#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–34
ইমান ঠোঁটে টিপে হাসছে। বহু কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে৷ হাসির চাপে রাখায় মনে হচ্ছে পেট ফেটে যাবে৷
মিরার ফেস দেখে মনে হচ্ছে সে হিসাব কষছে। ঘুমের মধ্যে হাটার জটিল হিসাব যার সমীকরণ সে মিলাতে পারছে না৷
ইমান গলা ছেড়ে বলে, ” যারা বেশি বেশি খায়, তারা স্লিপ ওয়াক করে।”
মিরা তার দিকে ছোট করে তাকালে, সে সিরিয়াস মুড নিয়ে বলে, “সত্যি বলছি।”
এরপর ফোন নিয়ে হাঁটা দিল। একটু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিরে এসে বলে” আর এক শ্রেণির মেয়েরা স্লিপ ওয়াক করে।”
–“কারা?”
–” সুন্দরী কিন্তু ডাফর।”
মিরা রাগান্বিত চোখে তার দিকে তাকালো। ইমান এমন একটা ভ্যান ধরল যেন সে কিছুই বলেনি। ফোন হাতে নিয়ে রুমের শেষ প্রান্তে চলে গেল। ওদিকে বারান্দা আছে। মিরা ওইদকে আসা অব্দি একবারও যায়নি৷ দোতলার অর্ধেক জায়গা জুড়ে ইমান থাকছে। এটা যেন ওর নিজস্ব রাজ্য। ছোট খাটো একটা সংসার আছে এখানে। দুই রুম মিলে বিশাল একটা রুম বানালো হয়েছে। এই রুমটা যে আর্কিটেক্ট ডিজাইন করেছে সে চমৎকার একটা প্লান দিয়েছে৷ দুটো রুম মিলে তৈরি রুমটাতে একবারের জন্যও মনে হয় না অতিরিক্ত জায়গা পড়ে আছে। স্পেস বেশি। মাঠের মতো লাগে। বরং মনে হবে রুমটা এমন না হলেই বাজে দেখাত৷ আচমকা মিরার মাথায় একটা একটা চিন্তা খেলে যায়। তারা যে হাসবেন্ড-ওয়াইফ এটা শুধু তারা দুজন জানে৷ কিন্তু বাসার অন্য সদস্যরা তো কিছু জানে না। তারা কী ভাবছে? একসঙ্গে, একরুমে থাকাটাকে বাকা চোখে দেখবে না? তাকে খুব বাজে মেয়ে ভাবছে কী?
সে একটু জোরে করে বলে, ” এই যে শুনুন?”
ইমান ততোক্ষণে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মিরার ডাকে ঘার ঘুরালো। এবং ভাবলেশহীন ভাবে বলে, “আমার নিজের একটা নাম আছে৷ কাইন্ডলি আমার নাম ধরে ডাকুন।”
মিরা বিরক্তিতে চ বর্ণ উচ্চারণ করে বলে, ” যতোসব ঢং৷”
ইমান শুনতে পায়নি। সে বারান্দা থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।এরপর বলে উঠে, ” বলেন।”
মিরা সামান্য ভ্যাবাচেকা খেল। হুট করে তাকে আপনি বলাটা হজম হচ্ছে না৷ মনে হচ্ছে তিরিস্কার করছে।
সে বলে উঠে, ” আমরা যে একরুমে থাকছি আন্টি কি ভাববেন? আমি কিন্তু কাউকেই কোনদিন বলব না আমাদের সম্পর্কের কথা৷”
শেষ বাক্যটা কর্ণকুহর হওয়া মাত্র ইমান সামান্য নড়েচড়ে উঠে৷ এরপর আবারো ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বলে, ” আমাদের একসঙ্গে থাকা তো পাপ না৷ সুতরাং কে কী ভাববে সেটা দিয়ে তোমার কী কাজ?”
— “তারপরও আন্টি……..”
