ফিঙের_ডানা
পর্ব-১৬
সকাল সকাল মায়ের কাছে চলে গেলাম। কেমন যেন এলোমেলো সব, বিধ্বস্ত লাগছে। এখনো নিজেকে নিয়ে, সোহানকে নিয়ে আমি যথেষ্টই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি। মা আজ অফিসে গেল না। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম। বুকের ভেতর কেমন যেন করছে। আমি না থাকলে মা কার সাথে থাকবে? বার বার একটা কথা মাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারছি না, মা তুমি কি কাল রাতে আমার জন্য কেঁদেছ? আমার কেমন বিয়ে হলো দেখো! একটু কাঁদতেও পারলাম না। নতুন জীবনের বিভ্রাটে পড়ে গতরাতে তোমার কথা আমার অতটা মনে পড়েনি। কেন বলোতো? তোমার কি বিয়ের রাতে নিজের মা বাবার জন্য কষ্ট হয়েছিল? বাবার কথা খুব মনে পড়ছে আজ। বাবা সবসময় বলতো, আমার একটাই মেয়ে। এই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে আমি জামাই সহ নিজের বাড়িতে রেখে দেব। কোথায় কী হলো? মানুষ যেমন ভাবে তার এক অংশও বাস্তবে হয় না। বাস্তবটা বড় গোলমেলে। অথবা হয়তো আমাদের পরিকল্পনাগুলোই গোলমেলে। যা হয় সেটাই সবচেয়ে সঠিক!
একসময় মা বলল, “এই বাড়িতে তো আর থাকা যাবে না। কই যাই বল তো?”
“এখানে কী সমস্যা?”
“তোর শ্বশুরবাড়িতে ভাড়া থাকব?”
“এটা তো আমার শ্বশুরবাড়ি না।”
“তা না হোক, ননাসের শ্বশুরবাড়ি তো! এরকম আত্মীয়ের বাড়িতে ভাড়া থাকা যায় না।”
“তাহলে? কোথায় যাব এখন?”
“সেটাই তো ভাবছি।”
“মা তুমি যেখানেই থাকো, আমি তোমার সাথেই থাকব। ও বাড়িতে থাকব না কিন্তু।”
মা মৃদু হেসে বলল, “ওনারা বলেছে তোকে পরে তুলে নেবে। এখন তুইও আমার সাথেই থাকবি। কিন্তু ওনারা আবার চাইল চলে যেতে হবে।”
“সোহান বলেছে এখন না, আমার পড়াশুনা শেষ হলে তারপর।”
“হ্যাঁ।”
“তখন তুমি কী করবে?”
“পাগলি, তোকে বিয়ে দেয়ার পর এমনিতেও আমার একা থাকতে হতো।”
“তোমাকে একা থাকতে হবে না। তুমি আমার সাথে থাকবে।”
“মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থাকব?”
“না৷ মেয়ের বাড়িতে থাকবে। আমি বাড়ি করে সেখানে তোমাকে রাখব।”
“আচ্ছা দেখা যাবে। আপাতত এই বাড়ি থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে হবে।”
আমার মনে পড়ল লিলিদের বাড়িতে সম্ভবত পশ্চিমমুখী দোচালা ঘরটা ফাঁকা আছে। মাকে বলতেই বলল, “চল দেখে আসি।”
আমরা ঘর দেখতে বের হলাম। গিয়ে দেখি সত্যিই তাদের দোচালা বাড়িটা ফাঁকা। দুটো ঘর, বারান্দার একপাশে রান্নাঘরের মতো। সুন্দর টানা বারান্দা। মনমতো ভাড়াটে পাচ্ছিল না দেখে গত মাস থেকে ঘরটা ফাঁকা ছিল। আমরা বলতেই ওরা খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেল। তাদেরকে আমার বিয়ের ব্যাপারে সব খুলে বলল মা। লিলির সাথে বন্ধুত্বের পর মা ওদের বাড়িতে গেছে কয়েকবার। লিলির মায়ের সাথে আমার মায়ের সম্পর্ক বেশ ভালো। বিয়ের কথা শুনে লিলিদের বাড়ির সবাই তো অবাক! লিলি চোখ গোল গোল করে পুরোটা শুনল। আমি এখানে থাকব বলে ও ভীষণ খুশি হয়ে গিয়েছিল, বিয়ের কথা শুনে মন খারাপ করে বলল, “তুই তো আবার চলে যাবি তাহলে।”
আমি ওকে আলাদা ডেকে নিয়ে বললাম, “না রে, ও বলেছে এখনই কিছু না। আমার পড়াশোনা শেষ হলে তারপর।”
“সত্যি?”
