ফেইরিটেল পর্ব-৬০

0
3552

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Last Part (প্রথম অংশ)

আকাশের বুকে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে কৃষ্ণ-কালো মেঘের ভেলা। চারিদিকে মন খারাপ হওয়ার মতো বিষন্নতা। ইরা জানালার দিকে এগিয়ে এলো। আকাশ কালো হয়ে এসেছে৷ দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আকাশের পানে৷ তার খুব রাগ উঠছে। ড্রয়িংরুমে মামা-মামী বসে আছেন। তারা বাসায় এসেছেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে ভার্সিটি থেকে এসেই অবাক। মা কত সাবলীলভাবে কথা বলছেন ওনাদের সঙ্গে। ইরাকে দেখামাত্র বলল, ” চা বানিয়ে আনতে।”

ইরা অবশ্য চা বানিয়ে আনেনি। নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। ডাইনিং টেবিলে সাদ আর ইমাদ বসে বসে দাবা খেলছিল। সাদ ইশারায় তাকে কিছু বুঝালো কিন্তু ইরা বুঝতে সক্ষম হয়নি৷ তার রাগে গা কাঁপছে। ওই বিশ্রী দিনটার কথা স্মরণ হতেই তার গা গুলাচ্ছে। সে দম ফেললো ছোট করে। সাদ ইতিমধ্যেই তাকে দশ বার কল করেছে। ইরা ফোন রিসিভ করতেই বলে উঠে, ” ওনারা চলে গেছে। তুমি বাইরে আসো।”

ইরা ফোন কাটলো। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ঘটনার পর তার সাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় অনলাইনে। অবশ্য ইমান ভাইয়ার ছোট ভাই জেনেই সে কথোপকথন আগায়। নাহলে ঐ দুর্ঘটনা পর সে অপরিচিত কাউকেই বিশ্বাস করে না আর। ছয় বছরে সাদ তার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গেছে। তার জীবনে ঘটে যাওয়া খুটিনাটি সব শেয়ার করে ওর সাথে।

সে খট করে দরজা খুলে সরাসরি সুপ্তি বেগমের কাছে গেলেন৷ সুপ্তি বেগম তখন ইমাদের জন্য আলাদা করে ঝাল ছাড়া সবজি বানাচ্ছিলেন৷

ইরা মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” মামা-মামী কেন এসেছিল? আর তুমি ওনাদের কেন বাসায় এনে চা-পানি খাওয়ালে।”

সুপ্তি বেগম মুচকি হাসলেন এরপর জবাব দেয়” ওনারা সাহায্যের জন্য এসেছিল। বোন হইতো, থাকতে পারিনি।”

–” কিসের সাহায্যে চাই তাদের? লজ্জা করলো না ওনাদের আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে?”

সে আস্তে আস্তে বললো, ” অনিক তিন মাস ধরে জেলে আছে। ভাই নিজের সব জায়গা-জমি, টাকা দিয়ে জামিনের ব্যবস্থা করছে। লাভ হয়নি।কোন জানি মন্ত্রীর ভাগ্নির সঙ্গে অনিক ঝামেলা করেছে। বর্তমানে সে ভুগছে। এখন ভাইয়ের ঢাকায় থাকার আশ্রয় নাই। গ্রামের বাড়ি যাবে৷ তাদের খুব অভাব যাচ্ছে৷ কিছু আর্থিক সাহায্য চাইলো। আমি না করতে পারি নি।”

ইরা মাকে আর কিছু বলল না। শুধু হতবুদ্ধি হয়ে সবটা শুনলো। সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসতেই সাদ বলে, ” তোমার মামা খুব কাঁদছিলেন৷ আমার নিজেরই খারাপ লাগলো। আর মামি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছিল বারবার। ”

তখনি ধরনী কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামে৷ ইরা সাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ” নিউইয়র্কবাসী, চলুন আজকে আপনাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখাই।”

–” নিজেকে দেখাবা?”

