#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–32
কনফারেন্স রুম থেকে প্রায় দৌঁড়ে বের হয় ইমান। তার পথ আটকিয়ে জুই প্রশ্ন করল, ” বাইরে কেন যাচ্ছো? কনফারেন্স শুরু হয়ে গেছে তো। এটা একটা জরুরি মিটিং। এখন বাইরে যাওয়া কী উচিত? ”
ইমান বিড়বিড় করে বলে, ” মিরার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চেয়ে আর কিছুই আমার জন্য এখন জরুরি নয়। ঠিক বা বেঠিক বুঝি না! দরকার হলে চাকরি ছেড়ে দিব।”
জুই অবশ্য কোন কথাই শুনতে পেল না৷ এমনকি সে লিফটম্যানের বলা কথাগুলোও শুনে নি৷ অন্যদিকে ছিল সে। লাস্টবারের মতো সবকিছু রিচেইক দিচ্ছিল সে।
ইমান চলে যাওয়ার পর কনফারেন্স রুমে উপস্থিতি এক ক্লাইট বলে উঠে, “আই থিংক লিফটে কেউ আটকে গেছে। তোমার ওখানে যাওয়া দরকার। কারো জীবন ঝুঁকিতে আছে।”
জুই কথাটা শোনামাত্র প্রশ্ন করে, ” আর ইউ সিউর?”
–” লিফটম্যান তো তাই বললো৷”
— “ওহ নো! গড হেল্পস আস।”
সে খানিকক্ষণের জন্য কনফারেন্স বন্ধ রেখে হলরুমের বাইরে আসল৷ ততোক্ষণে মোটামুটি একটা শোরগোল পড়ে গেছে৷ দুইজন রেস্কিউ টীমের সদস্য পৌঁছে গেছে৷ ইমানকেও তাদের সঙ্গে দেখা গেল৷
জুই এগিয়ে এসে বলে, ” তোমার কাজিন কী আটকে গেছে লিফটে? ”
ইমান তখন দুশ্চিন্তায় ঘেমে-নেয়ে একাকার। সে মলিন মুখে বলে, “সম্ভবত। লিফট কোন ফ্লোরে আটকে গেছে বোঝা যাচ্ছে না৷”
একজন রেস্কিউ টীমের সদস্য বলে উঠে, ” নিচে গিয়ে লিফটের মেইন সুইচ অফ করে আসেন কেউ একজন।”
ইমান বলে উঠে, ” আমি যাচ্ছি।” বলে সিড়ির দিকে ছুটতে লাগলো। তার কোনদিকে হুশ নেই। এগারো তলা থেকে যতোদ্রুত নিচে নামবে ততো দ্রুত মিরাকে উদ্ধার করা যাবে। এছাড়া সে মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করছে যেন নিচের ফ্লোরে গিয়ে দেখে মিরা নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগারো মিনিট অপচয় করে নিচে নেমে যায়৷ কিন্তু তার তৃষাতুর চোখ মিরাকে দেখতে পায় না। সে নিচে কোথাও নেই৷ অগত্যা ইমান সিউর হয় মিরা লিফটেই বন্দী আছে। কেমন অবস্থায় আছে মেয়েটা? ভয় পাচ্ছে? কান্না করে দিয়েছে? অতিরিক্ত অন্ধকারে মাথা ঘুরে পরে যায়নি তো? শ্বাস নিতে পারছে তো? দমবন্ধ লাগছে কী? এতো এতো চিন্তায় তার পাগল দশা। শার্ট এমনভাবে ভিজে আছে যেন সে সদ্য কাকভেজা হয়েছে৷ হাপাচ্ছে সে। পিপাসায় গলা চৌচির। সে একটা দম ফেলে জেনারেটর কন্ট্রোল রুমে গেল৷ জেনারেটর কন্ট্রোল রুমে সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ইলেকট্রিক তারের সংযোগের একসেস রয়েছে৷ লিফটের সুইচ এখান থেকে অফ করে দিল সে। