ফিঙের_ডানা পর্ব-৬

ফিঙের_ডানা
পর্ব-৬

আমার ভর্তির সময় চলে এসেছে এর মধ্যেই। কাছেই একটা কলেজের ফর্ম তুলেছি৷ লিলি আর আমি এক কলেজেই ভর্তি হব। ও মানবিকের ছাত্রী। অনেক আগেই ভেবে রেখেছে বাংলা নিয়ে পড়বে। এদিকে আমি পড়েছি বিজ্ঞান বিভাগে। বিষয় পছন্দের সময় একেবারে বিপাকে পড়ে গেলাম। কী নেব কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না। অনেক ভাবার পর মনে পড়ল সোহানের কাছে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? আমার মা আগের যুগে ডিগ্রী পাস। সায়েন্স নিয়েও পড়েননি। তাই তার কাছে পরামর্শ চেয়ে লাভ নেই। কিন্তু সোহানের কাছে যেতে সংকোচ হচ্ছে। সেদিন যা করল! তারপর সামনে পড়লেও আর কথা বলিনি। রাগ দেখিয়েছি প্রতিবার। আর এটা তার পাওনাই ছিল। কেন বাপু অমন কথা বলবে তুমি! এত বেহায়া কেন?

আবার কয়েকদিন কথা না বলে আমার নিজেরই আর সহ্য হচ্ছে না। মনের বরফ কবেই গলে জল হয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েকবার বিকেলে বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে বসে থেকে এসেছি। কাকের বাসাটা আসেনি৷ পায়ের তলার ঘাস দুমড়ে মুচড়ে ফিরে এসেছি৷ এবার সুযোগ পেয়ে ভাবলাম যাই। এভাবে আর কতদিন কথা না বলে থাকব?

বিকেলে গেলাম তাদের বাসায়। কলিংবেল চাপতেই তান্নি আপু দরজা খুলে দিল। দেখলাম খুব সেজেগুজে আছে। পার্পল রঙা শাড়ি আর ম্যাচিং লিপস্টিক দিয়েছে। চুলগুলো খোঁপা করা। কী যে সুন্দর লাগছে! ফোলা পেটটাও মানিয়ে গেছে চেহারার সাথে। মনে হচ্ছে এটার জন্যই তাকে আরও ভালো দেখাচ্ছে। পেছনে ক্যামেরা হাতে দেখতে পেলাম রোকন ভাইকে। তাকে এর আগে একবার মাত্র দেখেছি। পুরুষালী সুন্দর চেহারা আর গড়ন। তান্নি আপুর সাথে যা মানায় না!

তান্নি আপু বলল, “এখন এসেছ! এখন একটুও কথা বলতে পারব না গো, একটু বের হচ্ছি।”

রোকন ভাই বলল, “আরে দরজা থেকে ফিরিয়ে দেবে নাকি? ভেতরে আসতে বলো!”

আমি দ্রুত বললাম, “সোহান ভাইয়া আছে? আমি কলেজে ভর্তি ব্যাপারে তার সাথে একটু পরামর্শ করতে এসেছিলাম।”

তান্নি আপু খুশি হলো তাকে সময় দিতে হবে না ভেবে। বলল, “হ্যাঁ সোহান ওর ঘরেই। দাঁড়াও ডাকছি।”

সোহানের কাছে আমাকে রেখে চলে গেল তারা দু’জন। কাছেই একটা পার্ক আছে সেখানে ছবি তুলবে। সোহান আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। আমার সত্যি বলতে ভয় ভয় করতে শুরু করেছে। না জানি আজ একা পেয়ে কীসব বলবে! আবার আগ্রহও হচ্ছিল। আরেকটা ছবি আঁকার কথা বলছিল সেদিন। এঁকেছে নাকি?

সোহান আমাকে বসতে বলল খাটে। নিজে টেবিলের চেয়ারে বসল। টেবিলে ছড়ানো কাগজে নানা আঁকিবুঁকি। আমাকে বলল, “দুই মিনিট চুপচাপ বসতে পারবে?”

আমি মাথা হেলিয়ে সায় দিলাম।

সে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী একটা হিসেব করে করে আঁকতে শুরু করল। সোহানকে এর আগে যতবার দেখেছি খুব প্রাণবন্ত, হাসি মজা করা একটা চরিত্র মনে হয়েছে। তার গাম্ভীর্য চোখে পড়েনি। আজ প্রথমবার দেখলাম এই মানুষটাই কত সিরিয়াস হয়ে পড়াশোনা করতে পারে। দুই মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট পর তার কাজ শেষ হলো। আমার দিকে ফিরে ঠোঁটের কোণে মৃদু একটা হাসি দিয়ে বলল, “কেমন দেখলে?”

“কী দেখব?”

