#ফিঙের_ডানা
পর্ব-১০
কলেজে আমার বন্ধুবান্ধব ভালোই হয়েছে। জাহরা, সায়মা, তানজিলা, সুমন, আফজাল আর তানজীব। আমরা সবাই একই ক্লাসে। এদের মধ্যে তানজিলা আর তানজীবের প্রেমও হয়ে গেছে। তারা এখন একটু আলাদা আলাদা থাকে। তাদের নিয়ে হাসি মজা করে সময়টাও ভালোই কাটে। কিন্তু দলের মধ্যে একটা জোড়া হলে বাকিদেরও হয়তো একা থাকতে ইচ্ছে করে না। একদিন হঠাৎ ক্লাস শুরুর আগে আফজাল আমাকে বলল, “চল একটু বাইরে যাই।”
“কেন? এখনই তো স্যার আসবে।”
আফজাল বলল, “দোস্ত আজকে মায়ের বার্থডে। একটা শাড়ি কিনব। তোর পছন্দ ভালো। তুই চল না!”
এভাবে বলছে, তারপর আবার ক্লাসটা অত জরুরি না, তাই চললাম আফজালের সাথে। বের হতেই সে মার্কেটের দিকে না গিয়ে অন্যদিকে চলল। জিজ্ঞেস করলে বলল কী নাকি জরুরি কথা বলবে। সন্দেহ তখনই জাগল। আসার সময় বাকিরা মুখ টিপে হাসছিল।
যা আশঙ্কা ছিল তাই! একটা পার্কের কাছাকাছি এসে হঠাৎ হাঁটু মুড়ে বসে একটা গোলাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আই লাভ ইউ শিফা!”
মন চাইল ওর চুলগুলো ধরে লেকের পানিতে চুবিয়ে নিয়ে আসতে। অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলে ফুলটা নিলাম৷ তারপর কিছুদূর গিয়ে রাস্তায় বাঁধা একটা গরুর মুখের কাছে ধরতেই গরুটা গোলাপ চিবিয়ে খেয়ে নিল। আফজালের মুখটা তখন দেখার মতো হয়েছে। বেচারাকে এত অপমান না করলেও হয়তো পারতাম৷ কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই হুট করে আই লাভ ইউ? এত ফাজলামো নাকি প্রেম? ওকে কিছু বললামই না। চলে গেলাম সেখান থেকে।
এরপর থেকে আমাদের সার্কেলটা বেশ দুর্বল হয়ে পড়ল। ভেঙে যায় যায় অবস্থা। আফজাল রাগে সেদিনই সায়মাকে প্রপোজ করেছে। সায়মা ওকে আগেই পছন্দ করত। হয়ে গেছে দুজনের জুটি। আমার ভাবলেই হাসি পায়। এইটা প্রেম? আমি সেদিনের পর থেকে আফজালের সাথে কথা বলি না৷ সেজন্য সায়মাও আমার সাথে কথা বলে না। তানজীব, তানজিলা তো আলাদাই থাকে প্রায়। বাকি রইলাম আমি আর সুমন। সুমনটাকেও বেশি ঘাটাই না। দেখা যাবে কবে যেন আফজালের মতো কান্ড করে বসে! ক্লাসে একাই থাকি। আড্ডা দেওয়া হয় না বলে দ্রুত বাড়ি ফিরি।
দেখতে দেখতে আমাদের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিল। পড়া হয়নি তেমন কিছু। দুটো সাবজেক্টের বই খুলে দেখি মাথায় জট লেগে যাওয়ার অবস্থা। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য গেলাম সোহানের কাছে। মাকে বলেই গেলাম। মা অমত করল না৷ সেদিন মায়ের কথা শুনে সোহানের থেকে এতদিন দূরে দূরে থেকেছি। মা বুঝেছে আমি বাড়াবাড়ি করব না।
গিয়ে দেখি সোহান ড্রইংরুমের সোফায় বসে পড়ছে। কালো টিশার্ট পরা আজ। টিশার্টের গায়ে সাদা রঙে লেখা- ডার্ক বয়। মন চাইল জিজ্ঞেস করতে ডার্ক বয় কী জিনিস? জিজ্ঞেস করা হলো না। বললাম, “বলেছিলেন পড়া বুঝিয়ে দেবেন। এই ম্যাথগুলো করিয়ে দিন।”
সোহান বই নিল। মনোযোগ দিয়ে অংকগুলো দেখতে শুরু করল। আমি পাশে বসে চেয়ে রইলাম তার দিকে। তান্নি আপু এলেন তখন। হেসে বলল, “বাঃ! কী ভালো মেয়ে! পড়তে এসেছ বুঝি?”
