্ধতা তাকে গ্রাস করেছে……সানার রক্তিম কেশরাশি অন্ধকারে কুচকুচে কালো হয়ে ধরা পড়েছে।
‘ আপাই আজ দুলাভাইকে নতুন ম্যাডাম রিয়াশার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি..…শুনেছি উনি দুলাভাইয়ের কলেজ জীবনের ফ্রেন্ড। ইচ্ছে তো করছিলো হাত ঘুরিয়ে দুটো মুক্কা মারি ম্যাডাম রিয়াশাকে……কেন ফ্রেন্ড হলেই গাঁয়ে পড়ে কথা বলতে হবে ? কত বড় সাহস আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে হেসে হেসে তার গাঁয়ে পড়ে কথা বলে..… but unfortunately l couldn’t…… ‘ নিরলস গলায় সানাহ্কে খানিকটা হাসানোর চেষ্টা করে বললো অতসী।
ফল সুপ্রসন্ন…সানাহ্ দুর্বোধ্য হেসে উঠলো। অন্ধকারে তার আর অতসীর অজান্তে তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য। মুচকি হেসে বলল ‘ তোর দুলা..…ভাই..… যদি তাকে হেসে হেসে কথা বলার সুযোগ দেয় তাহলে তার কি করার আছে ? নারীকে সুযোগ না দিলে নারীর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। যেই পরনারীরা বিবাহিত পুরুষের ঘর ভাঙ্গে তাদের পুরুষরাই সুযোগ দেয়..… ‘
‘ এভাবে বলিস না আপাই…… দুলাভাই সেরকম মানুষই নন যে উনি যেচে কোনো মেয়েকে সুযোগ দিবেন উনার কাছে যাওয়ার..… উনি হয়তো এতকিছু ভাবেন নি। ‘
‘ হুম জানি তো….… উনি এরকম মানুষই নন। উনি তোর আর আমার জানা অজানার পরিধির বাইরে। উনাকে চেনার সাধ্য আমার নেই আর না ছোঁয়ার…… ‘ সানাহ্ রাতের আঁধারে মলিন হেসে বললো যা অতসীর নজর এড়িয়ে গেলো।
অতসী বুঝতে পারলো কথাটা তার আপাইকে বলে ভুল করেছে..…না বললেই বরং ভালো হতো। যাক যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপাইকে এখন স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে আনতে হবে। অতসী সেই ভেবে কিছু বলবে তার আগেই সানাহ্ বললো ‘ এতক্ষণ বুঝি অবনির বিয়েতেই ছিলি ? ‘
অতসী নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিল। সানাহ্ তা দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো ‘ যা মাকে গিয়ে বল খাবার দিতে……আমার খিদে পেয়েছে…… ‘
অতসী সানার কথা শুনে অবাক হলো। সানার গাঁয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললো ‘ কই তোর তো জ্বর এখনও ছাড়েনি..… আপাই তুই জ্বর অবস্থায় খেতে চাইছিস ? এটা কি আদৌ সম্ভব ? আমি ভুল শুনছি নাতো…… ‘
‘ নাহ্ তুই ভুল শুনছিস না..…আমি আসলেই খেতে চাইছি। সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। পেটে আমার ছুঁচো দৌড়চ্ছে……তাড়াতাড়ি গিয়ে মাকে রুটি দিতে বল ‘ বললো সানাহ্।
সানার কথায় অতসী ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি ‘ বলে ছুটে গেলো মিসেস কায়নাতকে কথাটা বলতে আর এইদিকে সানাহ্ বারান্দার খোলা রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল কিছু অতীতের দুর্বিষহ স্মৃতি চারণে..…
