ফিঙের_ডানা পর্ব-১১

ফিঙের_ডানা
পর্ব-১১

আকাশে উড়তে থাকা সাদা বকগুলো দেখে হঠাৎ মনে হলো ওগুলো বক নয়, সাদা পক্ষীরাজ ঘোড়া। উড়ে উড়ে এগিয়ে আসছে ঠিক আমারই দিকে। টুপ করে নেমে আমাকে কাঁধে তুলে রওনা হবে দূরদেশে। সেখানে কোনো অচীনপুরের রাজপুত্র অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য। অচীনপুরের রাজপুত্রের মুখটাও চোখের সামনে ভেসে উঠল। কোঁকড়াচুলো ফরসা একটা ছেলে। আরে এ তো কাকের বাসাটা! ধ্যাৎ! আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে বাস্তবে ফিরলাম৷ আকাশের দিকে চেয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে খারাপ লাগে না কখনো। আর এত বড় আকাশ দেখার সুযোগ অনেকদিন হয় না।

দাঁড়িয়ে আছি বাড়িওয়ালাদের ছাদে। ওদের দেড়তলা বাড়ির একতলার ওপর যে একটুকু ছাদ আছে তাতে। রেলিং নেই কোনো। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে ছাদ। পানি জমে আছে এক কোণে। আকাশটা বৃষ্টিধোয়া স্নিগ্ধ সুন্দর দেখাচ্ছে। সোহানের কাছে অংক বুঝতে এসেছি আজও। এসে দেখি ভাগ্নেকে বুকে জড়িয়ে বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। তাই আর ডাকিনি। ছাদে চলে এসেছি। এই বাড়িতে আমার এখন অবাধ যাতায়াত। যেন নিজের বাড়ি। সোহানের বইগুলোর ওপরেও অচেনা এক অধিকারবোধ জন্মে গেছে। যখন তখন নিজ হাতে তুলে নিয়ে যাই৷ মাঝে মাঝে বইগুলোতে ছোট্ট চিরকুট লিখে রাখি। যদি সে কোনোদিন বইগুলো আবার পড়ে তবে দেখতে পাবে।

আমার পরীক্ষা শেষ। তবু অংক বুঝতে আসি। সোহান ঠিকই বলে, ওকে দেখতেই আসি। কিন্তু তাই বলে কি আর স্বীকার করা যায়? ও উঠছে না দেখে ফিরতি পথ ধরলাম। যাওয়ার আগে তুলে নিলাম হুমায়ূনের বই-‘মেঘ বলেছে যাব যাব’।

দরজার কাছে যেতেই ঘুম ঘুম কন্ঠের ডাকটা শোনা গেল- “এ্যাই শিফা….”

ফিরলাম। সোহান জেগে উঠেছে। রিশানকে পাশে সরিয়ে রেখে উঠে বসল। টিশার্টটা খানিক ওপরে উঠে গেছে। ফরসা পেট দেখা যাচ্ছে৷ কী সুন্দর! আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। নজর এত খারাপ হলে কি চলে? সে জামাকাপড় টেনেটুনে ঠিক করে বলল, “ছাদে দাঁড়াও, আসছি।”

আমি আবার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। বকেদের বাড়ি ফেরা শেষ৷ এবার উড়ছে অন্য কিছু পাখি। দূর থেকে চেনা যাচ্ছে না তাদের। ছোটবেলায় ড্রইং খাতায় আঁকা টিক চিহ্নের মতো একগাদা কালো পাখির ঝাঁক। আকাশের রঙ বদলে যাচ্ছে দ্রুত।

“কী অবস্থা?” এখনো ঘুম ঘুম কন্ঠেই বলল সে।

“এইতো ভালো।”

“পড়তে এসেছ?”

“হ্যাঁ।”

আর কথার শব্দ না পেয়ে চেয়ে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। বললাম, “কী সমস্যা?”

“গালে ওইটা কী?”

আমি হাত দিয়ে ব্রণটা ঢেকে ফেললাম। “কিছু না।”

“বড় হয়ে গেছ!”

“এটাতে বড়র কী আছে? আরও অনেক কমবয়সে হয়।”

“তোমার দেখিনি। সুন্দর লাগছে কিন্তু!”

আমি হাসলাম। বিচ্ছিরি জিনিসটা সুন্দর কেমন করে হয় এই পাগল ছাড়া কেউ জানে না। সে এখনো আমার দিকে তাকিয়ে, আমি অন্যদিকে। পেছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকালাম দুজনেই। রিশান উঠে গেছে। উঠেই লাফঝাঁপ দিতে শুরু করেছে।

“এই পিচ্চি ঘুমালে স্থির থাকে?”

সোহান মাথা চুলকে বলল, “মোটামুটি থাকে।”

রিশান একবার আমার চুল টানে, একবার সামনে এসে মুখ ভেঙচি দেয়, সোহানের সাথে যা করে তা আর বলার মতো না। সোহান ওকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিল। কী এক কাহিনী বলতে শুরু করল, “জানো সেদিন কী হয়েছে…”

কথা শেষ করতে পারল না, হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ফিরে তাকালাম। ছাদে রিশান নেই। অথচ ছিল মাত্রই। কে যেন নিচ থেকে চিৎকার করে উঠল। আমরা দৌড়ে কোনে গিয়ে দেখি বাচ্চাটা পড়ে গেছে। ডান পা টা বাঁকা হয়ে আছে।

জানি তা তারপর কেমন করে কী হয়েছে। ঘোরের মধ্যে নিচে নেমে এসেছি। ততক্ষণে নিচের অনেকে রিশানকে ধরে তুলেছে। কপাল খানিকটা কেটে গেছে। তাও ভালো নরম মাটিতে পড়েছে বলে জোরালো আঘাত না। তবে সবার চিৎকারে আমার নিজেরই হাত পা অবশ লাগতে শুরু করেছে। বারে বারে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সোহান রিশানকে কোলে তুলে কী যেন বলে চেঁচাচ্ছে কিছু মাথায় ঢুকছে না। রিশানের জ্ঞান নেই। অ্যাম্বুলেন্সে খবর দেয়া হলো।

কে যেন বলে উঠল বাচ্চার মা কই? আমারও তখনই মনে পড়ল তান্নি আপু কিছু শোনেনি? আপুর অবস্থা তেমন একটা ভালো না। ডেলিভারির ডেট সামনের সপ্তাহে। হাঁটাচলা করতে দারুণ কষ্ট হয়। বিশাল পেটটা নিয়ে সে হাঁপিয়ে উঠেছে।

আমি দৌড়ে ভেতরে গেলাম৷ সাথে এলো এক চাচী। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আলো জ্বলেনি কোথাও। তান্নি আপুর ঘরের কাছাকাছি যেতে আর্তনাদের শব্দ শুনতে পেলাম৷ আলো জ্বেলে দেখি তান্নি আপু মেঝেতে পড়ে আছে, রক্তের একটা পুকুর হয়ে গেছে তার পায়ের কাছে।

মাগরিবের আজানের সাথে সাথে মা ছেলেকে একই অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেয়া হলো। সাথে গেলাম আমিও।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here