#ফাগুন_প্রেম
পর্ব: ৬৪
লেখনীতে: Bornali Suhana
💛
💛
ইভানের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। বর্ণালীর পা জড়িয়ে ধরে চুপটি মেরে শুয়ে আছে। তার বাসন্তীকে সে কখনোই ছাড়বে না, কোন কিছুর মূল্যেই না। ভালোবাসার জন্য যা করতে হয় তাই করবে সে। প্রয়োজনে সে সারাজীবন তার বাসন্তীকে কোলে করে নিয়ে বেড়াবে তবুও ছাড়বে না। সাহারা ইসলাম বাইরে থেকে ছেলেকে দেখছেন। বর্ণালীর মলিন মুখের উপর চোখ পড়তেই তার ভেতর কেঁপে ওঠে। আজকে এই ফুটফুটে মেয়ের এমন অবস্থা শুধুমাত্র তার জন্যই। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ, পায়ে ব্যান্ডেজ, পেটে ব্যান্ডেজ না জানি আর কত জায়গা কেটে গেছে ওর! চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
-এমন না করলেও পারতে মা। আর করেই যখন দিয়েছো তো এখন কাঁদছো?
মেয়ের এমন প্রশ্নের জবাব কোন জবাব নেই সাহারা ইসলামের কাছে। ফারহান আহমেদ উঠে এসে বললেন,
-তোর মা কি আর ইচ্ছে করে এমন করেছে রে?
-বাবাই তুমিও এমনটা বলছো?
-তুমি চুপ করো ফারহান। হ্যাঁ আমারই সব দোষ। আজ আমার জন্যই আমার ছেলে-মেয়ে কষ্টে। আর এই ফুটফুটে সম্পূর্ণা মেয়েটা আজ আমার জন্যই অসম্পূর্ণা। আমি পাপী ফারহান আল্লাহ আমার পাপের শাস্তি আমার ছেলে -মেয়েকে দিচ্ছেন। তাদের এই কষ্ট দেখে আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে শাস্তি আমিও পাচ্ছি।
ঈশা আর মায়ের সামনে দাঁড়ায় না, চলে যায় শারমিন বেগমের কাছে। এখনও তাঁর স্যালাইন চলছে। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগে। সজিব অন্যপাশে মায়ের পায়ের কাছে বসে আছে।
অনেকটা সময় চলে গেছে। সবার মাঝে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
বর্ণালী পিটপিট করে তাকায়। মাথাটা অনেক ধরেছে৷ অনেকটা অংশ ফেটে গিয়েছিলো মাথার। মাথায় হাত দিতেই বর্ণালী বুঝতে পারে ব্যান্ডেজ করা। গতদিনের কথা মনে করতে চেষ্টা করে। আমি এখানে কেন? কি হয়েছিলো আমার সাথে? নাহ মনে পড়ছে না কেন আমার? জোর দিয়ে ভাবতে লাগে বর্ণালী। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করার পর মনে পড়ে গতদিনের কথা। এক্সিডেন্টের কথা মনে হতেই শোয়া থেকে উঠে বসে। কলিজাটা যেন ছিড়েই যাচ্ছিলো। এক্সিডেন্টের সেই মুহুর্তে বর্ণালীর মনে হচ্ছিলো ও এই পৃথিবীর বুক থেকে পাড়ি জমাবে। ইচ্ছে করছিলো শেষবারের মতো ইভানকে একটাবার ছুঁয়ে দিতে, মায়ের কোলে মাথা রাখতে, ভাইয়ার বাইকে চড়তে, বাবার চশমাটা মুছে দিতে, রুমুকে একটাবার দেখতে, ঈশার সাথে কথা বলতে। মনে হচ্ছিলো সব ইচ্ছেই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু না আল্লাহ সহায় থাকলে সবকিছুই সম্ভব। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন তাকে৷ সামনে চোখ যেতেই দেখে ওর পা জড়িয়ে ধরে ইভান শুয়ে আছে। ইভানের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ৷ হঠাৎ করে চোখ পড়ে নিজের পায়ের দিকে। নিজের মনে প্রশ্ন আসে, “আমার পায়ে ব্যান্ডেজ কেন?”
