ফিঙের_ডানা পর্ব-১৫

#ফিঙের_ডানা
পর্ব-১৫

এমন অদ্ভূতভাবে কারো বিয়ে হয় আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি। আমার নিজের কোনো শাড়ি নেই। মা দুপুরবেলা তার একটা লাল পাড় সবুজ শাড়ি আমাকে পরিয়ে দিল। আমার ব্লাউজ ছিল না। ব্লাউজ আনা হলো পাশের ঘরের এক বড় আপুর থেকে। তাও ঠিকমতো লাগল না, আঁটসাঁট হয়ে রইল।

আমাদের বিয়েটা হলো তান্নি আপুদের বসার ঘরে। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝখানে কাজী বসে আছে। সোহানকে দেখলাম মুখ শক্ত করে বসে আছে। যেন তাকে কোরবানি দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওর মুখ দেখেই আমার কলিজা শুকিয়ে এলো। সবার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে না, অন্যকিছু হচ্ছে। প্রায় সবাই শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে। শুধু সোহানের মা আর তান্নি আপুকে হাসিখুশি দেখাচ্ছে। আমাকে যখন কবুল বলতে বলা হলো, আমার বুক কাঁপতে শুরু করল। বার কয়েক বলার চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারলাম না৷ সবার বলাবলিতে বেশ কিছুক্ষণ কসরতের পর অবশেষে ‘কবুল’ বললাম৷ ততক্ষণে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে অঝোর ধারা। সোহান অবশ্য সময় নিল না। ভালোমতোই সব করল। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল সোহানকে যখন আমার সাথে বিয়ের কথা বলা হলো, তখন ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল?

সোহানের মায়ের ধারণা যে ঠিক ছিল সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরেই। তৃণা গাঁইগুঁই করছে, বিয়ে করতে চায় না৷ আমাদের বিয়ের কথা শুনেও নাকি অনেক কাহিনী করেছে। সব মিলিয়ে বাড়ির অবস্থা তাথৈবচ। রোকন ভাই আমাদের বিয়ে নিয়ে খুবই বিরক্ত। সে কিছু না বললেও বোঝা যাচ্ছে। তৃণার মা অবশ্য মেয়েকে শাসন করে যাচ্ছেন। ওদের আরও আত্নীয়রা এসেছে। সবার মধ্যে নিজেকে এত অবাঞ্ছিত মনে হতে লাগল বলার মতো না। আমার সাথে কেউ কথাও বলল না৷ তান্নি আপুও আড়ষ্ট হয়ে আছে। আমাকে বলল ওপরে চলে যেতে। ওখানে কেউ নেই৷ মা আগেই চলে গেছে আমাদের ঘরে। আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, আমার সদ্য শাশুড়ী মা যেতে দেয়নি।

পুরো সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বসে রইলাম একা। নিচ থেকে হৈ হল্লার আওয়াজ পেলাম৷ একসময় শাশুড়ী মা এসে বললেন, “নিচে এসো। নতুন বউ, একা এখানে থাকার দরকার নেই৷ রিশানের সাথে বসে থাকবে চলো।”

আমি নিচে গেলাম৷ তৃণা অবশেষে সোহানকে দেখাতেই বোধহয় বিয়েটা করে নিল। ওর এক বান্ধবী এসেছে পার্লারের কাজ জানে। খুব সাজিয়েছে তাকে। সুন্দর লাগছে। নতুন বরের সাথে মানিয়েছে দারুণ। আকদ শেষে দুজন ড্রইং রুম আলো করে ছবি তুলছে নানা ভঙ্গিমায়। এতক্ষণে বাড়ির সবাইকে খুশি খুশি লাগছে। মিষ্টি খাওয়া হচ্ছে। আমাকেও মিষ্টি দিয়ে গেল একজন। এই ঘরের একটা দেয়াল জুড়ে বেশ বড় একটা আয়না আছে। ঝকঝকে আয়নায় জোরালো আলো এসে পড়ছে। তাতে নিজেকে এক নজর দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এত সাদাসিধা লাগছে যে কেউ বলে না দিলে বিশ্বাসই করবে না এটা নতুন বউ! সোহান যখন খেয়াল করে দেখবে তখন ওর কি খুব বেশি মন খারাপ হয়ে যাবে? আফসোস হবে তৃণাকে ছেড়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য? ভাবতে ভাবতে কেমন চোখে পানি চলে এলো। কী থেকে কী হয়ে গেল এটা!