সানার অতিরিক্ত জ্বর নিয়েই কেটেছে আরও এক রাত, একদিন। অবস্থা যেই কি সেই, কোনোই উন্নতি ঘটেনি। এই একদিনে ডক্টর আরও একবার এসেছিলেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। শরীরের তাপমাত্রা এখন ১০৩° অথচ এই জ্বর নিয়েই মেয়েটা নীরবে বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। ওর এই এত জ্বর নিয়ে সকলেই শঙ্কিত। মিসেস কায়নাত আর মিস্টার কবির মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জ্বর যদি কাল সকালেও না কমে তাহলে সানাহ্কে ঢাকা মেডিক্যালে নিবেন সেই সঙ্গে আশা আর ফারহানদেরও জানাবেন।
মিসেস কায়নাতের সবথেকে বেশি ভয় লাগছে এই নিয়ে যে সানার চোখ যত লাল হচ্ছে তার পাগলামি ততই বাড়ছে, উল্টোপাল্টা সব কথা বলছে সে। এই অবস্থায় হুট করে সানার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়, এর আগেও এরকম করেছে সে।
তাই অতসী,মিসেস কায়নাত আর মিস্টার কবির মিলে ঠিক করেছেন আজ রাতটা অতসী সানার সঙ্গেই কাটাবে,এমন কি সানাহ্ সুস্থ হওয়ার আগ অব্দি এই নিয়মই জারি থাকবে। এই কারণেই অতসী আজ ভার্সিটিও যায়নি, অবশ্য সানাহ্ অনেকবার তাকে বলেছিল যেতে তবে জ্বরের ঘোরে শরীরের শক্তি কুলোয়নি বলে তর্ক করেনি।
রাত দশটা……সানাহ্ বারান্দায় বসে আছে। অতসী ঘরে ঘুমোচ্ছে। সকলের ধারণা ওর এই জ্বরে খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু ওর কষ্ট তো আসলে এই জ্বরে না, ওর যে হৃদয় পুড়ছে। প্রতি নিয়ত হাজার রকম ভাবে, হাজার দিক থেকে ওর হৃদয় দহন হচ্ছে আর এই দহন আটকানোর সাধ্য কারোর নেই। ওর এখন ইচ্ছা করছে সব ছেড়ে দূরদেশে কোথাও পালিয়ে যেতে।
এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের…
আচমকা ফোন বাজার শব্দে সানার চিন্তায় ছেদ ঘটলো। খানিকটা কষ্ট করে এগিয়ে গিয়ে বারান্দায় থাকা টি টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে কলার আইডি দেখলো..…ফোনের স্ক্রিনে ফারহানের নাম ভেসে উঠেছে। ‘ কবি সাহেব ‘ কি সুন্দর নাম তাইনা ?
সানার চিন্তার মাঝে ফোন কেটে গিয়ে আবার বেজে উঠলো। দ্বিতীয়বার ফোন বেজে ওঠার পর সানাহ্ কল রিসিভ করলো। ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই ফোনের ওপার থেকে ফারহান বললো ‘ কেমন আছেন ? ‘
আচ্ছা সানাহ্ কতদিন পর এই মানুষটার গলা শুনলো ? প্রায় দুই দিন পর……এই দুই দিনকেই সানার এখন দুই বছর মনে হচ্ছে। মানুষটার গলা শোনামাত্র তার শরীরে অজানা কাপন ধরে গেলো। সে নিজেকে সামলে হিস হিস শব্দ করে বললো ‘ যেমনটা আপনি রেখেছেন ‘ কিন্তু সেটা ফারহানের কান অব্দি পৌঁছালো না। তবুও ফারহানের মনে হলো সানাহ্ কিছু একটা বলেছে।ফারহান সন্দিহান গলায় বললো ‘ কিছু কি বললেন ? ‘
সানাহ্ নিঃশব্দে হাসলো……মলিন হাসি। নির্বিঘ্নে বললো ‘ হুম বললাম..…আপনার কথারই উত্তর দিলাম। যেমন থাকার কথা তেমনই আছি,ভালো। খারাপ থাকার মত কিছু তো হয়নি। ‘
সানার কথাটা ঠিক মনঃপুত হলো না ফারহানের, হতাশ হলো সে। ভেবেছিল সানাহ্ বলবে ‘ নাহ্ ভালো নেই আমি, একেবারেই ভালো নেই। আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই,আপনার জন্য ভালো নেই। আপনাকে ছাড়া ভালো থাকা যায়না……আপনি শুনছেন কবি সাহেব ? ‘
কিন্তু সানাহ্ ফারহানের আশাকে দুরাশা করে দিয়ে এমন কিছুই বললো না। অবশ্য তাতে খানিকটা মন খারাপ হলেও ফারহান তা পাত্তা না দিয়ে বললো ‘ আজকাল ভার্সিটিতে আপনার দেখাই পাওয়া যায় না.… কি ব্যাপার ? আপনি কি ভার্সিটিতে আসেন না ? আজ অতসীও এলো না ? ‘
