ফাগুন প্রেম পর্বঃ ৬৬

0
1418

#ফাগুন_প্রেম
পর্ব: ৬৬
লেখনীতে: Bornali Suhana
💛
💛
বৃষ্টির মাঝে যেন সে তার বাসন্তীর উপস্থিতি অনুভব করছে। বর্ণালী আলতো করে জানালা খুলে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির গন্ধ নিতে চেষ্টা করছে। প্রথম বৃষ্টির গন্ধটা কেমন যেন হৃদয়কে স্পন্দিত করে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ফোঁটা স্পর্শ করতেই বর্ণালীর চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। বাইরের বৃষ্টি পরিবেশকে সতেজ করছে আর ভেতরের বৃষ্টি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করছে। এই রক্তক্ষরণে গভীর আঘাত পাচ্ছে, হয়তো এ আঘাত দীর্ঘ মেয়াদি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি খুব দূর যাচ্ছেনা। বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবার মতো নয়। বর্ণালী নিজের ভবিষ্যতটাও দেখতে পাচ্ছে। এইতো বাইরের অন্ধকারের মতোই। কিছুই দেখা যায় না। কোন পথ নেই, নেই কোন আশার আলো। মেঘের গর্জনের সাথে বিজলি চমকায়। বিজলির আলো সম্পূর্ণ বাহিরকে আলোকিত করে দেয়। আশ্চর্যান্বিত ব্যাপার বর্ণালী অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়া আলোকেই দেখছে এই প্রথম ও বিজলির চমকানোতে ভয় পায় না। এই আলোর ঝলকানিতে যদি ঘুটঘুটে অন্ধকারও আলোকিত করতে পারে তাহলে আমার ভবিষ্যৎ কেন আলোকিত হবে না! কিন্তু এই আলোর ঝলক কীভাবে এসে জীবনটাকে আলোকিত করবে!
প্রশ্নটা মনের ভেতরেই দাফন দেয় বর্ণালী। রুমুর চোখে-মুখে সম্পূর্ণ চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠেছে। তাকে নিয়ে কি পরিমাণ চিন্তায় আছে তা বর্ণালী ভালোই আঁচ করতে পারছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ এতো ভালোবাসে কেন এই পাগলীটা তাকে! আলতো করে উঠে রুমুর কপালে চুমু এঁকে দেয়। জানালার পাশে সোফায় বসে বৃষ্টির স্বাদ গ্রহণ করতে লাগে।