ইরা হেসে বলে, ” ” চলো আজ বৃষ্টিতে ভিজি।”

সাদ অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। তারা দু’জন সুপ্তি বেগমের চোখে ফাঁকি দিয়ে ছাদে উঠে যায়৷ ইমাদকে ঘুষ স্বরুপ সাদ তার ফোনে গেইম অন করে দিয়ে গেছে। দিন-দুনিয়া ভুলে ইমাদ গেইম খেলায় ব্যস্ত।

একটু পর খাবার নিয়ে সুপ্তি বেগম আসলেন। ইমাদ মোবাইলে গেইম খেলতে খেলতে নানীর হাতে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়।

সুপ্তি বেগম প্রশ্ন করে, ” বাবু, তোমার মিমো কোথায়? তোমার চাচ্চুকেও দেখছি না যে?”

ইমাদ গম্ভীরমুখে স্ক্রীন থেকে চোখ না সরিয়ে বললো, ” জানি না নানিমনি।”

তারা চুপি চুপি ছাদে উঠে এসে ছাদের দরজা লাগিয়ে দেয়। আকাশ ভেঙে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। থেকে থেকে পূর্বদিক থেকে হীম শীতল বাতস আসছে। ইরা খোলা ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। দু’হাত মেলে আকাশের দিকে চোখ বুজে ভিজতে লাগে। সাদও বৃষ্টির তোড়ে ভিজে যাচ্ছে। তবে সে মুগ্ধ নয়নে খুব সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে চোখজুড়ে দেখছে। একটা সময় পর সে নিজের দৃষ্টি কেবল ইরার চোখ ও মুখের দিকে রাখল। বৃষ্টির পানিতে কাকভেজা ভিজে ;ওর জবজবে শরীরটার সঙ্গে সুতি সালোয়ার কামিজ লেপ্টে আছে।

ইরার বুঝি আজ মনে রঙ লেগেছে। সে হাত মেলে রেখেছে, ছাদে জমে যাওয়া পানিতে পা দিয়ে সামান্য লাফ দিচ্ছে আর গুনগুন করে বাংলা বা হিন্দি গানের এক-দুই লাইন গাইছে৷

সাদ তার সামনে এসে আলতো করে তার হাত ধরে বলে, “পানির তৃষ্ণা পেলে মানুষ পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করে৷ কিন্তু তুমি আমার মনের এমন এক তৃষ্ণা যেটা মেটানো যাচ্ছে না৷ আমার চোখের এমন এক পিপাসা তুমি যা থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। বরং মন বা চোখ জুড়ে যতোই তোমায় দেখি ততোই তৃষ্ণা বাড়ে। এই তৃষ্ণায় চৌচির আমার মন। চোখ পিপাসায় কাতর।”

তার দুই গালে নিজের ভেজা হাতের পরশ দেয় সে। ইরা শিউরে ওঠে তার স্পর্শ পেয়ে৷

সাদ তার গালে স্লাইড করতে করতে বলে, ” তুমি কিন্তু একবারও আমাকে ভালোবাসো তা বলো নি। প্লিজ একবার বলে দাও তুমিও আমার মতো করেই আমায় ভালবাসো! একটা বার কষ্ট করে বলে দিলেই চলবে।”

ইরা ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে, ” যদি না বলি?”

–” তাহলে আমি গুলিস্তানে গিয়ে গামছা বেচা শুরু করে দিব।”

ইরা শব্দ করে হেসে উঠল এরপর দুষ্টুমি করে বলে, ” ওকে দ্যাটস সাউন্ডস গ্রেট। তাহলে তোমার দোকান থেকে আমার জামাইয়ের জন্য গামছা কিনব। ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট চাই।”

সাদ যেন সামান্য ক্ষুব্ধ হলো। সে ইরার কোমড় চেপে ধরে তাকে নিজের বুকে মিশিয়ে নিয়ে বলে, ” যদি সম্ভব হত, তবে তোমাকে নিজের বুকের মধ্যে বন্দিনী রাজকন্যা বানিয়ে রাখব আর তুমি অন্য পুরুষের কথা বলো! নট ফেয়ার এট ওল৷”

ইরার তখন কী যে ভালো লাগলো তা বোঝানো অসম্ভব। ” ভালোবাসা” এতো মধূর কেন? সে সাদের চোখে তার জন্য সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে। তাকে হারানোর ভয়ও ছেলেটার মধ্যে কাজ করছে। ইরার বলতে মন চাইল, ” আমাকে হারানোর ভয় পেতে হবে না। আমি তোমার মায়ায় আটকা পড়েছি। ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। হয়তোবা আরোও আগেই ভালোবেসেছি কিন্তু বুঝতে পারিনি। তাইতো নিজের এক্স বয়ফ্রেন্ডদের মধ্যে তোমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে বেড়াতাম।”

