ফিঙের_ডানা পর্ব-১৯

#ফিঙের_ডানা
পর্ব-১৯

আমরা ছোট একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। পুরো রেস্টুরেন্ট কাঠের তৈরি। মাটি থেকে কিছুটা ওপরে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। চেয়ার টেবিলগুলোও কাঠের, গোল গোল। আমি আর সোহান একটাতে বসলাম, অন্যটাতে অভি, স্নেহা। বাংলা খাবার দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। সাদা ভাত, ভর্তা, ডাল, গরুর মাংস। খেয়ে একটা কোল্ড ড্রিংস হাতে বের হয়ে পড়লাম ঘুরতে।

হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাড়ে পৌঁছুলাম। একটা গ্রাম গ্রাম গন্ধ আছে পুরোটা জায়গায়। আকাশ আজ পরিষ্কার। দূরে একখন্ড মেঘ জমে আছে। লেকের টলটলে পানি। পানিতে নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠায় পানিটাও নীল। একটা ডিঙি নৌকা আটকে আছে পাড়ে। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। আমরা লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। বসতেই প্রথমবার শুনতে পেলাম বসন্তের কোকিলের ডাক। কী যে আনন্দ হতে লাগল আমার! ইচ্ছে করল সোহানকে জড়িয়ে ধরে বলি, এত চমৎকার জায়গা আমি অনেকদিন দেখিনি। তোমাকে অনেক ভালোবাসা। কিন্তু বলতে কি আর পারি? সোহান আমার মুখ দেখেই বোধহয় বুঝে নিল। নানান গল্প করতে থাকল, যার বেশিরভাগই পাগলাটে, এলোমেলো কথা।

রোদ পড়ে আসলে আমরা উঠে হাঁটতে গেলাম। এখানে ছোট্ট একটা জঙ্গল আছে যেটা অভয়ারণ্যের মতো করা হয়েছে। খোলা অবস্থায় কয়েকটা হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে, গাছে গাছে বানর ঝুলছে, আছে অজস্র পাখি আর ছোট একটা জলাশয়ে দুটো কুমির। জলাশয়ের চারপাশে অবশ্য কাঁটাতারের বেড়া দেয়া।

ওটার ভেতর দিয়ে হাঁটতে যা ভালো লাগল! গাছের পাতা ঝরে পড়ে আছে পথময়। রঙ বেরঙের পাতাগুলো বিকেলের নিভে আসা আলোয় গভীর রঙিন দেখাচ্ছে। পুরো জায়গাটা অদ্ভূত মায়াময়। আমরা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেলাম। পাখির ডাকাডাকিতে কান পাতা দায়। বনের মাঝে সিমেন্টে বাঁধানো একটা বসার জায়গা পাওয়া গেল। বসলাম সেখানে। সোহান হঠাৎ কবিতা আবৃত্তি শুরু করল। যদিও তার গলায় আবৃত্তি খুব একটা সুবিধার নয়, তবে এই পরিবেশে কেমন মানিয়ে নিল..

“নগরীর কোলাহল থেকে দূরে,
এক শান্তির নীড়ে
পাখিডাকা সন্ধ্যায় গোধূলির আলোয়
ভালোবাসা বয়ে যায় নদীর মতো।
আমি তোমায় খুঁজি বারংবার
পেয়েও পাই না…”

আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। পেয়েও পাই না মানে কী? আমি তো পাশেই আছে। মুখ ফসকে বলে ফেললাম, “তুমি কবিতা কাকে নিয়ে লেখ?”

সোহান অদ্ভূত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “কবিতা নির্দিষ্ট কাউকে নিয়ে লিখতে হয় নাকি?”

“নয় তো কী?”

সে একটু হেসে বলল, “কবিতা হলো বিশ্বজনীন একটা ব্যাপার। আমরা যখন কবিতা পড়ি বা লিখি তখন বিশেষ একজন খুব কমই মাথায় থাকে। শুধু বুকের ভেতর অজস্র শূন্যতা থাকে, যেটা শুধু কবিতা দিয়েই ভরাট করা যায়। আমার পছন্দের মানুষ যতই থাকুক, হৃদয়ের চাহিদা অসীম। এই চাহিদা সবসময় পূরণ না হওয়ায় ফাঁকফোকর থেকে যায়। কবিতায় যে ভাব থাকে তা ওই ক্ষতগুলোকে শান্তির পরশ দিয়ে যায়। কষ্টের কবিতাতেও তাই সুখ থাকে।”

আমি কিছুই বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম আমার স্বামীটি আমায় নিয়ে কবিতা লেখে না। অথচ এতদিন ভাবতাম! ধুর!

সোহান আমার দিকে ঘুরে বসল। দুই হাতে আমার মুখটা তুলে বলল, “জানো, প্রথমবার তোমাকে যখন দেখেছি, তখন থেকে আমার কবিতাগুলো আরও জীবন্ত হয়ে গেছে। তোমাকে দেখলে জলজ্যান্ত কবিতা মনে হয়। তাই তো বেশি কাছে আসতে ভয় পাই। কবিতা ফুরিয়ে না যায়!”