‘ আপনার সঙ্গে ভার্সিটিতে আমার কবেই বা দেখা হয়েছে কবি সাহেব ? ব্যাপার কিছুই না……আপনারা আমাদের বাড়ি যেদিন এলেন তারপর থেকে আমি ভার্সিটি যাইনি। আর অতসী কেন যায়নি সেটা তো সে জানে । তাকে অবশ্য বলেছিলাম যেতে কিন্তু সে যায়নি, এতে আমি কি করতে পারি ? ‘ নিজের মনে থাকা কষ্টের বাঁধ ভেঙে ফারহানের কথায় তেতে গিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাগী গলায় বললো সানাহ্।
‘ হ্যাঁ তা ঠিক যে আপনার আমার সঙ্গে ভার্সিটিতে দেখা হয়না তবে আপনার ভার্সিটি না যাওয়ার কারণ কি ? আহা আপনাকে তো কিছু করতে বলছি না আমি… আমি তো ব্যাস…… ‘
ফারহানকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই মাঝে সানাহ্ বললো ‘ আমি ভার্সিটি কেন যাইনি সে একান্তই আমার ব্যাপার আর এতে বাইরের কারোর হস্তক্ষেপ আমি মানব না। আপনার কি কোনো জরুরি কথা আছে ? থাকলে বলুন নাহলে আমি ফোন রাখছি…… ‘
‘ আমি কি বাইরের কেউ ? ‘ ফারহান থমথমে গলায় বললো।
‘ সে তো আপনিই ভালো করে বলতে পারবেন…… ‘ সানাহ্ বললো তীক্ষ্ণ গলায়।
কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না ফারহানের,ঝগড়া তো মোটেই নয়। তবে সানার তাকে বাইরের লোক বলাটা তাকে বেশ কষ্ট দিয়েছে তারই অজান্তে। সে ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে বললো ‘ হুম কথা তো আছেই…… তার জন্যই আপনাকে ফোন দেওয়া। সত্যি বলতে আমি কাল সারারাত,আজ সারাদিন ভেবেছি। অনেক ভেবেছি আর এত ভাবনার পর আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সিদ্ধান্তই আপনাকে জানাতে এত রাতে ফোন দিলাম। ‘
‘ কি সিদ্ধান্ত ? ‘ তীক্ষ্ণ গলায় বললো সানাহ্।
‘ আমি চাই আমার আর আপনার বিয়েটা হোক……তবে এর জন্য আমার একটু সময় দরকার। আমি সেইটুকু সময়ে আপনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাই। ‘
এই প্রথম ফারহানের কথায় চমকে উঠলো সানাহ্। সে ভাবেনি এত রাতে ফারহান তাকে ফোন করে এভাবে চমকে দিতে পারে। ফারহানের কথা তার মনে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করলেও মুহূর্তের মধ্যে তার কিছু একটা মনে পড়লো আর সে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আবারও নিজের শক্ত খোলসে বেধে নিয়ে বললো ‘ হঠাৎ মাঝ রাতে ফোন করে এই কথা বলার কারণ ? আপনি তো আমাকে বিয়ে করতে চাইছিলেন না তাইনা ? ‘
‘ হুম এটা ঠিক যে শুরুতে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি কিন্তু এখন চাই কারণ কথাটা কঠিন হলেও এটাই সত্যি যে আপনার আমাকে প্রয়োজন……আর হয়তো আমারও আপনাকে। ‘ প্রথমে কথাগুলো জোরে বললেও শেষের কথাটা ফারহান বেশ আস্তেই বললো যার ফলে সানার কান অব্দি সেই কথা পৌঁছয়নি।
আচমকা সানার মনে হলো ফারহান তাকে বিয়ে করে তার উপর দয়া করতে চাইছে কিন্তু তার তো এই দয়ার প্রয়োজন নেই। আজ পর্যন্ত তো সকলে তাকে দয়াই করে এসেছে, দয়ার ভারে তার কাঁধ নুজ্জ্ব হয়ে এসেছে। আর চাইনা তার দয়া,আর চাইনা তার কাধে বোঝা। এতদিনের ঋণের ভার থেকে সে কবে মুক্ত হবে তার ইয়ত্তা নেই সেখানে নতুন ঋণের বোঝা সে সইতে পারবে না।
