ফেইরিটেল পর্ব-৩৩

0
1387

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–33

রাস্তার ধারেই গাড়ি পার্ক করা আছে। বিশাল বড় ভবনের পাশে৷ ইমান শপিংমলের পেছন সাইডে আইসক্রিম শপের সামনে গাড়ি থামিয়েছে৷ সে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। এরপর ড্রাইভিং সীটের পাশের সীটটার দরজা খুলে দিয়ে বলে, “আসো।”

মিরা চোখ-মুখে তখনো রক্তিম আভা ফুটে আছে৷ চোখে নোনাপানি টলমল করছে। অথচ ইমান নির্বিকার। তাকে জোর করে হলেও আইসক্রিম খাওয়াবে৷ কি আশ্চর্য! এতোবড় একটা বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছে৷ এই মূহুর্তে কে এমন শপে এসে উৎসবের আমেজ নিবে? ছেলেটা দিন দিন গাধা হয়ে যাচ্ছে৷

এবারে ইমান দরজার ভেতর দিয়ে নিজের শরীর এগিয়ে এনে নিজ গরজে সীটবেল্ট খুলে তাকে টেনে বের করে।

মিরার সামনে আবারো দৃশ্যমান হলো আইসক্রিম শপটা।শপটা না একচুয়ালি! বিরাট বড় স্ক্রিনে বেশ ডিজাইন করে বড় করে, উজ্জ্বল করে লেখা, “Carvel” এই শপের নাম আগে কোনদিন শুনেনি মিরা। তবে ভেতরে না ঢুকেই অনুমান করা যাচ্ছে এটা খুব বিখ্যাত কোন দোকান। কাঁচের দেয়ালে “ওপেন” লেখা। অর্থাৎ শপ এখন খোলা আছে।

ইমান আবারো তার হাত ধরে এরপর আস্তে করে আগাতে থাকে। হাতে টান লাগায় সে আরেকবার পেছনে ফিরে৷ মিরা তখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে৷ ইমান ভ্রুকটি করে তাকায় এরপর নিজে দু’কদম ফিরে এসে বলে, “তোমার উপর কিছু চাপাতে চাই না আমি। এই সংসার, আমাদের বিয়ে, মিথ্যা ভালোবাসা সব ভুলে যাও আজকের জন্য। ইনফ্যাক্ট শুধু আজকের জন্য না। যতোদিন তুমি ট্রমা থেকে বের হচ্ছো না ততোদিন আমাকে প্রতারক স্বামী হিসেবে না দেখে, বরং ট্যুর গাইড হিসেবে দেখতে পারো। ইনজয় ইউর ডেস ইন নিউইয়র্ক। শাহরুখ খানের একটা ডায়লগ আছে, ” কাল হো না হো” আগামীকাল আমাদের জীবনে আসবে কীনা কে জানে। ইটস আনসারটেন।”

মিরা তার পানে তাকালো। ইমান খুব সুন্দর করে হাসল। সে হাসলে তার করাত দাঁতটা ঝিলিক মেরে উঠে। ভালো লাগে দেখতে। ব্লু শার্টটা গায়ে মানিয়েছে বেশ৷

মিরা বলে, ” আমরা এখন কোথায়?”

–” মানহাতানে। আর আপাতত ম্যাচি’স হেরাল্ড স্কয়ারের সামনে। ওইপাশে মেইন গেইট। আমি পেছন দিক দিয়ে এসেছি জন্য বুঝতে পারছো না৷ এইটা নিউইয়র্কের অন্যতম বৃহম মল। ভেতরে ঢুকলেই বুঝতে পারবে৷ ”

মিরা আশপাশে তাকালো। বিদেশের রাস্তাগুলোও ভারী সুন্দর। এ জায়গায় ভালোই ভীড়। এখন মনে হচ্ছে এদেশে মানুষ বাস করে!

ইমান তাকে নিয়ে বৃত্তাকার পথে ঘুরে একদম এন্ট্রি পয়েন্টে আসলো। গেটের সামনেই একটু উপরে লেখা, “The World’s largest Store.” একটা স্টার চিহ্নের লোগোও সেটে দেওয়া আছে পোস্টারের ওইদিকে। থ্রি ডাইমেনশনে।

মিরা সামান্য বিষ্মিত হয়ে তাকালো। আসলেই কী এটা সবচেয়ে বড় স্টোর? বিশ্বাস হচ্ছে না।এরচেয়ে তো আমাদের গাউছিয়া-নিউমার্কেটে ভীড় বেশি থাকে!

