#ফাগুন_প্রেম
পর্ব: ৪৩
লেখনীতে : Bornali Suhana
💛
💛
রুম থেকে বের হতেই বেসিং এর সাথে ধাক্কা খায় রুমু। ট্যাপ ছেড়ে মুখে পানি দিতে থাকে। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখে মৃদু হেসে বর্ণের রুমের দিকে পা বাড়ায়। ওর পা আগাচ্ছেনা৷ জোর করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। ইভানকে নীরব হয়ে সোফায় বসে থাকতে দেখে রুমু। এখন সে ইভানের কাছে যাবেনা৷ এখন তার বর্ণকে প্রয়োজন আর বর্ণের তাকে প্রয়োজন।
রুমে ঢুকে দরজা লক করে বর্ণের পাশে ফ্লোরে বসে পড়ে রুমু। মেয়েটা কত সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত বর্ণকে আরো বেশি শান্ত দেখায়৷ আলতো করে বর্ণের হাতের উপর মাথা রাখে রুমু। যখন জেগে থাকে তখন কোন কিছু বলার সাহস পায় না আজকে সে তার মনের কথাগুলো বলতে চায়। আর যে পারছে না এভাবে কথাগুলো চেপে রাখতে। বিছানার উপর হাত রেখে ব্যান্ডেজের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। হাতটা শক্ত করে মুঠিবদ্ধ করে নেয়। এতোটাই শক্ত করে মুঠিবদ্ধ করেছে যে হাতের ব্যান্ডেজের উপর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু ওর ব্যাথা লাগছে না একটুও। দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে বর্ণের হাতের উপর।
-“আমার ভালোবাসায় তো কোন খাদ ছিলো নারে৷ যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে সজিবকে চেয়েছি। আমার সব ভাবনা জুড়ে সজিব ছিলো এখনো আছে আর আজীবন থাকবে। তাহলে কেন আমি সজিবকে পেলাম না?
জানিস তুই যখন স্কুল/কলেজে মজা করে বলতি আমাকে তোর ভাবী বানাবি আমি তখন কি যে খুশি হতাম। ভাবতাম আমরা সারাজীবন এভাবেই একসাথে থাকবো। কিন্তু নিয়তি হয়তো অন্য কিছু চায়।
আসলে সব দোষ আমারই। আমিই দেরি করে ফেলেছি। অপেক্ষা করা যে আমার জন্য এমনও দিন নিয়ে আসতে পারে তা কেন আগে বুঝলাম না। আগে বুঝলে হয়তো…….! নাহ আসলে আগে বুঝলেও কিছু হতো না। সজিব কখনোই আমার ছিলো না আর হতোও না। ঈশার ভাগ্যে লিখা ছিলো ও। তাই তো আজ তারা একসাথে এতো সুখী। তারা সুখে থাকুক আমি না হয় ভালোবাসার সুখ দেখে সুখী হবো।”
-“তুই কিভাবে পারলি আমার থেকে কথাটা লুকাতে?”
এমন কথা শুনে রুমু চোখের জল মুছে ধরফরিয়ে উঠে বসে।
-“আরে তুই উঠতে যাচ্ছিস কেন? শুয়ে থাক জান। তোর ঘুম প্রয়োজন।”
বর্ণ তাও কথা শুনে না। উঠে বসতে লাগে। রুমু ওকে ধরে বালিশে আধশোয়া করে রাখে।
-“এসব কথা কেন আমায় আগে বলিস নি?”
-“কোনসব কথা?”
-“দেখ রুমু আমার মাথা গরম করিস নে। তুই জানিস আমি কি বলছি। আমাকে কেন এসব কথা বলিস নি?”
রুমু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নেয়। চোখের কোণে জল আর ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বলে,
-“বলে কি হতো? আমি চাইনি এই ব্যাপারটা আমাদের বন্ধুত্তের মাঝে আসুক।”
-“আমি আজকেই সবার সাথে কথা বলবো সর।”
রুমু এতোক্ষণ চোখ নিচের দিকে নিয়ে কথা বলছিলো। বর্ণের মুখে এই কথা শুনে আচমকাই চোখ উপরে তুলে। চট করে ওর হাত ধরে নেয়।
-“কিসব পাগলামো কথা বলছিস বর্ণ?”