— ” আমার সঙ্গে না থাকলে আর কই থাকবে তুমি? হলরুমে? এদেশে সার্ভেন্টরাও হলরুমের ফ্লোরে থাকে না। এক্সট্রা কোন রুম নাই আমাদের। সাদের রুমে নিশ্চয়ই থাকবে না। তোমার আন্টির এত প্রব্লেম হলে বল তোমাকে ওনার রুমে নিয়ে যেতে। এরপর আব্বু আর ওনার মাঝখানে ঘুমাইও।”
ইমানের কথা শুনে মিরার চোখ বড় হয়ে আসে৷ সামান্য একটা কথাকে কি বিশ্রিভাবে বললো!
এরপর ইমান বলে, ” সবাই জানে আমার রুমটা আমার মনের মতো বিশাল। চোখে দেখো না কতবড় আমার রুম! পর্দা টেনে দিলে দুটো আলাদা রুম মনে হবে৷
মিরা হতভম্ব হয়ে বলে, ” এ রুমে পর্দা টানতে তো একবারও দেখলাম না৷”
ইমান হাত দিয়ে দেখালো ওইযে পর্দা গুজে দেওয়া আছে৷ পর্দা দেখার জন্য সে উঠে দাড়ালো। এবং পর্দা দেখে মিরা অভিভূত হলো। এটাকে পর্দা বলে? সাদা ফিনফিনে কাপড়ের মেটেরিয়াল। দিলেও যা না দিলেও তাই। ওপাশ থেকে এপাশ সব ক্লিয়ারলি দেখা যাবে৷ মিরা কটমট করে তাকায়।
ইমান ফোন পকেটে রেখে বলে, “সাদ বলছিল তোমাকে নিয়ে বিকেলে বাইরে যাব। রেডি থাকবে। আমি অফিস যাচ্ছি।”
সে বেরিয়ে গেল এক সেকেন্ডের ব্যবধানে। মিরার জানতে ইচ্ছা করল ইমানও যাবে কীনা তাদের সঙ্গে। কিন্তু সংগত কারণে জিজ্ঞেস করেনি এবং কিছু জিজ্ঞেস করার টাইমও পায়নি সে।
সে একবার পরখ করে রুমটা দেখল। এরপর রুমের মধ্যখানের এককোণে গুজে রাখা পর্দা টেনে দিয়ে ডিভানে গিয়ে শুলো। এটা তার রাজ্য৷ ওটা ইমান সাহেবের রাজ্য৷ এদিকে সে ইমানকে আসতে দিবে৷ হুট করে চোখে একগাদা ঘুম চলে এলো। ঘুমু ঘুমু অবস্থায় তার মনে হলো কেউ তার চুলে হাত বুলাচ্ছে। সে চোখ মেলতে চাইলে কারো উষ্ণ হাতের ছোয়া তার চোখে অনুভব হলো। তার চোখ বন্ধ করে দিয়েছে। চোখ খুলতে পারলো না সে। ঘুমের সাগরে সে তলিয়ে গেল৷
_____________
বিকেলের দিকে রুমের দরজায় ঠকঠক শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল৷ সে উঠে বসে। এরপর রুমের দরজা খুলতেই সাদকে দেখতে পেল। সাদ তাকে দেখে বলে, “তুমি রেডি হওনি? ভাইয়া তোমাকে কিছু জানায়নি?”
–” জানিয়েছে৷ আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সর্যি।”
— হেই ডোন্ট সে সর্যি। তুমি একটু নিচে আসবে৷ মাম্মা তোমাকে ডাকছে৷”
মিরার মনটা ভালো হয়ে গেল। কত ভালো একটা ছেলে সাদ। অথচ ওর বড়ভাই কীনা ওমন রাক্ষস! সে সাদের সঙ্গে নিচে নেমে আসলো। হলরুমে হাসনাহেনা স্যুটকেস বের করেছে৷ সেটা মেয়েদের জামাকাপড় দিয়ে ভর্তি৷ মিরা বলে, ” আন্টি, আমাকে ডেকেছেন? ”
হাসনাহেনা স্যুটকেস থেকে একটা জিন্স আর টপস বের করলেন। টপসটা খুব সুন্দর। ক্রিম কালারের৷
উনি বললেন, “আজকে তেমন শীত নেই৷ এটা পরতে পারো৷ আমার তো কোন মেয়ে নাই৷ কে পরবে এসব! খুব শখ ছিল একটা মেয়ে হবে৷ যাইহোক তোমরা নাকী ঘুরতে যাচ্ছো, এটা পরে যাও৷
মিরা ভদ্রতাসূচক বলে, ” আন্টি আপনিও আমাদের সঙ্গে আসুন না প্লিজ।”
হাসনাহেনার কথাটা খুব মনে ধরল। এবাসায় তাকে নিয়ে কেউ একবিন্দু চিন্তা করে না। কারো সময় নেই তার সঙ্গে কোথাও যাওয়ার একা একা দোকানে যায় সে। ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে যাওয়া হয় আজ কতদিন হলো!