সাদ নিজের পুরুষালি বুকে ইরাকে ঠায় দিল। প্রবল বেগে ঝমঝম শব্দ তুলে বৃষ্টি পড়ছে। সে গান গেতে লাগলো,

” তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না”

ইরা তার বুকের উষ্ণতা অনুভবে মগ্ন ছিল তখন।

★★★

পিটার সাহেব নাস্তা না করে টেবিলে চুপচাপ বসে আছে। জুই অনেকবার তাকে অনুরোধ করছে নাস্তা খাওয়ার জন্য। কিন্তু তার এক কথা, জুইকে আজ ফাইনাল সিদ্ধান্ত দিতে হবে। নাহলে পিটার খাওয়া বন্ধ রাখবে৷

জুই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ” আমি এখনো কিছু ভাবি নি পাপা।”

পিটার বলে উঠে, ” রবার্ট ছেলেটা ছয় বছর ধরে তোমার হ্যাঁ শোনার অপেক্ষায় আছে আর তুমি ওকে নিয়ে ভাবার জন্য এক মিনিট সময় পাও না?”

জুই কাচুমাচু করে বলে, ” দেখি, ওনার সঙ্গে আজ কথা বলব।”

–“রবার্ট পার্ক এভিনিউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তুমি যাও৷ কথা বলো ওর সাথে এক্ষুনি। ”

জুই বুঝল পাপা আর রবার্ট প্লান করেই কাজ করছে। পিতার আদেশ রক্ষার্থে সে পার্ক এভিনিউয়ের দিকে রওনা দেয়৷ পরনে তার বেবি পিংক রঙের শার্ট। কাঁধ অব্দি ব্রাউন চুলগুলো সে ছেড়ে রাখল।

পার্ক এভিনিউ মূলত কোন ঘুরার জায়গা নয়৷ এটা মূলত রাস্তা। গাড়ি যাওয়া-আসা করছে সুশৃঙ্খলভাবে। ফুটপাত আছে। রাস্তাকে ঘিরে গড়ে উঠে বিশাল বড় বিল্ডিং। পার্ক এভিনিউয়ের কাছে অবস্থিত চার্চটা রবার্টের প্রিয় জায়গা। এই চার্জকে ঘিরে তার শৈশবের কিছু আনন্দময় মুহূর্ত আছে। সে নিউইয়র্ক এলেই এদিকে ঘুরে যায়। আজকে অবশ্য জুইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। মিষ্টার পিটার ফোন করে জানিয়েছে জুই আসছে তার সঙ্গে মিট করার জন্য। তখন থেকে তার মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে৷

রবার্ট দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় জুইকে গাড়ি থেকে নামতে দেখা গেল৷ ওকে দেখা মাত্র সে হাত নেড়ে হাই জানালো। জুই হাই ব্যাক করে তার দিকে এসে বলে, ” কেমন আছেন?”

–” খুব একটা ভালো নেই।”

জুই হেসে উঠে বলে, ” আপনাকে বিসনেজম্যান ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি তো দেখছি রোমিওকেও ফেল মারলেন।”

–” মজা নিবে না প্লিজ।”

–” চলুন সামনে আগাই।”

–” কোথায় যাবে? কোন রেস্টুরেন্টে বসবে? নাকি সেন্ট্রাল পার্ক যাবে? ”

–” কোথাও যেতে মন চাইছে না। তারচেয়ে আশেপাশেই হাটাহাটি করি।”

–” এজ ইউর উইশ।”