“কেন আমাকে।”

“আপনাকে দেখব কেন?” আমার খুব লজ্জা লাগতে শুরু করল। সে খেয়াল করল কখন যে তাকে দেখছি! আমি তো পড়ায় মনোযোগী দেখে সরল মনে তাকিয়ে ছিলাম।

সে হাসলেও আর কথা বাড়াল না। জিজ্ঞেস করল, “পড়ার ব্যাপারে কী বলতে এসেছ?”

“কোন সাবজেক্টে ভর্তি হব বুঝতে পারছি না।”

“আচ্ছা একটা কথা বলো তো, তুমি পাবলিক ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিলে না কেন? জিপিএ ভালো ছিল না?”

“সেটা না.. এদিকে ভালো ভার্সিটি নেই। আর মাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকা সম্ভব নয়। আমার মা ছাড়া আর মায়ের আমি ছাড়া তো কেউ নেই।”

সোহানের মুখটা আবারও খানিকটা গম্ভীর দেখাল। বলল, “ঠিক আছে। তুমি কি সায়েন্সের?”

“হ্যাঁ।”

“কোন সাবজেক্ট সহজ মনে হয়?”

একটু ভেবে বললাম, “বায়োলজি।”

“তাহলে জুলজি বা বোটানিতে ট্রাই করো।”

“উহু..বোটানি পছন্দ নয়। জুলজিতে কেন যেন পড়তে ইচ্ছে করে না। খারাপ লাগে যে তা নয়, ইচ্ছেই করে না।”

“তাহলে কী? কেমিস্ট্রি?”

“না না!” মাথা নেড়ে বললাম, “কেমিস্ট্রি অত ভালো বুঝি না। আর ওটাতে পয়েন্টও খারাপ। নেবে না হয়ত। ফিজিক্স বা ম্যাথে পড়তে হবে।”

“এই দুটোর মধ্যে কনফিউশন?”

“হ্যাঁ।”

“সবচেয়ে ভালো হয় তুমি নিজেই ভাবলে। কারন পড়বে তুমি, আমি না।”

“তবুও একটা সাহায্য করলে ভালো হতো।”

“আচ্ছা কিন্তু পরে দুষতে পারবে না আমাকে। ফিজিক্স নাও। আমি তাহলে তোমাকে হয়তো বুঝিয়ে দিতে পারব পড়া। ফিজিক্সে আমি বরাবরই ভালো ছিলাম। ম্যাথটা করতে তেমন ভালো লাগত না। আর যদি জানতে চাও কোনটা সাবজেক্ট হিসেবে কাজে লাগবে বা বেটার হব, তাহলেও ফিজিক্সের কথাই বলব।”

আমারও তাই মনে হচ্ছিল। সোহানের ভরসা পেয়ে তক্ষুনি ঠিক করে ফেললাম ফার্স্ট চয়েজ দেব ফিজিক্স। এটাতে পয়েন্টও ভালো আমার।

কাজের কথা শেষ। সোহানের দিকে তাকিয়ে দেখি কী যেন ভাবছে। খেয়াল হলো আজ সে খুব সুন্দর করে কথা বলেছে আমার সাথে। বড়দের মতো করে। একটাও উল্টোপাল্টা কথা বলেনি। এভাবে তাকে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। অবশ্য ঘরে রিশান আছে। যদিও সে উপুড় হয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমি যাই তাহলে।”

সোহান হঠাৎ বলল, “তুমি আমার ওপর অনেক রাগ করেছ শিফা?”

আমার মুখে সহসা উত্তর জোগাল না। কী বলব? সে উত্তরের আশা না করেই আবার বলল, “তোমার সাথে দুষ্টুমি করতে ভালো লাগে বলে করি। তুমি কিছু মনে করো না। আই অ্যাম সরি!”

তার গম্ভীর, খানিকটা অনুশোচনায় ভরা থমথমে মুখটা দেখে বুকের ভেতরটাতে কেমন একটা কষ্টের অনুভূতি পাক খেয়ে উঠল। চোখ ভর্তি হয়ে গেল পানিতে। আমি কোনো কথা না বলে এক দৌড়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে ছুটে চলে গেলাম।

পেছন থেকে কয়েকবার ডাকল সোহান। শুনলাম না। ঘরে বসেও কিছুক্ষণ কাঁদলাম। কেন কান্না পাচ্ছে জানি না। হয়তো তার সাথে ক’দিন কথা বলতে পারিনি তাই। কিংবা তার কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে। তবে সবচেয়ে বড় যে সম্ভাবনাটা মাথায় উঁকি দিচ্ছে, কিন্তু মনে আনতে ভয় হচ্ছে সেটা হলো, সোহান বলেছে সে মজা করে এসব করেছে। তার মানে কি পুরোটাই মজা। এই যে আকারে ইঙ্গিতে নানা কথা বলে ভালোবাসার কথাটা জানিয়েছে সেটাও কি মজা?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here