বৃষ্টি থেমে পুব আকাশে সকালের রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়েছে। পৃথিবীকে আলোকিত করতেই তার আগমন। আলোর রেখা এসে বর্ণালীর চোখে লাগতেই ঘুম ভেঙে যায়। চোখ পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করছে ও। কিন্তু ব্যথায় মাথা তুলতে পারছে না। রাতে ঘুম না হওয়ার কারণেই এই মাথা ব্যথার আক্রমণ। ফজরের আজানটা তো কানে লেগেছিলো। একটু পর উঠে নামাজ পড়বে ভেবেছিলো কিন্তু কীভাবে যে ঘুমিয়ে গেলো। আধবোজা চোখে বিছানায় তাকায় কিন্তু বিছানায় রুমু নেই। এতো সকালে কোথায় গেলো! উঠে সোজা হয়ে বসে। পাশে তাকাতেই দেখে ইভান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখজোড়া ফুলে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে পুরো রাত ঘুমায়নি, অনেক কান্না করেছে। কিন্তু আসলেই কি এ ইভান! নাকি কোন স্বপ্ন! না না ইভান কোত্থেকে আসবে? ও তো জানেনা আমি এখানে। চোখ বন্ধ করে আবারো চোখ খুলে তাকায় কিন্তু ইভান যেভাবে তাকিয়ে ছিলো এখনও ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে আছে। বর্ণালী কাঁপা কাঁপা হাতে ইভানের গালে হাত দেয়। হ্যাঁ ও ইভানকে অনুভব করতে পারছে। কোমল, উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেতেই ইভান চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ইভানের গাল অনেক ঠান্ডা। কম্পিত কণ্ঠে বর্ণালী “ইভান” বলে হাত সরিয়ে নেয়। ইভানের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসে। রুমু ৩কাপ চা নিয়ে আসে। ২কাপ ওদের সামনে রেখে এক কাপ হাতে তুলে চলে যেতে নিলেই বর্ণালী বললো,
-রুমু তাকে চলে যেতে বল।
রুমু কিছু বলতে যাবে তখন ইভান বললো,
-রুমু তাকে বলে দাও আমি এখান থেকে ফিরে যাবার জন্য আসিনি।
শুনো ভাই-বইনেরা তোমরা দুজন দুজনের সাথে কথা বলো। আমার কাজ আছে আমি যাই। বর্ণালী মণিকে কোথাও না দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-মণি কোথায় রুমু?
-ওর ৮টায় প্রাইভেট তাই উঠেই চলে গেছে।
রুমু আর দাঁড়ায় না। ফোন হাতে নিয়েই রুম থেকে বাইরে চলে যায়। ইভান এখনও বর্ণালীর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু বর্ণালী তার দিকে তাকাচ্ছে না।
-তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমায় খুঁজে বের করতে পারবো না? আমাকে কি তোমার ওইসব মুভির নায়কের মতো মনে হয় নাকি যে পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাবো না। ২০বছর অপেক্ষা করবো। ২০বছর অপেক্ষার পর আমাদের দেখা হবে। তখনও দু’জন অবিবাহিত থাকবো। আবার দু’জনে নতুন করে সুখের সংসার সাজাবো। এসব ভেবেছিলে?
বর্ণালী চুপচাপ বসে আছে। কোন কথা বলছে না।
-এই বাসন্তী কেন ছেড়ে এলে আমায়? কী ভেবেছিলে তোমায় ছাড়া আমি থাকতে পারবো? আচ্ছা তুমি কি আমায় ছাড়া থাকতে পারবে? বলো।
বর্ণালী অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ইভানের চোখের দিকে তাকানোর সাধ্য ওর নেই। ইভান নিচে ওর পায়ের কাছে বসে পড়ে।
-তোমাকে ছাড়া একা থাকার মানে বুঝো? তোমাকে ছাড়া থাকা মানে আমার কাছে, বন্ধ কোন রুমে সীমিত অক্সিজেনের ভেতর থাকা। ধীরে ধীরে অক্সিজেন কমে আসবে, আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগবে। একটা সময় আমার নিশ্বাস থেমে যাবে। অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু হবে তোমার বসন্তপথিকের……।
বর্ণালী খপ করে ইভানের ঠোঁটের উপর হাত দিয়ে চেপে ধরে। ওর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। চোখজোড়া এক করলেই তা গাল বেয়ে পড়বে। ইভান বর্ণালীর পা কোলে তুলে। ও অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। ইভান ব্যান্ডেজের উপর আলতো করে চুমু এঁকে দেয়। বর্ণালী তার কোলের উপর থেকে পা ছিটকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সম্পূর্ণ শরীর কাঁপছে।
-তুমি ফিরে যাও ইভান।
-আচ্ছা! কেন যাবো?
-আমি তোমার যোগ্য নই ইভান। প্লিজ তুমি ফিরে যাও।
-বিয়ে করা বউকে এখানে রেখে কীভাবে একা ফিরে যাই? আর কে বলেছে তুমি আমার অযোগ্য? বরং আমিই তোমার যোগ্য নই, আমার পরিবার তোমার যোগ্য নয়।
-দয়া দেখাতে এসো না ইভান। আর ওইটা বিয়ে ছিলো না তো বউ বলে অধিকার দেখাতে এসো না।
ইভান বর্ণালীর হাত ধরে বললো,
-দয়া? আর বিয়ে ছিলো না মানে? তিনবার আলহামদুলিল্লাহ কবুল বলে আমি তোমায় আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি আর তুমিও আমায় তোমার স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছো।
ইভানের হাত ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে সরে যায় বর্ণালী। ইভানের সামনে নিজেকে শক্ত করতে হবে।
-এসব বলে কোন লাভ নেই আমি তোমার স্ত্রী নই। চলে যাও এখান থেকে।
-হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছো তুমি আমার স্ত্রী নও। আসলে আমাদের বিয়ে তো হয়েছে কিন্তু বাসর তো হলোই না। তাহলে কীভাবে আমরা স্বামী-স্ত্রী হলাম? ভাববার বিষয় তো! আচ্ছা, শুভ কাজে দেরি কিসের? আজ তোমাকে আমি স্ত্রীর অধিকার দেবো আর তোমার থেকে স্বামীর অধিকার নিবো।
বর্ণালীর ভয়ে থরথর কাঁপছে। এসব কি বলছে এই ছেলে! কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না।
-চলো, আজকে আমরা বাসরদিন করবো।
ইভান বর্ণালীর হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
-ইভান ছাড়ো, কি করছো এসব? আমার কষ্ট হচ্ছে।
-এখনও তো কিছু শুরুই করিনি।
আর কিছু বলার আগেই ইভান বর্ণালীকে কোলে তুলে নেয়। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দুষ্টুমির হাসি দেয়। ওর গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-আজকের পর তুমি আমার সম্পূর্ণরুপে স্ত্রী হয়ে যাবে।
বর্ণালীর গালে চুমু এঁকে গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। বর্ণালী ইভানের শার্টের কলার চেপে ধরে। ইভান ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
-ভালোবাসি বাসন্তী।
-ইভান থামো প্লিজ আমি তোমাকে এভাবে পেতে চাই না। আমাদের বিয়ে আমরা নিজেরা করেছি ইসলামিক নিয়মে হয় নি। এটা পাপ হবে ইভান।
ইভান মুখ তুলে মুখ চেপে হাসে। বর্ণালীর কপালে চুমু এঁকে তাকে কোলে তুলে নেয়।
-কি! কি করছো ইভান?
-ইসলামিক নিয়মে বিয়ে করার ব্যবস্থা করছি।
-ইভান তোমার পরিবার আমায় মেনে নিবে না। আমি সারাজীবন তোমার উপর বোঝা হয়ে থাকতে পারবো না।
-কে বলেছে তুমি আমার বোঝা? তুমি তো একদম পুতুলের মতো হালকা এভাবে কোলে নিয়ে সারাজীবন পাড় করে দিতে পারবো। আর বাকি রইলো পরিবার মানবে না? মা আমায় এখানে পাঠিয়েছে তার ছেলের বউকে নিয়ে যেতে। এখন চুপচাপ কোলে বসে থাকো, সাপের মতো মুচড়ো-মুচড়ি কম করো। এই শক্তিগুলো বাসর রাতের জন্য বাঁচিয়ে রাখো কাজে লাগবে।
ইভান বর্ণালীর কোমড় চেপে ধরে চোখ মারে। তার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি লেগে আছে। দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আসে। বর্ণালী এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। লোকে দেখলে কি বলবে! রুমু বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের কোলাহলে ভরপুর শহরকে দেখছিলো। ইভান ও বর্ণালীকে এভাবে একসাথে দেখে ওর ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠে।
💛
💛
#_____চলবে………

Previous
https://www.facebook.com/103632171307142/posts/135148771488815/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here