রবার্ট আর জুই রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর রবার্ট বলে উঠে, ” একটা সময় আমি লাভ-ক্ষতি ছাড়া কিছু বুঝতাম না। জীবনটাকেই ব্যবসা ভাবতাম। পাকা ব্যবসায়ী যাকে বলে সম্ভবত আমি তাই ছিলাম। একদা তোমার বাবার কোম্পানির সঙ্গে প্রজেক্ট করার প্রস্তাব পাই। আমি গেলাম তোমাদের অফিসে। মিটিং রুমে বসলাম। সেদিন প্রথম দেখলাম তোমায়। সাদা শার্ট পরেছিলে। ভীষণ নার্ভাস ছিলে তুমি। কারন ওটা তোমার প্রথম প্রেজেন্টেশন ছিল। তুমি মনোযোগ দিয়ে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করলে আর আমি মনোযোগ দিয়ে তোমায় দেখলাম। কাজের কোন কথাই কানে গেল না৷ প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার আগেই ডিল সাইন করি। আমার এসিস্ট্যান্ট প্রশ্ন করে, ” এতো ফালতু প্রেজেন্টেশন দেওয়ার পরও আমি কেন তোমাদের সঙ্গে কাজ করব!” আমি উত্তর দিইনি। তোমাদের সঙ্গে প্রজেক্ট করে আমার বিরাট অংকের লস হলো তাও পরবর্তীতে লসের কথা ভুলে কেবল তোমার জন্য আবারও অফিশিয়ালি জড়িত হই।শুধু মাত্র তোমাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাব জন্য! ”

জুই সব শুনে বলল, ” আমি খুব খারাপ একটা মেয়ে। তুমি জানো আমি মিষ্টার খানকে খুব ভালোবাসতাম। সে বিবাহিত জেনে আমি মেনে নিতে পারিনি। তাকে নিজের করার জন্য মরিয়া হয়ে জঘন্য একটা কাজ করে ফেলি। ওনাকে মিথ্যা পুলিশি মামলায় ফাসিয়ে তার সামনে দুইটা কন্ডিশন রাখি– হয় আমাকে বিয়ে করতে হবে নয়তো জেলে যেতে হবে৷ ইমান নিজ ইচ্ছায় জেলে যেতে রাজী হয়৷ তখন রিয়ালাইজ করি ইমান কখনই আমার হবে না। সে অন্যকারো ভালোবাসা। আমি এরপর সবকিছু থেকে সরে আসি। মিথ্যা মামলা তুলে তাকে মুক্তি দেই। আমি সেদিন থেকে অনুতাপের আগুনে পুড়ছি। লজ্জায় ওর সামনে যেতে পারি না৷”

রবার্ট ওর হাত ধরে বলে, ” নিয়তি ইচ্ছা করেই আমাদের দ্বারা ভুল করায়৷ পরীক্ষা করায় আমাদের। দেখতে চায় আমরা পরবর্তীতে অনুতপ্ত হই কিনা, ক্ষমা চাই কিনা। জুই, তুমি জানো বেশিরভাগ মানুষই ক্ষমা চায় না। খুব কম মানুষ অনুতপ্ত হয়। তুমি যেমন আমি সেভাবেই তোমাকে ভালোবাসি।তোমাকে এবং তোমার সব ভুলকে মেনে নিয়েই তোমার সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাই।”

জুই রবার্টের দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপর বলে, ” আমি পাপার আসল মেয়ে না। আমার মা খুব জঘন্য একজন মহিলা ছিল। এরপরও আমাকে মেনে নিবে?”

রবার্ট কিছুক্ষণ চুপ রইল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, ” জন্মের উপর আমাদের কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। বলেছি না একবার? তুমি যেমন আছো সেভাবেই তোমায় গ্রহণ করব।”

জুই তাকে খুব সুন্দর একটা হাসি উপহার দিল৷ বিনিময়ে রবার্টও হাসল৷ জুই খেয়াল করল, রবার্টকে হাসলে খুব হ্যান্ডসাম লাগে৷ আজকের ব্লু শার্টেও তাকে হ্যান্ডসাম লাগছে।