“হুম!”
“কী মজা! আমরা একসাথে থাকব। সারাদিন গল্প করব।”
“আচ্ছা।”
“তাহলে দুম করে তোর স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেল বল, তোর কাকের বাসা তোর হলো।”
“জানি না রে। বুঝতে পারছি না কিছু।”
“কেন?”
“এইযে হঠাৎ করে…এটা কি ঠিক হলো বল?”
লিলি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “খুব ঠিক হলো। তোর ভালোবাসার জোরেই তো সব হলো।”
“ধুর!”
“হিহি, কাকের বাসার গল্প করার সময় যেভাবে তোর চোখ নাক লাল হয়ে যায় তাতেই তোর ভালোবাসা টের পাওয়া যায়।”
“যাহ।”
“আচ্ছা আর বলব না। কিছু খাবি আয়।”
ওদের বাড়ি থেকে দুপুরে খেয়ে তবে ফিরতে হলো। ফিরে শুনলাম ও বাড়ি থেকে নাকি আমাদের খোঁজ করেছে। গেলাম সেখানে। মাও গেল আমার সাথে।
গিয়ে দেখি মেহমানরা সব চলে গেছে। সোহান নিজের ঘরে, রোকন ভাই অফিসে। বাড়িতে শুধু শাশুড়ী মা, তান্নি আপু আর সোহান। আমাকে সোহানের ঘরে পাঠিয়ে দিল। নিজেরা বসল ড্রইংরুমে।
সোহানের ঘরে গিয়ে দেখি সে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছে। আমি শব্দ না করেই গেছি, তাও কেমন করে জানল কে জানে, ঢুকতেই বলল, “দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আসবে প্লিজ?”
“এখানে এখন কেউ আসবে না।”
“যা বলছি করো।”
আমি দরজা আটকে দিলাম। সে লাফিয়ে উঠে বসে বলল, “তুমি সত্যি করে বলোতো তোমার মনে হচ্ছে আমাদের বিয়ে হয়েছে?”
“মানে?”
“বিয়ে হলে এমন হয়?”
“তো কেমন হয়?”
“অনুষ্ঠান হয়, গায়ে হলুদ হয়, বিয়ে বিয়ে ভাব থাকে সব জায়গায়, বরযাত্রী যায়, বিয়ে করে আনলে কত আচার করা হয়, ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়, বাসর হয়, বৌভাত হয়- আমার কিছুই হলো না। এমন বিয়ের কোনো মানে হয়? বিয়ের পরদিন আমার সিঙ্গেল লাইফই রয়ে গেল। তুমি সর্বোচ্চ হলে আমার গার্লফ্রেন্ড। বউ বউ লাগছে না।”
আমি মন খারাপ করে বললাম, “তাহলে কী আর করার?”
সে খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকে বলল, “বুঝতে পারছি না। আমার ফ্রেন্ডরা বিয়ের কথা শুনলে ছিঁড়ে ফেলবে।”
“কেন?”
“দাওয়াত দেইনি বলে। তাদের কেমন করে বলব, আমি নিজেও নিজের বিয়ের দাওয়াত পাইনি।”
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কোন রূপটা আসল বলুন তো? এই বাচ্চা বাচ্চা রূপ নাকি গতকালকেরটা?”