“কী বলো এসব?”

“কিছু না। চলো এগোই।”

আমরা উঠে পড়লাম। আরও কিছুদূর ঘুরলাম। আজ পূর্নিমা। পূর্নিমায় নাকি এখানে ইলেকট্রিক বাতি জ্বালানো হয় না, যাতে দর্শনার্থীরা জ্যোৎস্নার আলো পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে। কথাটা ভেবেই বেশ আনন্দ হচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে আসার মুখে আমরা একটা ছোট্ট দোকানে বসে চা আর নাম না জানা পিঠে খেলাম।

কিছুটা দূরে গানের আসর বসেছে। সেখানে গিয়ে বসলাম। আধুনিক কিছু গায়ক গায়িকা এসেছে। তারা ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে পালা করে গান গাইছে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। কয়েকজন দর্শনার্থী তাদের ঘিরে বসে গান শুনছে। আমরাও সেখানে গিয়ে বসলাম। একটা মেয়ে কী সুন্দর করে গাইল,

…এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি
দেখো ওই ঝিলিমিলি চাঁদ সারারাত আকাশে সলমাজরি..

আমি সোহানের কাঁধে মাথা রাখলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে গেলাম গান। এত আনন্দ আমি কোথায় রাখব?

রাতে চাঁদের আলোয় নৌকাভ্রমনে গেলাম। সে এক অভিনব ব্যাপার। সারা লেকের পানি চকচকে আলোয় ভেসে যাচ্ছে, আর আমরা নৌকায় বসে জোছনা ভিজে যাচ্ছি। নিজেকে রূপকথার গল্পের চরিত্র মনে হলো যেন।

সেখান থেকে ফিরে চাইনিজ খাবার খেয়ে অবশেষে শুতে গেলাম ছোট্ট একটা কটেজে। বাইরে থেকে ছাউনির মতো মনে হলেও ভেতরটা আধুনিক। এটাচড বাথরুমটাও ঝকঝকে। এরকম জায়গায় আগে কখনো আসিনি। সোহান জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগল?”

“আমি বলে বোঝাতে পারব না।”

“আচ্ছা বোঝাতে হবে না। এখন জামা বদলে শুয়ে পড়ো। সকালেই ফিরব।”

“ফিরে যাব?” আমি ভেবেছিলাম আগামীকালও বুঝি থাকব এখানে।

সোহান মনের ভাব বুঝে বলল, “এখানে থাকতে টাকা লাগে ডার্লিং। এখন বেশি টাকা নিয়ে আসিনি। যখন টাকা হবে, তোমাকে এরকম একটা রিসোর্ট বানিয়ে দেব।”

“যাহ এরকম বানানো যায় নাকি?”

“যাবে না কেন?”

“কিজানি!”

“হুমায়ুন আহমেদ বানিয়েছেন না, নুহাশ পল্লী। সেরকম বানিয়ে দেব।”

“আমি কখনো সেখানে যাইনি।”

“তাই? তাহলে পরের বার সেখানেই যাওয়া যাবে।”

“দারুণ হবে!”

“হুম।”

সোহান বাথরুমে চলে গেল। এবার আমার অন্য চিন্তা। সোহানের সাথে এর আগে এক রাত থেকেছি, যার পুরোটা সে ছবি এঁকে কাটিয়েছে। আজ? ভয়ে কেমন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো।

অবশ্য ভয়টা বেশিক্ষণ জীবন্ত রইল না, আমি হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি জনাব বিছানার একপাশে শুয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। কোনো মানুষ এত দ্রুত কীভাবে ঘুমাতে পারে কে জানে!

আমার ঘুম এলো অনেক দেরিতে। চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে খোলা জানলা দিয়ে। সেই আলোর কারুকাজ দেখতে দেখতে নানান কথা ভাবলাম। সোহানের দিকে চেয়ে রইলাম কতক্ষণ। ইচ্ছে করল তাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আড়ষ্টতা বোধ হলো খুব। তার একটা হাত নিয়ে তার ওপর মাথা রাখতেই কোথা থেকে রাজ্যের ঘুম জড়ো হলো চোখে। ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম যখন ভাঙল তখন ভীষণ আশ্চর্য হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম গাড়িতে। গাড়িটা খুব সম্ভবত ঢাকার দিকে চলছে। কখন বিছানা থেকে গাড়িতে চলে এলাম কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। সোহান তার পাশের জানালার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আমার সাড়া পেয়ে স্মিত হেসে বলল, “ঘুম হলো?”

“গাড়িতে কখন উঠলাম?”

“ঘুমে ঘুমে।”

“মানে?”