-“আমি কোন পাগলামো কথা বলছিনা। আমি যদি আগে জানতাম তুই ভাইয়াকে ভালোবাসিস তাহলে কখনোই ঈশার সাথে বিয়ে ঠিক হতে দিতাম না। তুই কেন আমায় আগে বলিস নি? আগে বললে ব্যাপারটা এতো দূর যেতো না। যাই হোক যতদূরই যাক তা আমি সামলে নেবো৷ আমার কাছে তোর হ্যাপিনেসটা আগে আসে। সর আমায় উঠতে দে।”
রুমু বর্ণালীর কোমড় জড়িয়ে ওর কোলে মাথা রাখে।
-“আমার কসম লাগে বর্ণ। প্লিজ তুই এসব কিছু করতে যাস নে। সজিব আর ঈশা দুজন দুজনকে ভালোবাসে রে। আমি ওদের ভালোবাসার মাঝে কিভাবে আসি?”
-“তুই মাঝে যাচ্ছিস না। ঈশা মাঝে এসেছে। কেন বুঝতেছিস না? তোর কসম ফিরিয়ে নে বলছি।”
-“তুই কি সজিবের সুখটা চাস না?”
-“হ্যাঁ চাই সাথে তোর সুখটাও। দেখ ভালো মতো বলছি তুই তোর কসম ফিরিয়ে নে।”
-“নাহ নিবো না। আমি তাদের সুখ চাই। প্লিজ জান এমন করিস না। আমাকে তুই অপরাধী করিস না।”
বর্ণালী বুঝতে পারছে রুমু এভাবে মানবে না। ওকে মানাতে সে পারবে না। এমনই তো করে ও সবসময়। কখনোই নিজের সুখের কথা ভাবেনা। সবসময় অন্যকে সুখী করার পিছে পড়ে থাকে। নীরব হয়ে শুয়ে আছে দুজন। রুমু দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে বর্ণালীকে।
-“ছাড় আমায়।”
-“নাহ ছাড়বো না।”
-“আরে বাবা নড়তে পারছি নাতো।”
-“ওহ সরি।”
রুমু সরে এসে পাশে শুয়ে পড়ে। বর্ণালী যেনো কোন কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য ঠোঁটের আগায় আনতে চেয়েও আনছেনা। রুমু ভালো করেই বুঝতে পারছে সে কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চায়। বর্ণালীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,
-“ইভান বাইরেই বসে আছে।”
-“আমি কি জিজ্ঞেস করেছি?’
-“না মানে আমিই বললাম। ছেলেটা অনেক কান্না করেছে রে। কেন এমন করছিস? ওর তো কোন দোষ নেই।”
-“হ্যাঁ ওর কোন দোষ নেই। দোষ আমার আর আমি তা ঠিক করতে চাই। আমি চাইনা আমার জন্য আমার পরিবারের সম্মান ক্ষুণ্ণ হোক।”
-“এতে পরিবারের সম্মানের কথা কেন আসছে? তুই তো ইভানকে ভালোবাসিস।”
-“হ্যাঁ বাসি তবে সব ভালোবাসা যে পূর্ণতা পেতেই হবে তার তো কোন কথা নেই। আমার ভালোবাসা না হয় পূর্ণতা নাইবা পেলো।”
-“কিন্তু ইভানের কি হবে?”
-“ওর জন্য মালিহা আছে। মালিহা ওকে অনেক ভালোবাসে। আমি দেখেছি ওর ভালোবাসা।”
-“তুই কেন বুঝতেছিস না……..”
-“আমি বুঝতেছি না নাকি তুই বুঝতেছিস না? নিজে কি করেছিস? নিজের ভালোবাসা যদি অন্যের হাতে তুলে দিতে পারিস তাহলে আমি কেন পারবো না?”
এতোক্ষণে বর্ণালী রুমুর দূর্বল জায়গাটা ধরতে পেরেছে। ও বুঝে গেছে রুমুকে কিভাবে রাজী করানো যেতে পারে। শেষ চেষ্টাটা ও করবে।
ঈশা এসে রুমে ঢুকে দেখে রুমু বর্ণালীর বুকের উপর মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। ওদের এভাবে দেখে ঠোঁটের কোণে এক পশলা হাসি ফুটে উঠে। এমন বন্ধুত্ব আজকাল দেখা যায় না।
-“ঘুমিয়ে নাকি দুজন?”
রুমু মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে বলে,
-“আরে না আয় বস।”
ঈশা বর্ণালীর ওপর পাশে বসে। বর্ণালী চুপ হয়ে আছে কিন্তু ওরা দুজনে গল্প জোরে দিয়েছে।
.