নিউইয়র্কের পার্ক এভিনিউয়ের মতো বিজি সড়কেও দুইজন মানুষের হৃদয় জুড়ে গেল আজ৷

সে বাসায় এসে পিটারকে তার সিদ্ধান্ত জানালো। পিটার খুশিতে ইউরেকা বলে নাচলো কিছুক্ষণ। অতঃপর খুব সাধারণ ভাবে কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও ফ্রেন্ডকে ইনভাইটেশন দিয়ে বিকেলেই চার্চে রবার্ট আর জুইয়ের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। জুই বিয়ের সময় পিটারের স্ত্রীর হুয়াইট ব্রাইডাল গাউনটা পরেছিল। চুলে একটা ফ্লাওয়ার ক্রাউন আর মাথায় সাদা নেটের ঘোমটা লাগিয়েছিল। হাতে ছিল অর্কিডের তোড়া। রবার্ট সাদা শার্ট আর ব্লাক স্যুট পরলো৷ স্যুটের পকেটে রেড রোজ ছিল। বিয়ের পর যখন রবার্ট তাকে কি*স করে তার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। সারাজীবন নিজেকে আমেরিকান ভাবলেও সেসময় তার মনে হলো সে আসলে আমেরিকান নয়। তার রক্তে বাংলা আছে। নাহলে কি’সিং টা’ই’মে সে লজ্জা পেত না৷ স্বাভাবিক একটা ট্রেডিশন হিসেবে নিত৷

____________________________

চট্টগ্রামের আউটলেট ওপেনিংয়ের দিন সকাল থেকে কোলাহলপূর্ণ ছিল। ভাইরাল ছবির জন্য দারুণ মার্কেট পায়। প্রচুর কাস্টমার ভীড় করে নতুন আউটলেট ভিজিটিং করার জন্য। কাস্টমারদের জন্য উপহারের ব্যবস্থাও ছিল৷ কিন্তু বেশিরভাগ কাস্টমার ভাইরাল হওয়া পিকচার দেখে হুজুগে এসেছে। দিনটা খুব ভালো কাটলো। সাকসেস পার্টির আয়োজন করা হলো। ন্যান্সি ম্যাডাম খুব খুশি৷ তাদের টিম যেই হোটেলে উঠেছে সেখানেই পার্টি ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। মিরা খুব সুন্দর একটা কালো রঙের শাড়ি পরে ইমাদকে কল দিল। রাগের কথা ইমাদ ততোক্ষণে ভুলে গেছে। ইমাদ জানালো সে বাইশ তারিখ সৃজার জন্মদিনে যাবে। তাকে যেন যেতে দেয় মা। মিরার খেয়াল হলো কাল রাতে সৃজার আম্মু কল করেছিল। কি গিফট নিবে সেটা নিয়ে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করল ইমাদ৷

মিরা পার্টির হলে আসলো৷ ইমান তখন একজন এমপ্লয়ির সঙ্গে গল্প করছে। তাদের দু’জনের মধ্যে চোখাচোখি হলো। আজ মিরা চোখ সরিয়ে নিল না। সে চোখে চোখ রেখে হাসল৷ ইমান নিজের বুকের দিকে আংগুল দিয়ে ইশারা করে। এর অর্থ তার হাসি সোজা ওর বুকে গিয়ে লেগেছে৷ মিরা খিলখিল করে হাসলো তার কাণ্ড দেখে৷

মিরা তার দিকে এগিয়ে আসলেই ইমান বলে উঠে,
“She walks in beauty, like the night
Of cloudless climes and starry skies;
And all that’s best of dark and bright
Meet in her aspect and her eyes;”

~ Lord Byron~

মৃদ্যু রোমান্টিক মিউজিকে ইমানের বলা জনপ্রিয় কবিতাটা শুনে মিরার মনে হচ্ছে এই কবিতাটা কেবল তাকে উৎসর্গ করে লেখা। ইমান তার সঙ্গে ডান্স করার জন্য প্রোপোজাল দেয়। সে না করল না। একটা চমৎকার মিষ্টি প্রেমময় টিউন বাজছে। দু’জনের মনেই প্রেমের প্রদীপ দাউদাউ করে জ্বলছে৷ আলো-আঁধারির এক অদ্ভুত মিশ্রণে দুজনে কাছাকাছি এসে হাতে হাত রাখে। চোখে চোখ রাখে। আজ মিরার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে বড় ভালো লাগছে। ইমানের বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল চোখ দুটি চোখের ভাষা দিয়ে তাকে অনেক কিছু বলতে চাইছে৷ মিরা সেই চোখের ভাষায় লেখা উপন্যাসটা পড়ার চেষ্টা করছে৷ অবশেষে কিছুক্ষণের মধ্যে সে সবটা পড়ে ফেলে!