“এত সুন্দর করে ঘুমাচ্ছিলে যে জাগাতে ইচ্ছে হয়নি। তুলে নিয়ে এসেছি।”

গাড়ির আয়নায় নিজের ঘুম থেকে জেগে ওঠা মোটামুটি বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বললাম, “এভাবে না আনলেই হতো।”

সোহান একটা পানির বোতল আর চিরুনি এগিয়ে দিয়ে বলল, “ঠিক হয়ে নাও। বাথরুমে যাওয়ার হলে ওয়েট করো, একটু পর একটা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি থামবে।”

গাড়ি একটু পর থামল তেল ভরতে। আমরা বের হলাম। স্নেহার সাথে ওয়াশরুমে গিয়ে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে এলাম। গতকাল আমরা আলাদা ঘুরেছি৷ ওদের সাথে খুব একটা দেখাও হয়নি।

বেরিয়ে দেখি সোহান বুকের ওপর হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। অভি ভাই একটু দূরে সিগারেট টানছে। আমার সন্দেহ হলো, সোহানও কি সিগারেট খায়?

স্নেহা কেমন করে যেন আমার মনের কথা বুঝে গেল। বলল, “তোমার বরও খায়। সবসময় না, মাঝে মধ্যে।”

বর কথাটা একদম কানে বাজল। স্নেহা তো জানে আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা। তবে? স্নেহা রহস্য করে বলল, “আমি সব জানি। সোহান বলেছে। জোর করে বলিয়েছি। অভি অবশ্য জানে না এখনো।”

আমি কথাটা ধরতে পারলাম না। “কেমন করে বলালেন?”

স্নেহা একটা থামের সাথে হেলান দিয়ে বলল, “তুমি কি জানো সোহান ভার্সিটিতে কতটা পপুলার? এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে, তার ওপর রাজনীতি করে। মাথা গরম করা বক্তৃতা দেয়, আবার কবিতা লেখে। সব মিলিয়ে মেয়েদের অন্ধ ক্রাশ! এক টিচারের মেয়ে আছে দীপা, সে তো ওর জন্য পুরো পাগল। কী না করেছে ওর জন্য! একবার সবার সামনে জড়িয়েও ধরেছিল। সোহান পাত্তা দেয়নি। এসব মেয়ে নাকি তার চয়েজের না। কিছুদিন আগে শুনলাম ওর গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। ভেবেছিলাম কী না কী! ডোন্ট মাইন্ড! গতকাল তোমাকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম৷ এত্ত সাদাসিধা একটা মেয়ে ওর পছন্দ ভাবতেও পারিনি। তোমাদের দূর থেকে ফলো করেছি আমরা। মানুষের সাথে ভালোই চলেছি, তাই মানুষ চিনি। তোমাকে দেখেই মনে হয়েছে বয়ফ্রেন্ডের সাথে হুট করে ঘুরতে আসার মেয়ে তুমি নও। তাই আজ সকালে জোর করেছি বলার জন্য। শেষ পর্যন্ত বলেছে।”

আমি কেমন ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সবগুলো কথা হজম করতে সময় লাগবে। সোহান রাজনীতি করে, আর আমি জানতামই না। তবে সবচেয়ে বেশি যে কথাটা মনে বাঁধছে সেটাই বললাম, “উনি নিশ্চয়ই বলেছে আমাদের বিয়ে কেমন করে হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“আসলে উনার মা জোর করে…”

“তো কী? ও তো তোমাকে লাইক করত! সত্যি বলতে কী, আমার নিজেরও তোমাকে ভালো লেগেছে। ইউ আর সো সুইট! ওই দীপার সাথে থাকলে সোহানটা এক মাসেই পাগল হয়ে যেত। ও এখন যে ছেলেটার সাথে রিলেশনে আছে সেটা আধপাগল হয়ে গেছে।”

“কেন?”

“সেটা আর জানতে হবে না।”

“আচ্ছা।”

“এই তুমি কি আমাকে ওরকম মেয়ে ভাবছ?”

“কীরকম?”

“এইযে বয়ফ্রেন্ডের সাথে দূরে চলে এসেছি। আমরা কিন্তু রাতে আলাদা ছিলাম। আমি অতটাও আধুনিক নই। একটু ব্যাকডেটেড আছি।”

আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। শুধু শুধু মেয়েটাকে ভুল বুঝছিলাম। তেল ভরা হয়ে গেছে আগেই। ডাকছে আমাদের। আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। পথে আরেকবার থেমে নাস্তা করে নিলাম। তারপর সোজা বাসা। সোহান পৌঁছে দিল আমার। ফেরার আগে বলল, “ভালো থেকো শিফা।”

“আপনিও।”

“দোয়া করো।”

“আপনিও।”

যেতে যেতে আবার ফিরে এসে বলল, “শিফা শোনো একটা জরুরি কথা বলব।”

“হুম।”

“একটা কথা মাথায় রেখো, আমি কখনো খারাপ কিছু করব না। আমার ওপর বিশ্বাস রেখো। আসছি।”

বলে চলে গেল সে। আমি তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। গত চব্বিশ ঘন্টার স্মৃতি মস্তিষ্কে কিলবিল করছে। এই স্মৃতিটুকু খুব প্রয়োজন ছিল। যতদিন আমি ওর সাথে সবসময়ের জন্য না থাকতে পারছি। কিন্তু ও শেষে এসব বলে গেল কেন?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here