‘ আপনার কেন মনে হলো আমার আপনাকে প্রয়োজন ? ‘ শক্ত গলায় বললো সানাহ্হঃ।
‘ পৃথিবীতে সবারই কাউকে না কাউকে দরকার হয়,দরকার হয় জীবন সঙ্গীর। তেমনই আপনারও আপনার পাশে কাউকে দরকার। আপনার সঙ্গে তো আমার বিয়ে ঠিক হয়েছেই তাহলে আপনার জীবন সঙ্গী হতে সমস্যা কোথায় ? আপনার সঙ্গে আমার মেল বন্ধন সৃষ্টিকর্তাই ঠিক করেছেন নাহলে আমার মা আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করতেন না। এখন শুধু পালা একটু সময় নিয়ে সবটা সাজিয়ে নেওয়ার। এই সময়টা আমি পাবো তো ? ‘
‘ সুযোগ যখন সৃষ্টিকর্তা করে দিয়েছেন তখন তার ভবিষ্যৎ কি হবে সেটাও তো সৃষ্টিকর্তাই ঠিক করবেন তাইনা ? আপনি সময় পাবেন কি পাবেন না সেটা তো তার ইচ্ছা। এর উপর তো আর আমার হাত নেই..… ‘ সনাহ্ বললো।
‘ কথাটা আপনার খাঁটি হয়েছে…. যাই হোক মাঝরাতে ফোন দিয়ে বিরক্ত করলাম। আপনাকে যেই কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম সেই কথাগুলো বলে ফেলেছি আমি। এখন আমি দায়মুক্ত। আপনি এক কাজ করুন।এখন শুয়ে একটা শান্তির ঘুম দিন,বেশি রাত জাগবেন না। তারপর কাল সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটি আসবেন। কাল তাহলে আমাদের নতুন করে প্রথম দেখা হবে ভার্সিটিতে ? ‘ ফারহান বললো।
‘ কাল দেখা হবে কি হবে না সেটাতো উপরওয়ালাই জানেন। ভবিষ্যৎ তো উনার হাতে..…আমি তাহলে রাখি ‘ সানাহ্ বললো।
‘ কথা ঠিক……মনে হচ্ছে মিস সানাহ্ আমাকে খুব দ্রুত তাড়াতে চাইছেন। ব্যাপার না..…কাল দেখা হবে..…খোদা হাফেজ। ‘
‘ খোদা হাফেজ ‘
—-
রাতের অন্ধকারে রাস্তার মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছে সানাহ্। আজ সে দায়মুক্ত……সকল ঋণের ভার পিছনে ফেলে রেখে এগিয়ে চলেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। গন্তব্য তার অনিশ্চিত, ঠিক তার ভবিষ্যতেরই মতো। সানাহ্ বরাবরই নিস্তব্ধ, নীরব প্রকৃতি প্রেমিকা তবে আজকের এই মাঝ রাত্তিরের নীরবতা তার আরও বেশি পছন্দের কারণ আজ সে সব দায় থেকে মুক্ত।
বাড়িতে কঠিন রকমের পাহারা বসানো হয়েছে। সানার ঘরে অতসী শুয়েছে যাতে সানাহ্ ঘর ছেড়ে বের হতে না পারে। বাড়ির বাইরেও মেইন গেটে দুটো দারোয়ান, যারা সার্বক্ষণিক পালা করে পাহারা দিচ্ছে। এদের পর ভোর ছয়টায় আরও দুজন আসবেন যারা এদের পরিবর্তে পাহারা দিবে।
তবে সানাহ্ যে এত পাহারা ফাঁকি দিয়ে এভাবে পালিয়ে আসবে তা কেউ ভাবতে পারেনি,এমন কি সানাহ্ও না। সানাহ্ তার আলমারিতে রাখা তার মামণির পুরোনো এক শাড়ি বারান্দার রেলিংয়ে ঝুলিয়ে তা দিয়েই নেমে গেছে খুব সাবধানে। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি এত কঠিন পাহারার বেড়াজাল পেরিয়ে সানাহ্ এত সহজেই বেরিয়ে পড়বে। সানাহ্ এগিয়ে যাচ্ছে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে হাসিমুখে অথচ অসুস্থ শরীর নিয়ে। অসুস্থ মন নিয়ে নতুন শুরু কি তার জীবনকেই অসুস্থ করে তুলবে ?
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্…