ফিঙের_ডানা পর্ব-৮

#ফিঙের_ডানা
পর্ব-৮

আমরা নৌকা থেকে নামলাম ভিড়ভাট্টা থেকে দূরে। বালুময় তীরে। সেখান থেকে একটু গেলেই সরিষা ক্ষেত। অপূর্ব দেখতে! আমরা তীর ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। অনেকক্ষন কেউ কোনো কথা বলছি না। ঠান্ডা ভেজা বালুতে শামুকের খোলস আটকে আছে৷ আর তীরের খুব কাছ দিয়ে হাঁটছি বলে ঢেউয়ের পানি একেক সময় পায়ের ওপর গড়িয়ে চলে আসছে। সোহানের দেখাদেখি জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিলাম। নরম বালিতে পা দেবে যায়। আর কী আরাম!

সোহান হঠাৎ বলল, “ভালো লাগছে?”

আমি মৃদু হাসলাম। ভালো লাগা বর্ননা করার ভাষা আমার জানা নেই।

সে বলল, “তুমি আমাকে কী ভাবো বলো তো? পাগল ছাগল? নাকি অন্যকিছু?”

“এসব ভাবব কেন?”

“এইযে শুরুর দিন থেকে তোমার সাথে উল্টোপাল্টা ব্যবহার করছি! নিশ্চয়ই ভাবছ আমি খারাপ ছেলে!”

“ধুর তা কেন হবে? ওসব ভাবলে কি আমি আসতাম?”

কাকের বাসা কথাটা শুনে এত মজা পেল যে হাসতে শুরু করল। সেই হাসি আর থামতেই চায় না। আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করি কেন হাসছে, উত্তর দেয় না। শেষে আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম, “আর যাব না আপনার সাথে। আগে বলুন হাসছেন কেন?”

সে বলল, “আরে এসো তো! আমি হাসছি তোমার কথা শুনে। তুমি আমার সাথে এসেছ আমি ভালো ছেলে বলে না, তোমার আমাকে ভালো লাগে বলে।”

“আমি কোনেদিন বলেছি আপনাকে আমার ভালো লাগে?”

“না তো!”

“তাহলে?”

“তোমার ভেতরে যা আছে পুরোটায় চেহারা দেখে বোঝা যায়৷ মুখে বলতে হয় না।”

“মোটেও তেমন কিছু না।”

“তাহলে কী?”

“ভেবেছি আপনার বুঝি কোনো দরকার তাই আমাকে নিয়ে এসেছেন।”

সে হো হো করে হেসে বলল, “আচ্ছা বাদ দাও, বাচ্চা মেয়ে তুমি।”

আবার দাঁড়িয়ে গেলাম। “আমি মোটেও বাচ্চা না৷ আমার বয়সী অনেক মেয়ে বাচ্চার মা হয়ে গেছে জানেন?”

সে আবারও হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, “তাই? তো তুমি হলে না কেন?”

“বিয়ে হয়নি তাই!”

“বিয়ে করছ না কেন?”

“আপনি এইসব প্রশ্ন করছেন কেন?”

“এমনি। চলো এবার ফিরতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে নয়তো।”

আমরা সরিষা ক্ষেতের ভেতরে আইল দিয়ে হেঁটে রওনা দিলাম। এদিকটাতে একটা গ্রাম গ্রাম ভাব আছে। মাটির ঘরবাড়ি, প্রচুর গাছপালা, কাচা সড়ক। জিজ্ঞেস করলাম, “হেঁটে ফিরব?”

“না, বাড়ি অনেক দূর। একটু গিয়ে রিকশা পাব।”

“আমার গলা শুকিয়ে গেছে।”

“দেখো ভুলে গেছি। তোমাকে কিছু খাওয়ানো হলো না আজ।”

“খাওয়াতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি শুধু পানি খেতে চেয়েছি।”

“বাইরে নিয়ে এলে খাওয়াতে হয় এটা নিয়ম।”

“কে নিয়ম বানিয়েছে?”

“যে প্রথম কোনো মেয়েকে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত সে!”

“আর যদি আমি ছেলে হতাম?”

