ফিঙের_ডানা পর্ব-১২

ফিঙের_ডানা
পর্ব-১২

রিশানের ডান পা ভেঙে গেছে, আর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ওর পায়ে ব্যান্ডেজ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে স্ট্যান্ডের সাথে। বেচারার জ্ঞান ফিরেছে মাত্রই। জ্ঞান ফেরার পর থেকে ‘মা মা’ বলে ডেকে যাচ্ছে। প্রচন্ড জ্বর শরীরে। লাল চোখ মেলে তাকিয়ে মাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে আরও বেশি গোঙাচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ ওকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম৷ ওর বাবা কিংবা সোহান থাকলেও ছেলেটা একটু শান্ত হতো, কিন্তু তারা আছে আরও বড় ঝামেলায়।

তান্নি আপুর অপারেশন চলছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে যার কারনে রক্তও লাগবে অনেক। আপুর রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ। ডোনারও আগে থেকে ঠিক করা, কিন্তু হঠাৎ এমন দুর্ঘটনায় সব ওলটপালট হয়ে গেছে। আরও বেশি রক্ত প্রয়োজন। পাগলের মতো রক্ত খুঁজে যাচ্ছে রোকন ভাই আর সোহান। এদিকে আপুর অবস্থা নাকি অতটা ভালো নয়। বাচ্চাদেরও কী হয় বলা যায় না।

তান্নি আপু আর সোহানের মা এসেছেন। ওদের বাবা নেই। ভয়ানক ফরসা মহিলা সবসময় পান খায় বলে ঠোঁট লাল টুকটুকে। যদিও অনেকক্ষণ পান মুখে দেয়নি, তাও ঠোঁট লাল হয়ে আছে। উনি চেয়ারে বসে চোখ বুজে একনাগাড়ে তসবি পড়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছছেন। আমার নিজেরও ভয় হচ্ছে ভীষণ।

অনেকেই এসেছিল হাসপাতালে। এত মানুষ থাকতে দেবে না বলে প্রায় সবাই চলে গেছে। আমি রয়ে গেছি জোর করে।

রাত প্রায় দেড়টায় তান্নি আপুর অপারেশন শেষ হলো। দুটো মেয়ে হয়েছে। একই রকম দেখতে। সাইজে এত ছোট যে মনে হয় হাতের তালুতে জায়গা হয়ে যাবে। বাচ্চাদের তখনই আমাদের কাছে দেয়া হলো না। অক্সিজেন দিয়ে রাখা হলো। তান্নি আপুর অবস্থা মোটামুটি ভালো। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অবশেষে।

রিশানকে ঘুম পাড়ানো হয়েছে ইনজেকশন দিয়ে। অনেক ছটফট করছিল ছেলেটা। ওকে যখন বলা হয়েছে ওর দুটো বোন হয়েছে, তখন পারলে ভাঙা পা নিয়ে উঠে চলে আসে।

আমি একবার রিশানের কাছে, তো একবার অপারেশন থিয়েটারে ছোটাছুটি করে ভীষণ ক্লান্ত। শেষ রাতের দিকে ওয়েটিং রুমের চেয়ারে বসলাম হেলান দিয়ে। ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে চোখ। হাসপাতালের ঔষধ ঔষধ একটা গন্ধ আছে। কেমন যেন অস্বস্তি হয় সবসময়। বুকের ভেতরটা এখনো অস্থির লাগছে।

কতক্ষণ শুয়ে আছি জানি না। চোখ লেগে এসেছিল। মনে হলো কপালে কে যেন হাত রাখল। আদুরে একটা হাত আমার চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে কানের পাশটাতে গুঁজে দিল। আরামের ঘুম চলে এলেও জোর করে চোখ মেললাম। সোহান। আমাকে তাকাতে দেখে হাসল। মৃদু স্বরে বলল, “ঘুমাও!”

“আপনি একটু রেস্ট নেবেন না?”

সে কিছু বলল না। আমার গালে একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল। সোহানের চোখদুটো লালচে, চেহারা বিদ্ধস্ত। হলুদ টিশার্টের জায়গায় জায়গায় রক্ত লেগে আছে। মনে হলো ওকেই কোলে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেই।

কার সজাগ পায়ের শব্দে ঘোর কাটল। সোহান একটু সরে দাঁড়াল। দেখি ওর মা এসেছে। জায়নামাজ নিয়ে চলে গেলেন নামাজের ঘরের দিকে। তাহাজ্জুদ পড়বেন হয়তো। যাওয়ার আগে সোহানকে বললেন, “বাড়িতে গিয়ে জামাকাপড় বদলে আয়। ফজরের নামাজটা কাজা করিস না। জামাই বাবাকে নিয়ে যা। এত বড় ফাড়াটা কাটল!”

