প্রেমের_ভেলা
পর্ব ৬
লেখায়- #Anjum_Tuli
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]
.
.
মা আর খালা খুব যত্ন করে আমাকে সাজিয়ে দিলেন। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় কলিংবেল বেজে উঠলো। সাথে আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো। শুদ্ধ ভাই আমাকে এ রুপে দেখবে। প্রথমবারের মত। মনে মনে নিজেকে তৈরী করছিলাম শুদ্ধ ভাইয়ের সামনে যাওয়ার জন্য।
মা আমাকে নিতে আসার সময় বললেন, ‘শুদ্ধটা আজকেও এলো না।’
মুহুর্তেই অবাক চোখে মা’য়ের দিকে তাকালাম, ‘এলো না মানে? মা শুদ্ধ ভাই সত্যিই আসে নি? তুমি মনে হয় ভালো করে খেয়াল করো নি। হয়তো বা পেছনে আছেন?’
আমার অস্থিরতা দেখে মা হাসি মুখে বললেন, ‘এত অধৈর্য হচ্ছিস কেনো? আজ আসে নি বিয়েতে আসবে। চল চল দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
মুহুর্তেই যেনো আমি থমকে গেলাম। পা দুটো চলার জন্য সায় দিচ্ছিলো না। মা আমাকে এক প্রকার টেনেই বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। মুগ্ধ ভাইয়া আন্টি আর সাথে খালা আর আংকেল বসে আছেন। ঘরোয়া ভাবেই সবটা হতে হবে কথাটা আমি বাবাকে দিয়ে উনাদের জানিয়েছিলাম। যেখানে বিয়েটা করারই আমার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই সেখানে ঢাক ঢোল পেটানোর কোনো মানে খুজে পাচ্ছিলাম না।
আমাকে নিয়ে মুগ্ধ ভাইয়ের পাশে বসানো হলো। আমি যেনো এক বাকপ্রতিবন্ধী রোবটে পরিণত হলাম। মস্তিষ্ক অচল হয়ে পরছিলো ক্রমাগত। নিরবতা ভেঙ্গে একটা রঙিন কাগজের ভাজ আমার হাতে তুলে দিলেন আন্টি আর বললেন,
‘আমার পাগল ছেলেটা দেখ, যাওয়ার আগে হাতে এটা দিয়ে দিলো। আর কি বলেছে জানিস? মনে করে যেনো তোকে দেই’
কথাটা শুনে আমার কলিজা কেপে উঠেছিলো। যাওয়ার আগে মানে? কি বলছেন আন্টি? এক সেকেন্ড সময় ব্যয় না করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম,
‘যাওয়ার আগে মানে? শুদ্ধ ভাই…’ গলায় যেনো কথাগুলো দলাপাকা হয়ে যাচ্ছিলো। তাও কোনোমতে বলেছিলাম, ‘শুদ্ধ ভাই কোথায় আন্টি?’
আমার কথা শুনে আন্টি একটু মন খারাপ করেই বললেন, ‘আর বলিস না। মুগ্ধের বিয়েটা আটকে যাবে বলে ছেলেটা আমাদের কিছুই জানায় নি। কালকে রাতের ফ্লাইটেই কানাডা চলে গেছে!’
কথাটা শুনার জন্য আমি কোনো ভাবেই তৈরি ছিলাম না। যার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য মুগ্ধ ভাইয়ের হবু বউ রুপে বসেছিলাম সেই পালিয়ে গেলো? যার হৃদয়ের ব্যাথা তার মুখমন্ডলে অবলোকিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম সেই আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরন করে আমার অশ্রু গুলোকে বিনা বাধায় ঝড়ার আহবান করলো?
ঠিক সেই মুহুর্তেই আমি যেনো অনুভব করলাম, আমি কি করতে যাচ্ছিলাম? যার মনের অনুভূতি সম্পর্কে আমার বিন্দু মাত্র ধারণাও নেই। যে আমাকে ভালোবাসে নাকি নতুন সম্পর্কে নিজেকে জরিয়ে আমাকেও নতুন করে শুরু করার ইংগিত করে চলে গেলো তার সাথে আমি এ কি খেলা শুরু করেছিলাম?
চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম সবার দৃষ্টি আমার উপর। আমার কান্নার কারণ জানতে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমার পানে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ ভাইও অবাক। আন্টিত রিতিমত বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন, ‘ কাদিস না মা, শুদ্ধটাকে আচ্ছা করে বকে দিব’
মা বাবাও শান্তনা দিচ্ছিলো। কিন্তু কারো কথাই আমার কানে যাচ্ছিলো না। আমি কি পাচ বছরের বাচ্চা যে খেলনা কিনার বায়না করেছি আর তা না দিতে পারায় শান্তনা দিচ্ছে! আমি যে আস্ত একটা মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি নিজের থেকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার ভালোবাসা আমার কাছে থেকে হারিয়ে গিয়েছে। সবার সামনেই দুহাতে মুখ ঢেকে কেদে দিলাম। আমার এমন বাদভাঙ্গা কান্নায় সবাই অবাক হয়েছিলো। সবচেয়ে বেশি হয়েছিলো মুগ্ধ ভাই। মুগ্ধ ভাইয়ের পার্সোনালিটি খুব স্ট্রং ছিলো। সবাইকে চুপ করিয়ে ঠান্ডা মাথায় আমাকে বলেছিলেন,
‘তুমি কি এ বিয়েতে রাজি না সিয়া?’