ইমান তাকে নিয়ে মলের ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে যেতেই মিরার চোখ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। এতো বিশাল হবে এটা বাইরে থেকে সে কল্পনা করেনি৷অতিরিক্ত আলোয় সবকিছু ঝলমল করছে। চোখ ধাধা খেয়ে যাচ্ছে।

ইমান তাকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে সাততলায় উঠে। সিড়ি দিয়ে উঠার সময় মলটার এক অংশ তার চক্ষু দিয়ে দেখা হলো। তারা সপ্তম ফ্লোরে অবস্থিত কার্ভেলে ঢুকলো। মিরার একটা জিনিস ভালো লাগলো যে ইমান লিফট দিয়ে উঠেনি। সত্যি বলতে মিরা আর জীবনেও লিফটে উঠবে না৷

কার্ভেলে ঢোকামাত্র এসির হীম বাতাসে ঠাণ্ডা অনুভুতি হলো। এখানকার সবখানে এসির টেম্পারেচার অনেক কমানো থাকে কীনা কে জানে! আশ্চর্যজনক ভাবে শপটা সাততলায়। মিরা ভেবে পেল না সে গাড়ির ভেতর থেকে সাততলায় অবস্থিত এই দোকান কীভাবে দেখলো? অবশ্য সর্বপ্রথম এ দোকানের পোস্টার সে গাড়ির মিররের রিফ্লেক্ট দেখে অনুমান করেছিল ইমান তাকে আইসক্রিম খাওয়াতে এনেছে৷

তারা প্রবেশ করতেই একজন ওয়েটার হাসিমুখে এসে তাদের অভ্যথর্না জানায়। ইমান হেসে বলে, ” আমাদের কর্ণারের একটা টেবিল দিন।”

সে হতভম্ব হলো ইমানের কথায়৷ ওর বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই? অসভ্যতা এখনো কমেনি? কীভাবে ওয়েটারকে ডেকে বলে কর্ণারের টেবিল চাই। বেশরম ছেলে! একটু আগেই বলল,তাকে স্বামী হিসেবে ভাবতে না৷ অথচ কর্ম তো লুচ্চা বয়ফ্রেন্ড থেকেও অধমে!

মিরা কটমট করে বলে, ” আমি কর্ণারের টেবিলে বসব না। একদম মাঝে বসব৷ আর আপনি মোটেও আমাকে স্পর্শ করবেন না। এই অধিকার বিয়ের রাতেই হারিয়ে ফেলেছেন।”

ইমান বিষ্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকালো। পুরা ব্যাপারটা ধাতস্থ করতে সে সময় নিল। এরপর হেসে বলে, ” বেশ৷ মাঝের ওই ফুলদানীর পাশের টেবিলে গিয়ে বসি৷ আসো।”

ইমানের শান্ত স্বভাবটা ভালো লাগছে। আগের সেই রগচটা অভ্যাসগত আচরণ আপাতত এই মূহুর্তে আর করছে না। বরং শান্ত, নরম সুরে কথা বলছে সবসময়। গলার স্বরে বিন্দুমাত্র শ্লেষ নেই৷ তারা চেয়ারে বসতেই ইমান ইচ্ছা করে তাকে খচা মেরে বলে, ” তুমি কী ভেবেছিলে আমি তোমাকে নিয়ে কর্ণারের টেবিলে বসে ওইসব আজেবাজে কিছু করব?”

মিরা একবার চোখ পাকিয়ে তাকালো। ইমান মেন্যু কার্ডে চোখ বুলাতে বুলাতে হেসে দিয়ে বলে, “তুমি এখনো ম্যাচুউর হওনি৷ বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছি।”

কথাটা শেষ হওয়ার পর তারা দুইজনই দুজনের দিকে তাকালো। বেশ বিব্রতকর অবস্থা। তাদেরকে উদ্ধার করতে ওয়েটার আসল অর্ডার নিতে৷ ইমান নিজের সব মনোযোগ অর্ডার দেওয়ায় ঢেলে দিল৷ ওয়েটার যাওয়ার পর ইমান বলে উঠে, ” তুমি জুইকে সত্যটা বলোনি কেন?”