“আচ্ছা।” বলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল সোহান। ও বেরিয়ে গেলে একটু পর ফজরের আজান দিল। আমিও নামাজের ঘরের দিকে গেলাম। ওযু করে নামাজ পড়ে নিলাম। সোহানের মা তখনও চোখ বুজে তসবি টিপে যাচ্ছেন। আমি বের হয়ে আসার সময় ডাকলেন। কাছে গেলে বললেন, “বসো।”

আমার কেমন ভয় ভয় হতে লাগল। প্রচন্ড অস্বস্তিও। সোহান তখন আমার একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। উনি কী ভাবছেন? কেন যে পাগলটা এলো তখন!

উনি সেই প্রসঙ্গ তুললেনি না। উল্টে ছেলেমেয়ের নানান কথা বলতে থাকলেন। তান্নি আপুর প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময় কী ঝামেলা হয়েছিল সেসব, তাদের পরিবারের কথা, সোহানের ছোটবেলার কথা। সত্যি বলতে আমার ভয় কেটে গিয়ে খুব ভালো লাগতে লাগল। উনিও এতক্ষণের চিন্তাটা কাটিয়ে স্বাভাবিক হলেন। কথায় কথায় আমার কথাও জিজ্ঞেস করলেন। আমি খুলে বললাম সবকিছু।

সকাল আটটার দিকে তান্নি আপুর জ্ঞান ফিরল। এখন একটু সুস্থ। বাচ্চাদেরও দেখতে দেয়া হলো। দশটার দিকে কয়েকজন চাচী এলো। মাও এলো তাদের সাথে। বাচ্চাদের দেখে তান্নি আপুর সাথে একটু কথা বলে ফিরে গেলাম বাড়িতে। গিয়ে খেয়েদেয়ে লম্বা ঘুম দিলাম।

উঠলাম দুপুরে। ঘর থেকে বের হয়েই সোহানকে দেখে চমলে গেলাম। বুঝলাম চাচীরা হাসপাতালে খাবার পাঠাবে বলে রান্না করেছে। সোহানকে সেজন্য খবর দিয়ে আনিয়েছে। এখন টিফিন প্যাক করতে ব্যস্ত তারা। সোহান আমার দিকে তাকাতেই আবার ছুটে ঘরে ঢুকে গেলাম। আমার কোঁচকানো জামা, আলুথালু চুল তখন৷ এই অবস্থায় দেখে ফেলল ছেলেটা!

আমাকে অবাক করে দিয়ে সে সোজা ঘরে ঢুকে গেল। আমার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই খাটে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। বলল, “শিফা! একটা সুন্দর দেখে মেয়ের নাম খোঁজো তো!”

“আমি?”

“হ্যাঁ।”

“একটা কেন?”

“একটা তুমি ঠিক করো, একটা আমি। দুটো যদি কাছাকাছি হয়, তাহলে এগুলোই রাখা হবে। আর না মিললে বাদ। ডাক নাম ঠিক করবে কিন্তু! ভালো নাম রাখবে মা।”

“আচ্ছা।” মজা লাগল কথাটা শুনে। মিলে গেলে কী মাজাটাই না হবে! “রিশানের কী অবস্থা এখন?”

“হাত পা আটকে গেছে, মুখ চলছে। মাও কথা বলতে পছন্দ করে, দুজন গল্প করছে। ডাক্তাররা এর মধ্যেই বিরক্ত!”

“ওর ব্যথা কমেছে?”

“এখনই কমবে? অনেক ভোগাবে। তাও ভালো ছাদ থেকে পড়ার ভয় পেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েনি। সাহস আছে।”

“হুম।”

সোহানের বাইরে ডাক পড়ল। সে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, “এলোমেলো চুলে তোমাকে কেমন লাগে জানো?”

“কেমন?”

“শেওড়াগাছের পেত্নীর মতো!”

“আপনি শেওড়াগাছের পেত্নী দেখেছেন?”

“হ্যাঁ তো! আমাদের ইউনিভার্সিটির পেছনে সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে একটা শেওড়া গাছ আছে। ওইটার মগডালে থাকে। আমাকে দু’বার প্রপোজ করেছে। ভাবছি আরেকবার করলে ওর সাথে প্রেম করা শুরু করব।”

বলেই বেরিয়ে গেল। কী খারাপ লোক! আমি ভাবছিলাম আমাকে সুন্দর বলবে হয়তো!

সন্ধ্যার দিকে আমি মহা উৎসাহে বসে গেলাম নাম খুঁজতে। যত নাম জানা ছিল সব মনে করলাম। সোহানের ঘরে একটা নামের বই আছে। আনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বাড়িতে সোহান একা। এখন যাওয়া ঠিক হবে না। রাতে ঘুমালামও এই নাম ভাবতে ভাবতে। শেষরাতে মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম সোহানের কোলে একটা বাচ্চা, আমার কোলে একটা। আমরা ওদের নাম ধরে ডাকছি৷

ঘুম ভাঙতেই মনটা খুশিতে ভরে গেল। নাম পেয়ে গেছি। কেন যেন মনে হচ্ছে সোহানের নামটার সাথে মিলেও যাবে!
(চলবে)

||সুমাইয়া আমান নিতু||

[গল্প কেমন লাগছে প্রিয় পাঠকগণ? ভালোমন্দ তেমন কিছুই আপনারা বলেন না!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here