রাতের খাবারের সময় খাবার টেবিলে ডাক পড়ল। মেহমানরা সব চলে গেছে। তাদের সাথে তান্নি আপুর শ্বশুরবাড়ির লোকজনও খেয়ে নিয়েছে। বাকি রয়েছে তান্নি আপু, শাশুড়ী মা, সোহান আর আমি৷ খেতে বসে কিছুই খেতে পারলাম না৷ গলায় আটকে আসতে লাগল খাবার। কোনোরকম নাড়াচাড়া করে রেখে দিলাম। খাওয়া শেষে শুধু পুডিংটা একটু মুখে দিতে পারলাম। সোহানের মুখটা থমথমে। ঠিক করে তাকাচ্ছে না কোনোদিকে। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। এত বড় পৃথিবীতে হঠাৎ করে আমার কাঁদার জায়গার অভাব পড়ে গেছে!

চাইছিলাম মায়ের কাছে চলে যেতে। অনেক করে বলেও শাশুড়ী মাকে মানাতে পারলাম না। তার এক কথা, বিয়ে হয়েছে, বাসরও হবে আজকেই। এদিকে সোহানের সাথে থাকার কথা ভাবলে আমার গায়ে জ্বর চলে আসছে। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কোথাও। বিয়ের আগে এই ব্যাপারটা মাথায় এলে আমি মানাই করে দিতাম। কী জ্বালা!

রাত বারোটার পর ওপরে নিয়ে গেল তান্নি আপু। যেতে যেতে বলল, “আমি ভাবিনি জানো, আমার ভাইটার বিয়ে এমন করে হবে। কত আশা করেছিলাম ধুমধাম করে বিয়ে হবে! যাহোক, ভাইয়ের বউটা কিন্তু আমার ভারি পছন্দ। আমার মায়ের চোখ আছে বলতে হবে। আমি তো কোনোদিন তোমাকে নিয়ে এমনটা ভাবিনি! ভালোই হলো। আমার ননদটা একদম শাশুড়ীর মতো হয়েছে। রক্তের শিরায় শিরায় প্যাঁচ। ওটার সাথে ভাইয়ের বিয়ে হলে আমার ভাইটার কী যে হতো! তুমি ওকে সুখে রেখো গো মেয়ে। তোমার ওপর ভরসা আছে।”

ঘরের সামনে এসে মুখে আলো পড়তেই তান্নি আপু আমার মুখ দেখে বলল, “একি! কাঁদছ কেন? মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম। আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা তো কাছেই আছে। সকালেই দেখতে পাবে। ভয় পেও না কিন্তু। আমার ভাই বাঘ ভাল্লুক না!”

আমি ঘরে ঢুকে অবাক। ঘরটা ফুল দিয়ে সাজিয়েছে তান্নি আপু। কখন করল এসব? ঠিক বাসরের মতো না, তবে সুন্দর করেই সাজিয়েছে। বেডসাইড টেবিলের ওপর একটা ফুলদানিতে তাজা লাল টকটকে গোলাপ। পড়ার টেবিলে দোলচাঁপা সাজানো। বিছানায় লাল বেডশিটের ওপর সাদা কামিনী ফুল ছড়ানো। সব ফুল বাগান থেকে আনা। কী যে সুন্দর লাগছে ঘরটা। এই ঘরে ছোট আয়না। চোখ পড়তেই আমার আমার মন খারাপ শুরু। এটা বউ না হাতি!

সোহান এলো প্রায় একটার দিকে। হাতে একটা খাবার প্লেট। প্লেটে ভাত, মুরগির মাংস আর সবজি। ঢুকেই বলল, “সারাদিন কী কী খেলে?”

আমি চুপ। সে আমার সামনে বসে ঠিক সেদিনকার মতো করে ভাত মাখিয়ে মুখের তুলে খাওয়াল। আমারও সেদিনকার মতোই ভীষণ কান্না পেল। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গাল বেয়ে নামতে লাগল। সোহান সেটাকে পাত্তা না দিয়ে পুরো ভাতটুকু সুন্দর করে খাইয়ে দিল।

প্লেট রেখে ফ্রেশ হয়ে এলে তাকে ভালো করে দেখলাম৷ আজ আমি বউ সাজিনি সেটা খেয়াল করলেও ও যে বর সাজেনি তা প্রথমবার মনে পড়ল। আসলে সোহান আমার জন্য এতটা স্পেশাল যে তার বেশভূষা আমার কাছে কোনো বিষয়ই না। মানুষটাই যেন সব! আচ্ছা ও ও কি এমন করেই ভাবে? আমাকে ভালো না বাসলে এভাবে খাইয়ে দিত?