“তবুও খাওয়াতাম। তুমি ছোট তো তাই।”

“তো কী? আপনি অনেক বড়? টাকা ইনকাম করেন?”

সোহান অবাক হয়ে বলল, “তুমি এত কথা জানো! দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছ প্লেটে তুলে খেতে পারো না!”

“খালি ফালতু কথা! চলুন ওই বাড়িটাতে যাই, পানি চাইলেই দেবে।”

আশেপাশে দোকানপাট নেই। অতএব সোহান রাজি হলো। গাছপালায় ঘেরা বড় একটা বাড়ি৷ উঠানের একপাশে রান্নাঘর। মাটির চুলা৷ গিয়ে দেখি সেখানে চিতই পিঠা বানাচ্ছে এক মহিলা। আমরা পানি খেতে চাইলে পানির সাথে পিঠাও দিল দুজনকে। না করে লাভ হলো না। খাইয়ে ছাড়ল।

বের হওয়ার পর সোহান বলল, “অতিথিপরায়ণ বাঙালি! এজন্য দেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না।”

“আপনি কি বিদেশ যাবেন নাকি?”

“যাওয়ার কথা!”

কথাটা শুনেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল৷ সোহান ভালো জায়গায় পড়ছে, ওর একটা গোছানো ভবিষ্যৎ আছে। মাঝখানে আমি সম্পূর্ণই অযাচিত, বেমানান। জানতে ইচ্ছে হলেও জিজ্ঞেস করলাম না কবে যাবে। সে নিজেই বলল, “সবসময়ই ইচ্ছে ছিল হায়ার এডুকেশনের জন্য বিদেশ যাব৷ বলেও রেখেছি বাড়িতে৷ আর একটা বছর এখানে, তারপর কোথায় থাকব জানি না।”

আমার পুরোটা দিনের ভালোলাগাগুলো কর্পূরের মতো উবে গেল। সোহান সেটা খেয়াল করে বলল, “তোমাকে ভালো লাগে কেন জানো? তুমি ফিলিংস চেপে রেখে অভিনয় করে যেতে পারো না৷ আমি মেয়েদের সাথে কমই মিশি, তবুও যাদের সাথে প্রয়োজনে মিশতে হয় তাদের কারো মধ্যেই সহজ সরল অভিব্যাক্তি দেখিনি আমি, যেটা তোমার মধ্যে আছে৷ সবাই যেন নিজেকে অনন্য প্রমান করার একটা প্রতিযোগিতায় মেতে আছে৷ জামাকাপড়, জীবনযাপন থেকে শুরু করে ফেসবুকে ছবি দেয়ার পর্যন্ত প্রতিযোগিতা চলে৷ আমি একটা সময় ভাবতাম মেয়েদের মানসিকতাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগের মতো ন্যাচারাল ভাবটি বুঝি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত। অবশ্য ছেলেদেরও একই অবস্থা! তোমাকে দেখে মনে হলো আরও দেখার বাকি আছে আমার।”

আমি চুপ করে শুনে গেলাম। তার মানে আমার সরলতা তার পছন্দ। এজন্য এতকিছু! শুধুই এজন্য!

সোহান বলল, “কী এত ভাবছ? কী বলেছি বুঝেছ? নাকি বোঝেনি? বাচ্চা মেয়ে তো!”

আমি কী ভেবে বলে ফেললাম, “বাচ্চা বলেই অন্যদের মতো নই। বড় হলে হয়তো সবার থেকে আলাদা করতে পারবেন না।”

সোহান কেমন গম্ভীর হয়ে গেল কথাটা শুনে। সামনেই রিকশা পাওয়া গেল। সেদিকে না গিয়ে সোহান আমাকে নিয়ে গেল একটা টং দোকানে৷ ভিড় অতটা নেই। দুজন লোক বসে নিচু গলায় কথাবার্তা বলছে৷ সে গিয়ে চা চাইল৷ এখানে নাকি খুব ভালো গুড়ের চা পাওয়া যায়৷ এদিকে সন্ধ্যা হতে বড়জোর মিনিট পনেরো বাকি৷ বললাম, “যেতে হবে তো!”

সে একটু হেসে বলল, “আমি আছি তো!”