বর্ণালী আলতো করে ইভানের হাত সরিয়ে বিছানায় রাখে। পায়ের মাঝে কেন যেন ও পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে। ধীরে ধীরে কাঁথার নীচ থেকে বাম পা বের করে। পার্থক্য অবলোকন করে দু’টো পায়ের মাঝে। ভয়ে ওর আত্মা কেঁপে উঠে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না, আটকে গেছে কোথাও। বারবার গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে আর বলছে, “নাহ, নাহ, নাহ।”
হঠাৎ করে মুখ দিয়ে চিৎকার বের হয়ে আসে, “নাআ……..”।
ইভান ধরফরিয়ে উঠে বসে৷ বর্ণালীর পায়ের উপর কাঁথাটা টেনে দিয়ে ওর দু’গালে আলতো করে হাত রাখে৷
-হুস! শান্ত হও বাসন্তী।
বাইরে থেকে সবাই বর্ণালীর চিৎকার শুনে কেবিনের ভেতর আসেন।
-আ…..আমার পা, আমার পা কি হয়েছে? কি হয়েছে আমার পায়ের? সরো ইভান আমায় দেখতে দেও। আমার পায়ে কি হয়েছে?
একদিকে ইভান বর্ণালীকে আটকানোর চেষ্টা করছে অন্যদিকে ঈশা, সজিব, ফারহান আহমেদ, সাহারা ইসলাম হাবিব হাসান, সবাই মিলে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। ও কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। ডাক্তার এসে শান্ত করার জন্য ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। বর্ণালী নাহ, নাহ বলে চোখ বন্ধ করে নেয়। ঈশা ওর মাথাটা আলতো করে বালিশে রাখে। ওড়না দিয়ে চোখের কোণের জল মুছে দেয়। ঈশা ও ইভান ছাড়া সবাই ভেজা চোখে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। ডাক্তার তাদেরকেও যেতে বলে কিন্তু কেউ যেতে চায় না। ইভান আবারো বর্ণালীর পা জড়িয়ে মাথাটা এলিয়ে দেয় ওর পাশেই। ঈশা ওর মাথার পাশে বসে আছে।
.
.
গভীর ঘুমে আছন্ন পুরো হাসপাতাল। পাখির কিচিরমিচির শব্দ এসে বর্ণালীর কানে লাগছে। আধবোজা চোখ দুটো জানালার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। মাত্র আধো আধো মিষ্টি আলো ছড়িয়েছে চারদিকে। সকাল যতটা মিষ্টি এই দিন ততোটাই তেতো। আজকের দিনটা বর্ণালীর কাছে অনেক দীর্ঘ হবে। একটু নড়তেই মাথা, পা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা অনুভব করে। কেবিনের উপর চোখ বুলাতেই দেখে ওর মাথার একপাশে ঈশা অন্যপাশে সজিব আর ইভান ওর একটা পা জড়িয়ে শুয়ে আছে। ইভান ওকে ছাড়বে না কোনদিনও আর সেটা আজকে তার কাছে পানির মতো পরিষ্কার। পায়ের উপর থেকে ইভানের হাত সরিয়ে আলতো করে বিছানা থেকে পা নামায়। দু’টো পায়ের মাঝে বিশাল পার্থক্য আজ। একটা পা সম্পূর্ণ আর আরেকটা পা অসম্পূর্ণ। যে বর্ণালীর কোন খুঁত ছিলো না, আজ তার অঙ্গহানি সবচেয়ে বড় খুঁত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইভানের দিকে নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আলতো করে চুলের উপর চুমু এঁকে দেয়। “অনেকটা পথ চলার ছিলো একসাথে কিন্তু খোদা হয়তো তা আমাদের কপালে লিখেন নি। তোমার ভাগ্য হয়তো অন্য কারো সাথে আমার সাথে না।”
এসব কথা ভেবে ওর কান্না পাচ্ছে না, পাবার কোন কারণও নেই। কেননা তার ভালোবাসা আজ সার্থক। ভালোবাসার সুখের জন্য অনেক সময় ভালোবাসাটা ত্যাগ করতে হয়। আর আজ বর্ণালী তাই করবে। আজকে রুমুর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। রুমুর আর ওর ভাগ্য কি আল্লাহ এক কলমেই লিখেছেন নাকি! হ্যাঁ হয়তো। সজিবের চুলে হাত বুলিয়ে কয়েক ফোটা চোখেরজল ফেলে। “ভাইয়া আর কাকে ডাকবি স্বরবর্ণ! ব্যঞ্জনবর্ণ! আমিও যে আর তোকে ভাইয়া বলে ডেকে মনটা শান্ত করতে পারবো না।”
হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। পা ফ্লোরে ফেলতে ভয় পাচ্ছে বর্ণালী। ও কি হাঁটতে পারবে! ভয়ে ভয়ে ফ্লোরে বাম পা রাখে। ডান পা ফ্লোরে ঠেকায়। পা প্রচন্ড কাঁপছে। পায়ের উপর শরীরের ভর ছাড়তে ভয় পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে শরীরের ভর ছেড়ে দেয়। হ্যাঁ ও দাঁড়াতে পেরেছে। চোখের কোণে জল আর ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফোটে ওঠে। এবার ওর হাঁটার পালা। প্রথম পা এগুতেই ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। এক হাত দিয়ে মুখ চেপে অন্য হাতে বিছানায় ভর দেয়। ঘা এখনো তাজা তাই ব্যথাটাও বেশি। টপটপ করে চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কিন্তু তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। সামনে এগুতেই হবে। এ কদম থামালে চলবে না তার। এক পা দু’পা করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে বর্ণালী। ভ্রু কুঁচকে ঠোঁটজোড়া চেপে কষ্টটাকে কম করার চেষ্টা করছে। ঈশার পাশে এসে কপালের কোণে চুমু এঁকে দেয়। “আর তোদের সুখের সংসার দেখা হবে না, হবেনা তোদের সাথে খুনসুটি, আর হবেনা তোর ভাবী ডাক শোনা।”
একটা শব্দও মুখ দিয়ে বের করে না। কথাগুলো মনের ভেতরই দাফন দিয়ে দিলো। কথা বললেই ওরা জেগে যাবে আর জেগে গেলে হয়তো বর্ণালী তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারবে না। পেছন ঘুরে গুটি গুটি পায়ে কেবিন থেকে বের হয় বর্ণালী। বাইরে মা ছাড়া সম্পূর্ণ পরিবারকে দেখতে পায়। বাবার পা ধরে সালাম করে। “বাবা অনেক ভালোবাসি, কখনো বলা হয়নি আর না বলাই থেকে গেলো। তোমার এই মেয়ে তোমার থেকে ভালোবাসাটা আর পেলোই না। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া কি আমার পাপ ছিলো বাবা? প্রশ্নটা আর করা হবে না তোমায়। ইনশাআল্লাহ ভাইয়া তোমাদের খেয়াল রাখবে।”
সাহারা বেগম ও ফারহান আহমেদকে সালাম করে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়।
“ক্ষমা করে দিবেন, আপনাদের সুখের সংসারে আমি দুঃখের একটা স্মৃতি হয়ে থেকে যাবো। আসবো না কখনো বাঁধা হয়ে আপনাদের সামনে।”
শারমিন বেগমকে খুঁজতে লেগে গেলো বর্ণালী। কয়েকটা কেবিনে উঁকি দিতেই পেয়ে যায়। কেবিনে ঢুকে মায়ের বালিশে মাথা রাখে। এক হাতে জড়িয়ে ধরে। “জানি আমার জন্যই তোমার এমন অবস্থা মা। তোমার আঁচল যে মেয়ে ছাড়েনি আজ সে মেয়ে তোমার থেকে অনেক দূরে যাচ্ছে মা। দোয়া রেখো আর নিজের খেয়াল রেখো।”
আলতো করে মায়ের গালে চুমু এঁকে দেয়। নাহ আর দেরি করা যাবেনা। আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। ধীরে ধীরে পা বাড়ায় বর্ণালী অজানার পথে। ও জানেনা এই পথের গন্তব্য কোথায়। পা থেকে রক্ত ঝরছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তায় নামতেই দেখতে পায় রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়েছে। সবকিছু ঠিকই আছে শুধু বদলে গেছে ওর জীবন। মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে সিএনজি ধরে ড্রাইভারকে একটা ঠিকানা বলে। ড্রাইভার সেদিকেই যাচ্ছে। কিন্তু ওর কাছে গাড়িভাড়া নেই কি করবে তাও ভাবেনি। একটা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে বলে দাঁড়াতে। প্রায় ২০মিনিট পর ফিরে এসে আবারো সিএনজিতে উঠে বলে স্টেশন যেতে।
হাতের মুঠোয় রাখা মোবাইল আর টাকার দিকে কিছুক্ষণ তাকায়। ব্যবস্থা হয়ে গেছে ওর। আর কোন সমস্যা নেই। স্টেশনে এসে গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে ট্রেনের টিকেট কাটতে যায়। জীবনের প্রথম খালি পায় হাঁটছে। বাম পায়ের তলায় ব্যথা পাচ্ছে কিন্তু থামবে না সে। ৫মিনিটের রাস্তা ১০মিনিটে যাচ্ছে। টিকেট কেটে পেছনে তাকাতেই ভেজা চোখে আবারো অশ্রুপাত হয় বর্ণালীর। চোখের সামনে যাকে দেখছে সে শুধু একজন মানুষ নয় নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে তার মাঝে। ও এগিয়ে যাওয়ার আগেই সেই মানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরে। না কোন প্রশ্ন করে না কেউ কোন উত্তর দেয় চুপচাপ ট্রেনে চেপে বসে দুজন। ট্রেন চলছে তার গতিবেগে আর তাদের গন্তব্য সিলেট।
#______চলবে…….
Previous
https://www.facebook.com/103632171307142/posts/133887678281591/