এখন সে পরে আছে গাঢ় নীল রঙের শর্টস, ছাই রঙের টিশার্ট। আজ শেভ না করাতে শাদা মুখে খোঁচা খোঁচা কালো দাঁড়ি উঁকি দিচ্ছে। চুলগুলো বরাবরের মতো কাকের বাসা। চোখদুটো খানিকটা লাল। আমি যে কী বলব বুঝতেই পারছি না। কী বলা যায়? এতদিনের সম্পর্কটা হুট করে এমন হয়ে যাবে কে জানত? সোহানের মনে কী চলছে তা জানতে প্রাণ অস্থির হয়ে, দমবন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার অবস্থা আমার। তার ওপর ভয়ের বিশাল পাথরটা বুকে চেপে বসছে আস্তে আস্তে।

সোহান আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “তুমি একটা কাজ করো তো, বউরা যেভাবে বসে থাকে সেভাবে বসো।”

“কেন?”

“বসো না রে।”

আমি খাটের মাঝামাঝি বসে পড়লাম। সে বড় একটা কাগজ, আর কয়েকটা পেন্সিল নিয়ে বসল মেঝেতে। বলল, “বসে থাকো এভাবেই। তোমার ছবি আঁকব।”

আমি রেগেমেগে বললাম, “সবসময় ফাজলামো করেন কেন?”

সে গম্ভীর গলায় বলল, “আমি সিরিয়াস।”

“আমি সিরিয়াস নই।” বলে শুয়ে পড়লাম আমি। বিছানার একদম কোণা ঘেঁষে চুপটি করে পড়ে রইলাম। শুধু মনে হতে লাগল এই বুঝি সোহান এসে হাত ধরে টেনে তুলে ধমক লাগাবে একটা। নয়তো লাইট বন্ধ করে শুতে আসবে এক্ষুনি।

তার কিছুই হলো না। অপেক্ষা করতে করতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম একটা সময়। ঘুম ভাঙল শেষ রাতে। জেগে দেখি তখনো লাইট জ্বলছে। সোহান মেঝেতে। আমার সাড়া পেয়ে মুখ তুলে সব দাঁত বের করে বিখ্যাত হাসিটা দিয়ে বলল, “আঁকা শেষ।”

আমি ভারি অবাক হয়ে তার আঁকা ছবি দেখতে গেলাম। দেখে একটা ছোটখাটো ধাক্কা খেলাম। আমাকেই সে এঁকেছে বটে, তবে ঠিক বধূর মতো করে। পেন্সিলের আঁচড়ে যতটা সুন্দর ফোঁটানো যায়, ততটাই সুন্দর করে। জমকালো শাড়ি, গয়না, গলায় ফুলের মালা, চোখভর্তি কাজল। কী সুন্দর লাগছে আমায়! আমার চোখে পানি চলে এলো।

সোহান বলল, “ফিঁচকাঁদুনে! কান্না বন্ধ করো।”

আমি এবার শব্দ করে কেঁদে ফেললাম। সে আমার খুব কাছে এসে মাথায় হাত রাখল। তারপর দু’হাতে মুখটা তুলে বলল, “এটা কোনো বিয়ে হলো বলো? আমাদের আবার বিয়ে হবে। অনেক ধুমধাম করে বউ তুলব, তাও নিজের বাড়িতে। তখন তোমাকে এভাবে সাজাব। আর তখন কেউ তোমার দিকে আঙুল তুলতে পারবে না। তোমার স্ট্যাটাস নিয়ে কথা বলবে না। সেভাবে তোমাকে গড়ে নিয়ে তারপর বউ করব। মনে থাকবে তো?”

আমি চোখভর্তি বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সে আমার পাশে বসে ভবিষ্যতের কথা বলতে থাকল। যার সারমর্ম এই, আমি এখন মায়ের কাছেই থাকব, যতদিন সোহান নিজে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে, যতদিন আমার পড়াশোনা শেষ না হয়। সবশেষে বলল, “শিফা শোনো! এতদিন বলিনি, আমার একটা আকাশ আছে। যেখানটাতে একখন্ড মেঘ শুধু তুমি৷ বহু আগে থেকেই আছ। আজ হোক, কাল হোক, আমি বিয়ে তোমাকেই করতাম৷ তাই এটা নিয়ে মনে সংশয় রেখো না। তোমাকে পছন্দ না হলে আমি বিয়েই করতাম না। মা যতই বলুক, আমি তো আর বাচ্চা নই। তবে তুমি বাচ্চা। এখন অনেক কিছু বুঝবে না। আমাকে নিয়ে দ্বিধা রেখো না। ক’দিন নাহয় আমরা প্রেম করি, হালাল প্রেম! তারপর ঠিকমতো বিয়ে হয়ে গেলে সংসার করব!”

আমি এখানেও কী যেন বলতে চাইলাম, গলা দিয়ে স্বর বের হলো না। সোহান আমার হাতদুটো ধরে কিছুক্ষণ আঙুল নিয়ে খেলা করল। খোঁপা করা চুলগুলো খুলে এলোমেলো করে দিল। তখন ফজরের আজান হচ্ছে। আজান শেষে কপালে চুমু খেয়ে বলল, “চলো নামাজ পড়ে ফেলি।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here