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ অন করল। বিশ মিনিট আগের এগারো তলার ফুটেজ অন করে৷ মিরার সঙ্গে তার আরেক কলিগ হেনরি বিনও লিফটে উঠেছে৷ এরপর দশ তলার ফুটেজ অন করে৷ সেখান থেকে এক সেকেন্ডের ব্যবধানে লিফট নয়তলায় গিয়ে থামে। হেনরি নেমে যায়। এরপর লিফটের গেইট বন্ধ হলো। এবং ঠিক ওই টাইমেই কারেন্ট গেল। দ্যাটস মিন, মিরা নয়তলা থেকে আটতলার মধ্যে আটকা পড়ে আছে৷ ইমানের বুকটা ছ্যাত করে উঠে৷ সে লিফটম্যানকে কল করে নয়তলায় আসতে বলে৷
লিফটের চাবী জেনারেটর কন্ট্রোল রুম থেকে খুঁজে যখন নয়তলায় সিড়ি বেয়ে উঠে তখন সম্ভবত মিরার লিফটে আটকে যাওয়ার আধঘন্টা পাড় হওয়ার উপক্রম৷ টেকনোলজির অবগতির ফলে চাবী ব্যবহার করে লিফট বা দরজা খোলা হয়না আজকাল।সবকিছু অটো সিস্টেমের আওতায় অন্তর্ভুক্ত। নয়তলায় লিফটের সামনে চাবি দিয়ে গুতাগুতি করে লিফটের দরজা খোলা হলো৷ কিন্তু লিফট নয়তলা এবং আটতলার মাঝামাঝিতে আটকে গেছে। রেস্কিউ টীম থেকে একজন চিৎকার দিয়ে বলে, ” ইউ দেয়ার?”
কোন শব্দ হলো না৷ ইমানের সেসময় প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। উনি আবারো মাইক হাতে নিয়ে বলে, “ইউ দেয়ার?”
ইমান মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছিল যেন মিরা আওয়াজ দেয়৷ অন্তত একবার হলেও। তাহলে কিছুটা স্বস্তি পাবে সে। অবশেষে, আল্লাহর অশেষ রহমতে ভাঙ্গা গলায় আওয়াজ ভেসে আসে, ” আই এম স্টাক। প্লিজ হেল্প।”
ইমান স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে৷ যাক অন্তত সেইভ আছে।এখন এক্সপার্ট রেস্কিউ টীম মেম্বাররা নিশ্চয়ই কোন উপায়ে মিরাকে বের করবেই৷ প্রথমেই তারা দঁড়িতে বেঁধে পানি আর টর্চ পাঠিয়ে দিল মিরার কাছে। মিরা সেগুলো দড়ি থেকে খুলে নিল৷ পরবর্তীতে টান দিয়ে দড়ি বের করে আনে। তাদের কাছে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও আছে। সব ব্যবস্থাই আছে৷ কিন্তু লিফটের বিরাট এক সমস্য হয়েছে। যেকোনো মুহুর্তে লিফট ছিঁড়ে পড়ে যেতে পারে৷ খুবই সর্তকতার সঙ্গে তারা কাজ করছে৷ শেষে সিদ্ধান্ত নিল সম্পূর্ণ লিফটটার তাঁর কেটে ফেলে উপরে টেনে আনবে।
মিনিট দুইয়ের মধ্যে লিফটের উপর বিপরীত এবং সমান পরিমাণ বল প্রয়োগ করে উপরে টেনে আনা হলো। মিরাকে লিফট থেকে উদ্ধার করে যেই না ফ্লোরে আনা হলো। সঙ্গে সঙ্গে লিফট ধসে নিচে পড়ে গেল। কী ভীষণ বিকট শব্দ। বুক কেঁপে উঠে ইমানের। তার হাত কাঁপছে৷ মিরার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। ফ্যাকাশে, ঘমার্ক্ত সে। চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে৷ ইমান গিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এবং সবার সামনে তার কপালে বেশকিছু ক্ষণ ধরে নিজের অধরজোড়া চেপে রেখে, মরা কণ্ঠে, খুব আস্তে করে বলে, ” তুমি ঠিক আছো?”