মিরা ঠাওর করতে পারলো না কাকে সে কোন সত্য বলেনি? ক্ষণেই মনে পড়ে গেল, জুইয়ের কথা৷ নতুন পরিচয় হওয়া জুই জানতে চেয়েছিল সে ইমানের কে হয়? যদিও বা প্রশ্নটা ইমানকে করা হয়েছিল কিন্তু জবাব সে দিয়েছিল।

মিরা বলে, “আমি কাউকেই কিছু বলিনি।”

— “সেটা তো দেখতেই পারছি৷ কিন্তু কেন? তুমি চাইলেই আমার বাসায় সব সত্য বলে দিতে পারতে।”

— “যে কথাটা আপনি বলেননি সে কথাটা আমার মুখ থেকে বলা শোভা দেয়না। আমি নিজ থেকে আপনার পরিবারের কাউকেই সত্যটা কোনদিন বলব না৷ ”

–” তুমি কী আমার উপর অভিমান করে আছো?”

— ” আপনার উপর অভিমান করার অধিকার আমি নিজেকে দিইনি।”

— বাব্বা। আজকাল দেখছি তুমি অধিকার নিয়ে অনেক সোচ্চার।”

মিরা অন্যদিকে তাকালো। রেস্টুরেন্টে আরো অনেকেই আছে। চারটা টেবিল বুকড। একটা টেবিলে কাপল বসেছে৷ তারা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে চু*মু খেল। তা দেখে মিরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে তব্দা খেল। ইমানের বেশ হাসি পেল৷

ওয়েটার আইসক্রিম নিয়ে আসলো। ইমান সবার আগে নিজে খাওয়া শুরু করল। যদিও সে আইসক্রিম-চকলেট খায়নি৷ কিন্তু মিরার নাকি সবচেয়ে প্রিয় আইসক্রিম এইজন্য এখানে আসা৷ এখানকার আইসক্রিম বেস্ট। অবশ্য এই বেস্ট রেটিং সে দেয়নি। জুইয়ের রিকমেন্ডেশন এটা৷ মিরা তাকে দেখে চামচে করে আইসক্রিম মুখে দিল। তার কাছে বেশ মজা লাগলো। বাটার স্কচের সঙ্গে চকলেটের একটা ফ্লেভার পাচ্ছে সে।

ইমান বলে, “কালকে সোনালী আপুর সঙ্গে কথা হয়েছে৷”

মিরা চোখ তুলে তাকালো৷ ইমান বলে উঠে, “তুমি জানো বাসায় সবাই তোমার জন্য কত দুশ্চিন্তা করছিল? এভাবে না বলে আসাটা কিন্তু বাচ্চামো।

–” সোনালী আপু আপনাকে সব বলে দিয়েছে?”

–” মোটামুটি ভাবে সব জানি। আসলে আমি তোমাদের সম্পর্কে কিছু জানতাম না। যোগাযোগ ছিল না বিধায় তোমরা যে আলাদা থাকছো এটা জানি না৷”

–” মা রাগ করে মামা বাসায় শিফট হয়েছে আমাদের নিয়ে।”

–” ভালো করেছে। আগেই এমনটা করা উচিত ছিল।”

মিরার মুখটা ভার হয়ে আসল। তা দেখে ইমান চুপ মেরে যায়। আজকে এইসব কথা উঠানো ঠিক হবে না৷ মেয়েটার সঙ্গে পরে ধীরে-সুস্থে কথা বলতে হবে।

আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে ইমান বলে, “আমাদের লাঞ্চ করা উচিত ছিল৷ এসময় কে আইসক্রিম খায়।”

মিরা বলে, ” আপনার আম্মু আমার জন্য আজকে স্পেশাল ডিশ করবে দুপুরে৷”

ইমানের মুখ কঠিন হয়ে আসে৷ সে নিজেকে সামলিয়ে বলে, “আমার মা বহু আগেই গত হয়েছে। তুমি কার কথা বলছো?”