“হ্যাঁ আপু।”
“আচ্ছা পড়ো। আমি একটু চা করে দেই তোমাদের।”
তান্নি আপুর পেটটা বেঢপ ভাবে ফুলে আছে। জমজ বাচ্চা নাকি হবে। এই ভারী পেট নিয়ে হাঁটাচলা করলে তাকে দেখতে হাস্যকর লাগে৷ তাকে দেখেই মনে হলো আমারও তো একদিন এরকম হবে। বিয়ে হবে, বাচ্চা হবে, আমারও পেট এরকম ফুলে যাবে। তখন কেমন হবে? ভেবেই ফিক করে হেসে ফেললাম৷ সোহান বিরক্ত হয়ে বলল, “হাসো কেন? হাসার কী আছে?”
সে ভেবেছে তাকে দেখে হেসেছি। বললাম, “আপনাকে ভূতের বাচ্চার মতো লাগছে।”
এবার সে রেগে গিয়ে বলল, “ফাজলামি করো? কেন হাসো জানা আছে। প্রেম করে বেড়ালে এমন দিনদুপুরে পাগলের মতো হাসেই মানুষ!”
“প্রেম করছি কে বলল?”
“আমরা কি অন্ধ নাকি? সব দেখি।”
খুব রাগ হলো আমার। “কী দেখেন আপনি? আন্দাজেই উল্টোপাল্টা বকলেই হলো!”
“তাই না? সেদিন পার্কের কাছে প্রেমলীলা শুধু আমি না, রাস্তার আরও বিশজন দেখেছে।”
“কী দেখেছেন আপনি?”
“কেন কঙ্কালের মতো দেখতে ছেলেটা আপনাকে ফুল দিচ্ছিল সেটা দেখার জন্য তৃতীয় চক্ষু লাগে?”
“শুধু এইটুকুই?”
“রিকশায় ছিলাম বলে বাকিটা দেখার সুযোগ হয়নি। তারপর কী হয়েছিল শুনি? চুমু?”
এবার চেঁচিয়ে উঠে বললাম, “আপনি তো শুধু এইটাই দেখবেন। আমি যে ফুলটা নিয়ে গরুকে খাওয়ালাম ওইটা দেখবেন না। সব জায়গায় আমার দোষ। তারপর আবার নোংরা নোংরা কথা! যত্তসব ফালতু লোক!”
তান্নি আপু আমার কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে এলেন। “কী হয়েছে রে?”
সোহান বিষয়টা চাপা দিয়ে দিল, “অংক করতে দিয়েছি, পারে না দেখে এরকম করছে।”
আমি আগুন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম৷ সে সেটা অগ্রাহ্য করে আমাকে অংক বোঝতে শুরু করল। বলা বাহুল্য কিছুই বুঝিনি৷ একটু পর যখন আমাকে করতে দিল একটাও পারলাম না।
তান্নি আপু দেখি চা, বিস্কুট আর সন্দেশ নিয়ে এসেছে। পাশে বসে বলল, “খেয়ে নাও। মিষ্টি খেলে ম্যাথ ভালো বুঝবে।”
পড়াশুনা ছেড়ে খেয়ে নিলাম। সোহানকে দেখলাম চা খেতে খেতে সাংসারিক কিছু বিষয়ে তান্নি আপুর সাথে কথা বলল৷ এই প্রথম তাকে দেখলাম এরকম কথা বলতে। ছেলেটা ঠিকঠাকই তো আছে! তাহলে আমার সাথে বাচ্চামো করে কেন?
তান্নি আপু সব গুছিয়ে চলে যেতেই আমিও বইপত্র গুছিয়ে বললাম, “আজকে থাক। আরেকদিন আসব।”
সোহান তার পুরানো রূপে ফিরে গিয়ে মুখে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলল, “কেন আবার আসতে চাও জানি তো! আমার কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে করে তোমার!”
আমি জবাব দিলাম না। ছুটে চলে এলাম সেখান থেকে।
***
এক শুক্রবারে মজার কান্ড ঘটল। বাড়ির সবাই মিলে ঠিক করল চড়ুইভাতি করা হবে। আইটেম খিচুড়ি, কয়েক পদের ভর্তা আর মুরগির ঝোল। সবার কাছ থেকে চাদা তোলা হলো। কয়েকজন বাজার করল। কয়েকজন কাটাকুটি করল। রান্না করতে উঠোনে বড় করে চুলো বানানো হলো। বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব৷
যখন বড়রা সবাই কাজ করে তখন ছোটদের তেমন কাজ থাকে না। আমি তাই দর্শক হয়ে সব দেখছিলাম। মাঝে মাঝে টুকিটাকি এগিয়ে দিচ্ছিলাম৷ সাহিদা চাচী আমাকে বসে থাকতে দেখে বললেন, “যা তো পেছনের বাগান থেকে কলাপাতা নিয়ে আয়।”
আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা ঘুরছিল। তার কথার মর্মার্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলাম, “কলাপাতার ভর্তা বানাবেন?”