তিনি নরম গলায় বলেন, ” আজকে তোমরা যাও৷ অন্য আরেকদিন যাব।”
মিরা তার দেওয়া জিন্স আর টপস পড়ল। সঙ্গে একটা শীতের টুপিও ছিল। সে টুপিটা মাথায় দিয়ে আয়নায় তাকালো। মাই গড! তাকে পুরা বিদেশিণীর মতো লাগছে৷ মা তাকে দেখলে এখন নিশ্চয়ই কপালে চুমু খেত৷ যেদিন করে মিরা সুন্দর করে সাজত, মা তার কপালে চুমু দিত৷ মায়ের কথা মনে পড়তেই তার মন খারাপ হয়ে আসে৷
কিছুক্ষণ পর সাদ তাকে নিয়ে বাসার মেইন রাস্তা অব্দি হেটে গেল। এরপর মেইন রোড থেকে ক্যাব হায়ার করে৷ ট্যাক্সি চালককে সে বলল, “সিটি হল পার্ক যাব৷”
ট্যাক্সিচালক বলে, ” সিটি হল পার্কের কোন জায়গায়?”
–” ব্রুকলিন ব্রীজে যাব৷”
এবারে মুখ খুলল মিরা৷ সে বলে উঠে, “ব্রুকলিন ব্রীজ! এটা কোথায় সাদ?”
–” তুমি ব্রুকলিন ব্রীজের নাম শুনোনি?”
–“উহু।”
–” ওকে। সমস্যা নাই। সরাসরি দেখে নিও।এটা খুব ফেমাস একটা জায়গা।”
তারা ক্যাবে উঠে পড়ে৷ প্রায় বিশ মিনিটের মধ্যে সিটি হল পার্কে এসে পৌঁছায় তারা। সেখান থেকে একটু হাঁটলেই মানহাটানের সঙ্গে লাগানো ব্রুকলিন ব্রীজের দেখা মিলবে৷ মিরাকে নিয়ে সাদ ব্রুকলিন ব্রীজের কাছে আসলো। রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়ে আছে তারা।টুরিস্ট স্পট হওয়ায় এখানে ভালোই ভীড়। সবাই পারফেক্ট ভিউয়ে পিকচার তুলায় ব্যস্ত৷ মিরা আশপাশে তাকিয়ে দেখছে৷ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে সবটা।
সাদ বলে, ” এটা আমাদের সিটি মানে মানহাটান আর ব্রুকলিন শহরের ডামবোর মধ্যকার সেতু। তুমি কী এখনোই ব্রীজে উঠবে নাকী রিভারটা একবার দেখে নেবে?”