মিরা সামান্য চমকে উঠে বলে, “আপনার স্টেপ মাদার আরকি।”

–” নিজের মা আর স্টেপ মায়ের মধ্যে তফাত আছে৷ হুট করে আপনার মা বলাটা বিভ্রান্ত সৃষ্টি করে৷ ”

–” কিন্তু…….. ”

–” নেক্সট হলিডিতে সাদকে নিয়ে ডিজনি ল্যান্ডে যেতে পারো৷ চল এখন বাসায় যাই। তোমার রেস্ট নিতে হবে৷ মেডিসিনও নিতে হবে। লেটস গো৷”

_______________

তারা বাসায় যখন পৌঁছে তখন লাঞ্চ আওয়ার। সাদ আর হাসনাহেনা ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছিল। তাদের আসতে দেখে সাদ খুশি হয়ে বলে, ” তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একসঙ্গে লাঞ্চ করব। কাম৷”

হাসনাহেনাও যোগ দিয়ে বলে, ” আজকে মেক্সিকান একটা ডিশ করেছি। চিকেনের একটা প্রিপারেশনও আছে৷ ওটা অবশ্য তুর্কি স্টাইলে বানাবো। আসো মিরা৷ সেকি তোমার কপালে কী হয়েছে?”

মিরা টেবিলে বসে বলে, ” দুর্ঘটনার কবলে পড়ে গিয়েছিলাম৷”

ইমান কখনোই বাসায় খায় না। তাই ডাইনিং রুম অতিক্রম করে যেতে ধরলে, হাসনাহেনা বলে উঠে, ” তুমি উপরে কেন যাচ্ছো? খেয়ে যাও।”

আজকে ইমান মিরার সামনে ঝামেলা করল না৷ টেবিলে মিরার পাশে বসল। মিরা শর্টকাটে সবটা বলল। হাসনাহেনা বলে, ” আল্লাহর রহমত তোমার কিছু হয়নি৷”

তারা নিঃশব্দে খেয়ে উঠে৷ মিরা খেয়ে উপরে উঠে যায়৷ ইমানের খাওয়া শেষ হয়নি৷ সে টাইম নিয়ে ফোন চালাতে চালাতে খাবার চিবাচ্ছে৷

হাসনাহেনা বলে, “খাওয়ার সময় ফোন চালাতে হবে? ”

ইমান উঠে পড়ে। তার প্লেটে খাবার বাকি ছিল। সেগুলো আর খেল না৷ উপরে উঠে দেখল মিরা আজকেও ডিভানে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে৷ এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কেউ কীভাবে ঘুমাতে পারে?
ইমান তাকে পাজো কোলে তুলে বেডে শুইয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে দিল। এরপর নিজে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে৷

খানিকক্ষণ পর সে খালি গায়ে বের হলো বাথরুম থেকে। আসলে গেঞ্জি সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়েছিল। রুমে মিরা ঘুমাচ্ছে ভেবে সে বের হয়৷ কিন্তু মিরা তখন ঘুম থেকে উঠে বসে আশেপাশে তাকাচ্ছে। তাদের চোখাচোখি হতেই ইমান বেশ বিব্রতবোধ করে। এখনই ওর ঘুম ভেঙে উঠে বসতে হলো৷

মিরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, ” আমি না ডিভানে ছিলাম। বেডে আসলাম কীভাবে? ”

ইমান কাবার্ড থেকে গেঞ্জি বের করে পরিধান করে বলে, “আমি কীভাবে জানব? ”

— “মানে এটা কিভাবে পসিবেল?”

— ” আমি রুমে এসে তোমাকে এই জায়গায় দেখেছি।”

–” কিন্তু আমি ডিভানে ছিলাম। ক্লিয়ারলি মনে আছে৷”

–” তাহলে মনে হয় ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে এসেছো৷ আই মিন স্লিপ ওয়াক।”

মিরা হা হয়ে গেল। সে স্লিপ ওয়াক করে! মাই গড! কী ভয়ংকর রোগ! যদি সে ঘুমাতে ঘুমাতে বাইরে বের হয়ে যায়?

চলবে৷

[ আগামী দুইদিন গল্প দিতে পারব না। পরীক্ষা শুরু আমার আগামীকাল থেকে। সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী যেন এক্সাম ভালো হয়।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here