সাকসেস পার্টি শেষ হলে মিরা আর ইমান বীচে গেল। বীচ পুরা সুনশান। হোটেলের আলোয় অন্ধকার কিছুটা লোপ পেয়েছে। তবে আজ জোৎস্না রাত। চাঁদের আলো সমুদ্রের ঢেউয়ে উপচে পরছে৷ পানিতে চাঁদের প্রতিফলন এবং বহুদূর থেকে ঢেউ এসে তাদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। শোশো বাতাসের মাঝে তারা হাঁটছে। মিরার চুলগুলো যখন এলোমেলো করে উড়ছে সে বিরক্ত হয়ে চুলে হাত খোপা করতে চাইলে, ইমান বাঁধ সাধে বলে, ” কন্যা রে কন্যা তোর বাকা চুলেতে আর খোপা বাইধো না।”

মিরা আরেকবার খিলখিল করে হাসলো। আজ বহুদিন বাদে সে খুশি। মন খুলে হাসছে। সামনে থাকা মানুষটাকে তার বিশ্বাস করার জন্য মন নিজ থেকে সায় দিচ্ছে। ভরসা করতে মন চাইছে। শুধু তাই না, আরেকবার কোন কারণ ছাড়াই ভালোবাসতে মন চাইছে। ওর প্রতি রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা বা অভিমান সব আজ সমুদ্রের ঢেউয়ে চোখের দৃষ্টিসীমার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, সমুদ্রের ঢেউতে, সাগরের বুক থেকে ভেসে আসা কোন শামুকের খোলস থেকে দামী মুক্তার মতো ভালোবাসা বেরিয়ে আনতে মন চাইছে তার!

ইমান হুট করে তার ডান হাত ধরল। এরপর অন্যহাতে মাথা চুলকে আগাতে লাগে। মিরা মৃদ্যু হেসে তার সঙ্গে পথ চলা শুরু করে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। ও হাত ধরলেই বুকে টান লাগে। প্রচণ্ড ভালোলাগা বুকে এসে ভর করে৷ মিরা তার অন্যহাত দিয়ে মুখ থেকে এলোমেলো চুল সরিয়ে নিয়ে বলে, ” ইমাদের আব্বু শুনছেন?”

ইমান বলে, “কী?”

মিরা খুব আদূরে কণ্ঠে বলে, ” I need You like a sky needs a moon! ”

সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ তোলার শব্দে, বিশাল শূণ্য আকাশে, বৃত্তাকার জোছনা ঝড়ানো চাঁদের নিচে এমন বাক্য শুনে হতভম্ব হয়ে পরে ইমান। সে যেন নিজের কানে ভুল শুনল৷ এই বাক্যটা তাদের দু’জনের ভালোবাসা প্রকাশের অঘোষিত ট্যাগ লাইন। তারা কেউই “আই লাভ ইউ” বলাটা তেমন পছন্দ করে না। তার মানে……. মিরা আরেকটাবার তাকে ভালোবাসলো? আবারো তাকে নিজের করে নিতে আমন্ত্রণ জানালো? ইমানের চোখ ভিজে উঠে। আজ এতো শান্তি লাগছে কেন? কেন সমুদ্রের সৌন্দর্য হুহু করে একশ গুণ বেশি সুন্দর হয়ে গেল? কেন সে রাত্রিবেলাও ঝলমলে রংধনু দেখতে পারছে?

মিরা তার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। সে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থেকে এক প্রকার পাগলের ন্যায় মিরাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। দুইজনই চুপ। আজ শুধু অনুভূতি বুঝে নেওয়ার দিন। এদিনে কেউ বলে না। শুধু একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে, হাত হাত রেখে, নিজের ভাগের ভালোবাসাটুকু অনুধাবন করে। বুক পেতে মনের ভেতরকার সব কথা শুনে নিতে হয়।