ওয়ান টাইম কাপে চা নিয়ে দু’জনে চললাম ফিরতি পথে। তখন রিকশা ছিল, এখন আর খালি পাওয়া গেল না। আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম সামনে। সোহান বলল, “চা ভালো?”

চা আসলে ভালোই ছিল, আমার মন খারাপ থাকায় সবটা কেমন তিতকুটে লাগছে৷ সোহানকেও আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে সব মেকি। দু’দিন পর সে ব্যাগ গুছিয়ে আমাকে আলবিদা বলে চলে যাবে দূরদেশে। ফিরবে সুন্দরী বউ নিয়ে।

সোহান বেশ আদুরে গলায় বলল, “শোনো তো একটা কথা!”

“কী?”

“তুমি কোনোদিন চেঞ্জ হবে না৷ এমনই থাকবে। আমি জানি।”

“ভালো!”

“আরেকটা কথা শোনো!

” বলুন।”

“আজকের কথাটা মনে রাখবে।”

“কোন কথা?”

“নৌকায় যেটা বলেছিলাম।”

আমার মনে পড়ে গেল কথাটা৷ কী ভীষণ আবেগ নিয়ে বলেছিল সে৷ আমার মাথায় হাজারটা প্রশ্ন জমা হতে থাকল। কিন্তু করা হলো না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমরা রিকশায় উঠে বসেছি৷ সোহানের শেষ কথাটায় আমার মনের রঙ আবার ফিরতে শুরু করেছে। বৃষ্টির দিন ছিল বলে পুরো আকাশ আজ লালচে হয়ে আছে৷ লালের প্রতিফলন ঘটেছে পুরো প্রকৃতিতে। সোহানের রহস্যময় মুখটা তাতে আরও রহস্যময় লাগছে। আমি রিকশায় বসে পুরো সময়টা একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ ও দেখেও কিছু বলল না। যেন এটা স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার! বাড়িতে ঢোকার আগে রাস্তার পাশে দোকান থেকে একটা চিপসের প্যাকেট কিনে দিয়ে বলল, “এটা খেতে খেতে যাও৷”

ফিরে দেখে চাচীরা কেউ নেই। আজান দিচ্ছে তখন৷ নিশ্চিত কারও ঘরে আড্ডা বসেছে৷ আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে জামাকাপড় বদলে নিলাম৷ গুড়ের চা টা এত ভালো যে মুখে লেগে আছে। একদিন নিজে বানাতে হবে। ভালো হলে কাকের বাসাটাকেও খাওয়ানো যাবে৷ ও কী করছে এখন? আচ্ছা তান্নি আপু কি জানে, সোহান আজ আমার সাথে বাইরে গিয়েছিল? অবশ্য জানলেই কী, উনিও আমাকে বাচ্চা একটা মেয়ে ছাড়া কিছু ভাবে না। মনে পড়ল, সোহান আজ আমার অনেকগুলো ছবি তুলেছে, তাও জোর করে। ছবিগুলো কেমন হয়েছে দেখা হয়নি। কাল সকালে ছবি দেখতে যাব।

রাতে মা ফেরার পর চাচীরা কী বলল কে জানে! মা আমার সাথে খুব স্বাভাবিক। আস্বস্ত হলাম আমি৷

রাতে শুয়ে পড়ার পর ঘর যখন অন্ধকার হলো, মা বলল, “তুই ওই বাড়িওয়ালাদের ছেলেটার সাথে আর কোনোদিন বাইরে যাবি না৷ বাপ নেই তোর। আমি সবার সাথে যুদ্ধ করে তোকে নিয়ে একা থাকতে এসেছি। আমাকে যেন কোনোভাবে ছোট না হতে হয় কারো সামনে। মাথায় রাখিস কথাগুলো।”

কোনো প্রশ্ন না, শুধু আদেশ দিয়ে মা অন্যদিক ফিরে শুয়ে পড়ল। মায়ের আদেশ ফেলা সম্ভব না। আমার প্রচন্ড কান্না পেল। কিন্তু চেপে রাখলাম অনেক কষ্টে, কাঁদলেই মা বুঝে যাবে। মা তো ঠিকই বলেছে। সোহান যত যাই বলুক, যেটা হচ্ছে, ভুল হচ্ছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here