–” চল নদীটা দেখে আসি।”
সাদ তাকে নিয়ে ব্রীজের নিচেই নদীর ধারে গেল। নদীতে নামা নিষেধ। তবে বাউন্ডারি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করা যাবে৷ নদীর তীর ঘেঁষে ছোট-বড় পাথর আছে। নদীর পানি স্বচ্ছ। নীল রংয়ের দেখাচ্ছে। সাদা ফ্যানা তোলা ঢেউ এসে পাথর আছড়ে পড়ছে। সো সো বাতাস। নীল আকাশে পাখি উঠে যাচ্ছে।
মিরা বাউন্ডারির কাছে গিয়ে দাড়ালো। দূর থেকে দেখলে মনে হবে নদী তেমন একটা গভীর না৷ কিন্তু কাছে গিয়ে এর স্রোত দেখলে সামান্য ভয়ই লাগবে। যদি পড়ে যায় কেউ, তার অবস্থা কাহিল৷ নদীর বুক দিয়ে স্টিমার, ইঞ্জিনচালিত বোট যাচ্ছে। দূর থেকে আমেরিকার পতাকা উড়ছে৷ বীচ ভিউ, উপরে ব্রুকলিন ব্রীজ কী অপূর্ব দৃশ্য৷
সাদ বলে, “এটা ইস্ট নদী৷ এখানে আমি আমার প্রথম গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ডেটে এসেছিলাম। সানসেটের সময় এই জায়গাটা খুব চমৎকার লাগে। এখন এতোটা সুন্দর লাগবে না৷ আচ্ছা ব্রীজের উপরে চল। ভাইয়া আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে৷”
মিরা অবাক হয়ে বলে, ” তোমার ভাইও এসেছে?”
–” আসার কথা ছিল না। কিন্তু হুট করে বলল সেও জয়েন করবে আমাদের সঙ্গে।”
মিরার বুক দুরুদুরু করতে লাগলো। কেন যেন ইমানের সামনে আসতে তার ভারী লজ্জা লাগে৷ সাদ তাকে নিয়ে ব্রীজের উপরে উঠে৷ ব্রীজে উঠা অব্দি সে এক পলকের জন্য চোখ বন্ধ করে। পুরা দৃশ্যপট মুগ্ধ হয়ে দেখেছে৷ তারা ব্রীজের মধ্যে, একদম টপে উঠে অয়াশ দিয়ে সাইকেলও যাচ্ছে। নিচের লেনে হাই স্পিডে গাড়ি যাতায়াত করছে৷ ওয়াক লেন দিয়ে হাঁটছে তারা৷ একদম মেইন ভিউ পয়েন্টে আসতেই মিরার মনে পড়ে গেল, কাল হো না হোর গানের শুটিং তো এখানে হয়েছিল৷ ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে শাহরুখ খান নেচেছিল। ওহ মাই গড! তার বিশ্বাস হচ্ছে না সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে! এ যেন স্বপ্ন!
আচমকা তার বাহু ধরে কেউ টান দিল। সে টাল সামলাতে না পেরে, ব্যক্তির বুকে গিয়ে ঠেকল। মাথা থেকে তার টুপি পরে গেল৷
মিরা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে ইমান তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করেছে। আশপাশ দিয়ে কত মানুষ হাঁটছে! অথচ বেহায়া ছেলেটা তাকে টান মেরে নিজের বুকে এনে ধাক্কা দিল!
সে ঝারি মেরে উঠে বলে, ” আপনার সমস্যা কী? আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলতে চাচ্ছেন কেন?”
ইমান প্রথমে অবাক হলো। এরপর বলে উঠে, “সেই দশ মিনিট ধরে পেছনে থেকে ডাকছি। শুন না জন্য হাত ধরে টানলাম। আমি তো জানতাম না তুমি পরে যাবে৷”
মিরা সরে আসতে ধরলে, ইমান তার কোমড় শক্ত করে ধরে নিজের সঙ্গে মিশে নেয়৷
মিরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” এখন সরতে দিচ্ছেন না কেন? আটকে ধরছেন কেন?”
–” তুমি বুকে থাকলে শান্তি লাগে খুব।”
–” কী বললেন? ”
–” বললাম ব্রুকলিন ব্রীজ অনেক সুন্দর। আমার একটা শখ আছে, জানো সেটা?”
–” জানি না। জানতেও চাই না৷”
ইমান তার কোমড় চেপে ধরে মুখটা তার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে, ” আমি আমার লাইফের ফাস্ট লি*প কিসটা এই ব্রীজের সামনে দাঁড়ায় আমার বেটারহাফকে গিফট দিব। ব্রুকলিন ব্রীজকে সাক্ষী রেখে কিস করব৷ ”
চলবে৷