ইভান শান্তভাবে সোফায় বসে বারবার বর্ণালীর রুমের দিকে তাকাচ্ছে। তখনই ওর মা আর বাবা আসেন। মা-বাবাকে দেখে একটু নড়েচড়ে বসে সে। বর্ণালীর জন্য অনেক রকম ফলফ্রুট নিয়ে আসেন। ফলের ঝুরিটা রুমু এসে এগিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে যায়। ঈশা বর্ণালীর পাশে বসেই গল্প করছে। সবাই ড্রয়িংরুমে বসে কিছুক্ষণ আলাপ করে বর্ণালীকে দেখতে রুমে যান। ইভানের মা-বাবাকে দেখে বর্ণালী উঠে বসে। সাহারা ইসলাম ওকে উঠে বসতে দেখে বলেন,
-“আরে না মা উঠতে হবে না তুমি শুয়েই থাকো।”
-“না আন্টি ঠিক আছি।”
ফারহান আহমেদ একটুখানি হেসে বলেন,
-“এখন শরীর কেমন মামনি?”
-“জ্বি আংকেল আলহামদুলিল্লাহ আমি এখন অনেকটা ভালো আছি।”
-“নিজের খেয়াল রাখতে শিখো মামনি।”
বর্ণালী অনেক লজ্জা পাচ্ছে। ইভান এক কোণা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বাসন্তীকে দেখার একটা সুযোগও ছাড়তে চায় না। অভিমান ঠিকই কমে যাবে। বাসন্তী তার বসন্ত পথিককে কখনোই মাঝপথে একা ছাড়বে না। এটা ভেবেই ইভান নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে।
দেখাদেখির পর্ব শেষ করে সবাই এখানেই খাওয়া-দাওয়া করেন। ইভান মুখে একটু খাবারও দিতে পারেনি। ওর গলা দিয়েই নামছিলো না খাবার। বাসায় যাবার সময় হয়ে আসে। ঈশার মন চাইছিলো না বাসায় যেতে তবুও যেতে হবে। সবাই বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে কিন্তু ইভানের পা আগাচ্ছে না। সে তার বাসন্তীকে এমন অবস্থায় রেখে যেতে পারছেনা। ইভান সামনে হাঁটছে আর পেছনে তাকাচ্ছে। ঈশা ইভানের হাত ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়।
-“কি হলো উঠ।”
ইভান ঈশার হাত ছাড়িয়ে বলে,
-“তোমরা বাসায় যাও আমি পরে আসছি।”
সাহারা ইসলাম কিঞ্চিৎ ব্রু কুচকে বলেন,
-“মানে কি? রাত কয়টা বাজে দেখেছিস? ১২টা বাজতে চললো। চল বাসায় চল।”
ফারহান আহমেদ হাত দিয়ে ইশারা করে সাহারা বেগমকে থামিয়ে দেন।
-“কি হয়েছে ইভু? কোথায় যাবে তুমি বাবা?”
ইভান ওর বাবার সাথে কোনদিন মিথ্যা কথা বলেনি। আজ প্রথম বলতে যাচ্ছে। অন্যদিকে তাকিয়ে চট করে এক নিশ্বাসে বলে দেয়।
-“বাবাই আমার একটা ফ্রেন্ড অসুস্থ ওকে দেখতে যেতে হবে।”
-“কাল গেলে হয় না?”
-“আসলে বাবাই।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে যাও তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। কেমন?”
সাহারা ইসলাম স্বামীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকান। ফারহান আহমেদ সেদিকে না তাকিয়েই বলেন,
-“কিন্তু যাবি কীভাবে?”
-“আমার গাড়ি তো সাথেই আছে বাবাই চিন্তা করো না।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে।”
সাহারা ইসলাম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
-“তাড়াতাড়ি চলে আসিস বাবা। তুই না আসলে আমার ঘুম আসবে না।”
-“হ্যাঁ আম্মু টেনশন নিও না।”
আর কেউ না বুঝলেও ঈশা ঠিকই বুঝতে পেরেছে ইভানের ভালোবাসার পাগলামো।সে জানে ওর কোন বন্ধুই অসুস্থ নয়। সত্যি কথা তো বর্ণকে ছেড়ে ও যেতে চাইছে না। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চোখ বুঝে আশ্বাস দিলো যে চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। ইভানও আলতো হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। গাড়ি ছাড়তেই ইভান নিজের গাড়িটা কিছুদূর নিয়ে পার্ক করে বাড়ির ভেতর আসে। বর্ণালীর রুমের বেলকনির পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রেলিং টপকে বেলকনিতে ঢুকে যায়।
💛
#_____চলবে………
Previous
https://www.facebook.com/103632171307142/posts/129448165392209/