মিরারা যখন ঢাকা পৌঁছে তখন সকাল সাতটা। সেদিন সকালে আর তারা অফিস গেল না। ছুটি নিল রেস্ট নেওয়ার জন্য। বাসায় এসে ইমাদের সঙ্গে দেখা হলো না। সে স্কুলে চলে গেছে ততোক্ষণে। তবে ইমাদ স্কুল থেকে ফিরে বাবা-মাকে দেখে খুব খুশি হলো৷ বাবার কাছে নিজের আবদারের ঝুলি নিয়ে খুললো৷ ড্রয়িংরুমে সে মায়ের হাতে ভাত খাচ্ছিল আর বাবার সঙ্গে গল্প করছিলো৷ ইমাদ খেতে খেতে বললো,” বাবা আমার একটা কিউট ছোটবোন চাই। সৃজার ছোট বোন আছে৷ আমার নাই কেন? তুমি আমাকে একটা ছোটবোন এনে দাও না প্লিজ৷”

ছেলের আদুরে আবদারে ইমানের মন আনন্দে মেতে উঠে। সে দুষ্টু হেসে মিরার দিকে তাকালো। মিরা রাগতে চেয়েও না রেগে বলে, ” বাবু, খাওয়ার সময় এতো কথা বলতে হয় না।”

ইমান অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ তুলল। সে বলে উঠে, ” ছেলের সব আবদার তো বাবাকেই পূরণ করে দিতে হবে৷”

মিরা কটমট করে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে আস্তে করে বলে, ” এক বাবুর বাপ হয়ে সাধ মিটে নি?”

–” উহু মিটে নি, এবার রাজকন্যার পিতা হতে চাই।”

বিকেলের দিকে ইমাদ বায়না ধরল সে সৃজার জন্য গিফট কিনতে যাবে সঙ্গে নিজের জন্য শার্ট কিনবে নিউ৷ ইমান ছেলের কথা শুনে রুমে এসে মিরাকে জিজ্ঞাসা করল, ” সৃজা কী ইমাদের গার্লফ্রেন্ড হয়?”

মিরা তার প্রশ্ন শুনে রেগে উঠে বলে, ” আপনি কী পাগল নাকী ছাপল?”

ইমান কাচুমাচু করে বলে, ” যেমন কেনাকাটা করার আবদার করছে মনে হচ্ছে ছেলে আমার শ্বশুড়বাড়ি যাবে৷”

বিকেলে ইমাদকে নিয়ে শপিং করে আনা হলো। রাতে সকলে একসঙ্গে খাওয়ার সময় ইমান জানল, তার বাবা-মা দেশে আসছে। শুধু তাই না, হাসনাহেনা ইরার বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ইরা লজ্জায় হ্যাঁ বা না বলছে না। ওর চোখ-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুশি৷

ইমান বলে উঠে, ” জামাই-বউ রাজী থাকলে আমাদের কী কিছু করার আছে? ”

সুপ্তি বেগম বলে, ” না, কিছু করার নেই।”

সাদ জোরে বলে উঠে, ” আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

সবাই হাসাহাসি শুরু করল৷ পরেরদিন মিরা অফিস গেল না। ইমান একা বেরিয়ে যায়। দুপুরের দিকে, ইমাদ নতুন শার্ট পরে মায়ের কাছে এসে বলল, ” আম্মু, বাবার পারফিউম আমার গায়ে মেখে দাও তো।”

মিরা বলে, ” কেন? ”

–” তাহলে আমিও বাবার মতো হ্যান্ডসাম হয়ে যাব।”

মিরা হেসে ছেলেকে চুমু খেল৷ ড্রাইভার তাকে নিয়ে গেল। এ যাবত যা যা ঘটছিল সবকিছু রুপকথা মতো সুন্দর ছিল৷ কিন্তু জীবন কখনো রুপকথা নয়। জীবন বারবার আমাদের ভয়ংকর সব পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করাবে৷ চোরাবালিতে চুবিয়ে মারবে৷

দুপুর তিনটায় সৃজার মায়ের কল এলো মিরার ফোনে। সে কল রিসিভ করতেই উনি বলে উঠে, ” ভাবী ইমাদ হুট করে খুব অসুস্থ হয়ে পরলো। ওকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে৷ আপনি আসেন৷”

মিরা চোখে আঁধার দেখা শুরু করল। এখন দিন নাকি রাত সে ভুলে গেল৷ ছুটে গেল ছেলের কাছে৷ হাসপাতালে যাওয়া তার জন্য মোটেও সুখকর অনুভূতি ছিল না। বরং ওখানে তার জন্য বিরাট বড় এক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল। যেই দুঃসংবাদ তার জীবনের সময়কে থমকে দিল৷

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here