সোহান চোখ মটকে বলল, “দুটোই! এখন থেকে তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড। তাই সেরকম বিহেভ করছি৷ বউ হয়ে গেলে সিরিয়াস হব।”
“গতকাল রাতে বউ ছিলাম?”
“পুরোপুরি না, হাফ।”
“মানে?”
“হাফ গার্লফ্রেণ্ডদের সিনেমা দেখেছে না? আমার হয়েছে হাফ বউ।”
“দেখিনি।”
“বলো কী! আমি চারবার দেখেছি। শ্রদ্ধা কাপুর আমার ফেভারিট হিরোইন। তোমার কেমন লাগে?”
“চিনি না।”
“কী বলো চেনো না? আসো ছবি দেখাই।”
“থাক।”
“আরে দেখোই না। কী যে সুন্দর! ”
আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। সে খুব আগ্রহ নিয়ে নায়িকার ছবি বের করে আমাকে দেখাল। বলল, “আমার বিয়ের জন্য ফার্স্ট চয়েজ ছিল ও।”
“তাহলে করেন।”
সোহান মুখটা গোমড়া করে বলল, “পসিবল না। ও আমাকে বিয়ে করবে না।”
“ওহ!”
“শোনো শিফা!”
“বলেন।”
“সেকেন্ড চয়েজ কে শুনবে?”
“না।”
“আহা শোনো না!”
“শুনতে চাই না।”
“প্লিজ শোনো।”
“বলুন।”
“রানী মুখার্জি।” বলেই হো হো করে হেসে উঠল। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে মজার জোকসটা সে এইমাত্র বলে ফেলেছে। আমি রানী মুখার্জিকে চিনি। এমন আহামরি কী?
সোহান বলল, “তুমি মন খারাপ করছ কেন? আমার থার্ড চয়েজ কিন্তু তুমিই ছিলে।”
“ভালো। এখন বলুন দরজা আটকে দিতে বললেন কেন?”
“এমনি।”
“বাইরে থেকে ওরা দেখলে কী ভাববে?”
“ওরা কিছু ভাবুক এজন্যই দরজা আটকাতে বলেছি।”
“কিছু ভাবাতে হবে কেন?”
“তুমি বুঝবে না। পরে বলব।”
“ভালো কথা, আমরা এই বাড়ি থেকে চলে যাব।”
ভেবেছিলাম কথাটা শুনে সে অবাক হবে। কিন্তু কিছুই হলো না। বলল, “কবে?”
“খুব দ্রুত।”
“আচ্ছা।”
“এখন যাব?”
“উহু, এখন আমার সাথে বের হবে।”
“কোথায়?”
“যেদিকে দু্’চোখ যায়।”
“দু’চোখ কোনদিকে যাবে?”
“সম্ভবত শপিং মলের দিকে।”
“কেন?”
“তুমি দূরে চলে গেলে কথা বলব কীভাবে? কালকে বললাম না এখন থেকে আমরা প্রেম করব? প্রেম করতে হলে রাত জেগে কথা বলতে হয়। তাই তোমাকে মোবাইল কিনে দেব। ইউনিভার্সিটিতে পড়ো, অথচ মোবাইল নেই, এটা কোনো কথা?”
আমি আর কিছু বললাম না। সে তৈরি হয়ে নিল। বের হয়ে রিকশার খোঁজে মিনিট পনেরো পার করে দিল। একেকটা খালি রিকশা চলে যায়, ডাকেও না। একসময় বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “যাবেন না নাকি?”
সে হেসে উত্তর দিল, “বলেছিলাম না বিয়ের পর ছোট রিকশায় চড়ব, ছোট রিকশা খুঁজছি।”
বলতে বলতে দূর থেকে একটা রিকশা দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করল। দেখা গেল রিকশাটা সত্যি ছোট। মনে হয় একজন চড়ার জন্য বানানো। কাকের বাসাটা তার সবগুলো দাঁত বের করে ক্লোজআপ হাসি দিয়ে বলল, “চলো উঠি। আহ আমার কতদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে বলোতো?”
(চলবে)