আমার কথা শুনে হাসির রোল পড়ে গেল। “দেখ মেয়ে বলে কী! কলাপাতা নাকি ভর্তা করব! আরে কলাপাতায় খিচুড়ি খাব। জীবনে খাস নাই নাকি? অনেক মজা। যা নিয়ে আয়।”
জীবনে না খেলেও ব্যাপারটা না জানার মতো অতটা বোকা নই আমি। সবার হাসির পাত্র হয়ে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। বাড়ির পেছনে কলাগাছ খুঁজতে খুঁজতে এদিকে বেহাল দশা। সব গাছ আছে, শুধু কলাগাছ নেই। শেষে দুটো গাছ পাওয়া গেল পুকুরের ধারে। গাছের সাথে মানুষটাকেও পেলাম। পুকুরের ঢালে পা ছড়িয়ে বসে একমনে ছবি আঁকছে। তখন দুপুর হয়ে এলেও এদিকটাতে সুন্দর ছায়া। আমি পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে তার কানের কাছে জোরে একটা চিৎকার দিলাম৷ সে মোটেও ঘাবড়ে গেল না। বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলল, “কী সমস্যা হ্যাঁ? আমাকে সব জায়গায় ফলো করো কেন?”
“ওমা! কার এত শখ আপনাকে ফলো করার! আমি তো কলাপাতা নিতে এসেছি।”
“তো আমার কাছে কী?”
ভেঙচি কেটে বললাম, “কিছু না। আপনি আঁকেন।”
এদিকে কলাপাতা কিছুতেই ছিঁড়তে পারছি না। নিচের দিকের সব হলুদ হয়ে আছে। ভালো পাতা ওপরে। আমার দুরবস্থা দেখে হয়তো সোহানের মায়া হলো। এগিয়ে এসে পেড়ে দিল কতগুলো পাতা। এই পাতা ছিঁড়তে গিয়ে ধাক্কা লেগে পাশের একটা গাছ নড়ে গেল। সেটার ওপর একটা পাখির বাসা ছিল। নাড়া খেয়ে বাসাটা ভেঙে পড়ে গেল নিচে। বাসার ওপর ছোট্ট একটা পাখির বাচ্চা বাসার সাথে নিচে পড়তে পড়তে ছিটকে গিয়ে পড়ল সোজা সোহানের মাথার ওপর। দেখা গেল তার ঝাঁকড়া চুলের মাঝে একটা ছোট্ট পাখির বাচ্চা ঠোঁট যথাসাধ্য ফাঁকা করে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। একদম পারফেক্ট কাকের বাসা!
আমি হাঁসতে হাঁসতে পেট চেপে বসে গেলাম৷ কোনোমতে বললাম, “আপনার মাথাটা পুরো কাকের বাসা লাগছে। আমার কাছে ক্যামেরা থাকলে এক্ষুনি ছবি তুলতাম। হিহিহি…”
সোহান রেগেমেগে বলল, “এই, হাসবে না একদম! এটা সরাও শিফা! প্লিজ! প্লিজ!”
আমি উঠে বাচ্চাটাকে দু’হাতে আলতো করে উঠিয়ে নিলাম। বাসাটাও উঠিয়ে তাতে বসিয়ে দিলাম বাচ্চাকে। তারপর গাছের ডালে তুলে দিলাম বাসাটা। গাছ থেকে নেমে দেখি সোহান মাথা ঝাড়ছে৷ বলল, “আমাকে কী বললে তুমি? কাকের বাসা?”
“হ্যাঁ আমি তো আপনাকে শুরু থেকে মনে মনে তাই ডাকি। আজ ডাকটা সার্থক হলো! হিহিহি!”
সে আহত গলায় বলল, “মানুষ কত সুন্দর সুন্দর নাম দেয়। আর আমি কাকের বাসা?”
“হ্যাঁ চুলের জন্য।”
সে ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে রইল। আমি কলাপাতা নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। হঠাৎ কী মনে হতে পেছন ফিরে দেখি সোহানের মুখটা লাল হয়ে আছে। কী ফরসা মানুষটা! কালো কুচকুচে চুলে ভয়ানক সুন্দর লাগে! আবার ফিরে গিয়ে বললাম, “এই ভরদুপুরে এখানে বসে থাকবেন না তো! ঘরে চলে যান।”
“কেন?”
“পেত্নীতে ধরবে!”
সে আমার দিকে চেয়ে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলল, “সে তো ধরেই আছে, নতুন করে কী ধরবে?”
“ফাজিল!” বলে চলে এলাম।
পেছন থেকে তার হাসির শব্দ আসতে লাগল।
(চলবে)