ব্যাস এই একটা কথাই আমার পাহার সমান টেনশন মুহুর্তেই গায়েব করে দিয়েছিলো। মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বলেছিলাম, ‘আমি এ বিয়ে করবো না কিছুতেই না। তুমরা আমার শুদ্ধ ভাইকে এনে দাও’ বলে আর এক মুহুর্তেও দাড়াই নি দৌড়ে রুমে গিয়েছিলাম।
আমি জানি সেদিন আমার জন্য বাবা লজ্জায় মাথা নুড়িয়ে ফেলেছিলেন। আমার কিছু করার ছিলো না। বরং এমন বিস্রি এক খেলার সমাপ্তি ঘটিয়ে শান্তি পেয়েছিলাম।
বাবা টানা এক মাস আমার সাথে কথা বলেন নি। কেবল মা’কে দিয়ে আমাকে শুনিয়েছিলেন ‘সবাইকে বলে দিও আমার কোনো মেয়ে নেই’
বাবার রাগ করা জায়েজ। এভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রে বাবাকে লজ্জায় ফেলে আমি কখনো আনন্দিত হই নি। আজও তখনকার কথা মনে হলে আমার কষ্ট হয়।
আমি অনেক কষ্টে মুগ্ধ ভাইয়ার ফোনে মেসেজ দিয়েছিলাম, ‘আই এম রিয়েলি সরি ভাইয়া। আপনাকে হার্ট করার কোনো রকম ইনটেনশন আমার ছিলো না। আমি সত্যিই লজ্জিত’
আমাকে অবাক করে দিয়ে সাথে সাথে রিপ্লাই এসেছিলো, ‘ইটস অকে পিচ্চি। দোয়া করি তুমার মনের আশা খুব দ্রুতই পূরণ হোক’
রিপ্লাইটা মনের ভেতর প্রশান্তি বয়িয়ে দিয়েছিলো। কি জানি আমার ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছেটা মুগ্ধ ভাই বুঝতে পেরেছিলেন কিনা! তবে আন্টি আর মুগ্ধ ভাইয়ের ব্যাবহার আমার পুরো পরিবারকেই অবাক করেছিলো। আমাকে কিংবা বাবা মাকে কোনো রকমের কটু কথা বলে অপমান করা দূরে থাক। আন্টি উলটো সমস্ত দোষ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছিলেন। খালা আর আংকেল মিলে সেদিন আন্টিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে পাঠিয়েছিলেন।
অবাক করা বিষয় হলো আন্টির সাথে আমাদের সম্পর্কটা একটুও খারাপ হয় নি।
এর ঠিক তিনমাস পরেই মুগ্ধ ভাই বিয়ে করেন। মেয়েটা ঠিক পুতুলের মত সুন্দর। নাম ত্রয়ী। আমার চেয়ে বড়। মুগ্ধ ভাই আর ত্রয়ী ভাবীকে দেখলে মনে হয় ‘মেইড ফর ইচ আদার’।
ত্রয়ী ভাবী আমার সম্পর্কে সবটুকুই জানেন। কিন্তু কখনোই খারাপ ব্যাবহার করে নি। মুগ্ধ ভাই আর বাংলাদেশ ত্যাগ করেন নি। এখানেই জব করছেন। নেই শুধু শুদ্ধ ভাই। মুগ্ধ ভাই আমাকে দেখলেই বলেন ‘থ্যানক্স পিচ্চি তুমার জন্যই ত্রয়ীকে পেয়েছি’
মুগ্ধ ভাইয়ের ব্যাবহার উনার প্রতি সম্মান আরো হাজার গুনে বাড়িয়ে তুলে। আমি উনাকে সম্মান করি। সত্যিই ত্রয়ী ভাবী ভাগ্যবতী। মুগ্ধ ভাইকে পেয়েছেন।
সেদিনের পর আজ তিনটে বছর পেরিয়ে গেলো। কাল যখন আন্টিদের বাসায় গিয়েছিলাম। ত্রয়ী ভাবী শুদ্ধ ভাইয়ের রুম ক্লিন করছিলেন সাথে আমিও হ্যাল্প করছিলাম। কি জানি ভাবী কি বুঝে আমাকে বলে গেলেন, ‘শুদ্ধর ঘরটা তুমিই গুছিয়ে দাও’
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। কি বললেন ভাবী? আমি? ভাবী হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলেন। আশ্চর্য ভাবী কি কিছু আন্দাজ করে নিয়েছেন নাকি?
ভাবী আবার এসে বলে গেলেন, ‘তুমার অপেক্ষা শেষ সিয়া, শুদ্ধ আসছে’
এই একটা কথা আমার হার্টবিট বাড়িলো দিলো। ‘শুদ্ধ আসছে’
আন্টি অনেক জোর করলেন থাকার জন্য। কিন্তু না। আমি শুদ্ধ ভাইয়ের মুখোমুখি হতে চাই না। এতদিন সে লুকোচুরি খেলেছে। আজ থেকে আমি লুকিয়ে থাকবো। দেখি কি করে খুজে বের করে আমায়।
আজও হাতের মুঠোয় সেদিনের সেই ভাজ করা কাগজটি। তাতে গোটা অক্ষরে লেখা, ‘নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা সিয়া। ভালো থেকো’
ব্যাস এইটুকুই। কতশত লক্ষ্য কোটি বার যে পড়েছি তার হিসেব নেই। আজকের রাতটা পেরুলেই নতুন সকাল। আচ্ছা কালকের সকাল আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে? শুদ্ধ ভাইকি নতুন জীবনের সূচনা করে নিয়েছেন? নাকি আমার ভালোবাসায় নিজেকে রাঙ্গাতে আসছেন। অপেক্ষা অপেক্ষা আর কেবলি অপেক্ষা…..
চলবে…
[আচ্ছা আপনারা কি চান? সিয়া আর শুদ্ধর মিল হোক নাকি না? 😁]