মিরা উত্তর না দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়৷ অনেক বড় একটা বিপদ থেকে সে বেঁচে ফিরে এসেছে৷জনম ভর সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে সে। আর এক সেকেন্ডও দেরি হলে লিফট ছিঁড়ে নিচে পড়ে যেত৷ মাটির সঙ্গে সংঘর্ষে তার দেহ পিষে যেত। ভাবতেই লোম খাড়া হয়ে আসছে তার।
ইমান তাকে বুকের মধ্যে আবদ্ধ করে বলে, “আজকে তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি পাগল হয়ে যেতাম।”
মিরা কথাটা শোনামাত্র তার দিকে মাথা উচিয়ে একবার তাকালো। চোখে চোখ রাখলো সে। টলমল চোখ থেকে মাত্র অশ্রু গালে গড়িয়ে যেতেই, তার টসটসে নোনাজল খানি ইমান মুছে দিয়ে বলে, “কান্না করো না প্লিজ। সব ঠিক আছে৷”
রেস্কিউ টীমের সদস্যরা এসে মিরার প্রাথমিক মেডিকেল চেক আপ করলো। ওর শুধু কপালে সামান্য কেটে গেছে। সেখানে ব্যান্ডেজ দিয়ে বলে উঠে, “উনি মানসিকভাবে একটু শকে থাকতে পারে৷ ভয় পেয়ে গেছে। ওনাকে কমফোর্ট জোনে নিয়ে যান। একটু সময় দেন ওনাকে৷”
মিরাকে নিয়ে ইমান সিড়ি দিয়েই নিচে নেমে আসে। দুইজনের মধ্যে কোন কথা হয়নি আর। তবে ইমান বেশ আতংকগ্রস্থ ছিল তা ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে৷ অস্থিরতা এখনো কাটেনি ওর। বারবার মিরার হাত ধরে কাছে টেনে নিচ্ছে তাকে।
একসময় মিরা বলে উঠে, ” আমি ঠিক আছি।”
–” ঠিক নাই তুমি। আমি বুঝতে পারছি।”
মিরা আর কিছু বলল না। ইমান তাকে নিয়ে সোজা বাসার উদ্দেশ্য রওনা হওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভিং সীটের পাশেই মিরার অবস্থান হলো৷ ইমান নিজ থেকে তার চুল সরিয়ে দিয়ে খোপা করে দিল৷ এসি বাড়িয়ে দিল। সীট বেল্ট পড়িয়ে দিয়ে আরেকবার কপালে চু*মু দিতেই মিরা বিরক্তিতে চ বর্ণ উচ্চারণ করে। ইমান সেই বিরক্তির ধার ধরলো না। তার এমন পাগলামোতে মিরা অবাক। হুট করে তার প্রতি এতো কেয়ার! শুধু মরে যাচ্ছিল বলেই এই আধিখ্যেতা! মানুষ ঠিকই বলে মরলেই কদর বাড়ে৷
ইমান প্রথমেই বাসায় গেল না। একটা আইসক্রিম পার্লারে এসে গাড়ি পার্ক করল। মিরা ভ্রু কুচকে উৎসাহের সঙ্গে তার দিকে তাকালো।
ইমান বলে, ” নিউইয়র্ক এসে তোমার এতো বাজে ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হবে আমি কল্পনাও করিনি।তুমি নিশ্চয়ই নিউইয়র্ককে খুব খারাপ একটা শহর ভাবছ। যেখানে পদে পদে বিপদ। আসলে তা নয়৷ আমার শহরটা খারাপ না। এই শহরটা খুব চমৎকার। আনন্দ দিয়ে ঘেরা এর প্রাচীর৷ মায়াভর এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ।”
–” আপনার শহরকে আমি খারাপ ভাবি নি একবারও।”
–” বেশ৷ চল নামি।”
মিরা আইসক্রিমের দোকানের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি আইসক্রিম খাব না।”
ইমান হতাশ হয়ে বলে, ” মিরা প্লিজ বি নরমাল। আগের মতো চঞ্চল হয়ে যাও। তোমার এমন শান্ত আচরণ সহ্য হয়। তুমি পাখির মতো চঞ্চল, তোমাকে পানির মতো শান্ত রুপে মানায় না৷ বিপদ তো হবেই, তাই না? সকল প্রতিকূলতা রোধ করেই বাঁচতে হবে।”
মিরার যেন কী হলো। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। এরপর হিচকি তুলে বলে, ” আমার সবকিছু অসহ্য লাগে। আপনার জন্য আমার সব সুখ কর্পূরের মতো নাই হয়ে গেছে৷ আপনি আমার জীবনে না আসলে খুব ভালো হত। আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অপরাধ।এই অবাধ্য ভালোবাসাটা গলার কাটার মতো লাগে। না পারি গিলতে, না পারি সইতে। ”
চলবে।