#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–4
সবে মাত্র তৃতীয় দিন ফাল্গুনের। আকাশ শুভ্র মেঘকুঞ্জে ভরা থাকলেও ব্যস্ততার কারণে কারো আকাশের দিকে তাকানোর সময় নেই। বিশাল কাঁচ দিয়ে ঘেরা জানালার দিকে নির্বাক চাউনি মেলে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইমান একটা সিগারেট ধরায়। হলুদের অনুষ্ঠানে আসার পর থেকেই তার ঘাড় ব্যথা করছে। বালিশ পরিবর্তন হলে তার এই সমস্যা দেখা দেয়। সে সিগারেটে ফুক দিয়ে ফুচকা কর্ণারের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে। ফুচকা আর কফি কর্ণারটা ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসছে। কারণ ডিনার সার্ভ করা হয়েছে। সব গেস্টরা খেতে যাচ্ছে। কিন্তু একজন অতি বিশেষ রমণী এখনো ফুচকা কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে ফুচকার অপেক্ষায়। ওয়েটার সম্ভবত ফুচকা বানানো বন্ধ করে দিয়েছিল। রমণীর আদেশ কিংবা অনুরোধে পুনরায় বিরক্তি মুখে ভাবলেশহীন ভাবে ফুচকা তৈরি করছে। রমণী কোমড়ে হাত গুজে অপেক্ষায় আছে। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িতে দুধে আলতা গায়ের রঙ যেন গাছে পাপড়ি মেলে থাকা টকটকে রক্তজবার মতো ফুটে উঠেছে। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা ঈষৎ হাসি তার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে যেন!
ইমান পকেট থেকে ফোন বের করে সেই রমণীর অজান্তেই একটা ছবি তুলে নিল। এরপর ফোন প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে ফুচকা কর্ণারে এসে বলে, “কী ব্যাপার? এখন তো ডিনার টাইম। ডিনার না করে এইসব ছাইপাঁশ কেন খাচ্ছো?”
মিরা ইমানকে আসতে দেখেই বিরক্তবোধ করে বলে, আপনার তাতে কী? আপনাকে খেতে বলেছি? আমার ইচ্ছা আমি খাব।
ইমান ভ্রু নাচিয়ে বলে, তোমার আর কী কী খেতে ইচ্ছা করে একটু লিস্ট বানিয়ে দেও তো।
বলেই ফিচেল হাসি হাসল। সে সরাসরি মিরার পানে তাকিয়ে তার কাছে উত্তর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে৷
মিরা বিড়বিড় করে বলে, বেয়াদব ছেলে তোমাকে খেতে ইচ্ছা করছে। তাহলে এখন কীভাবে নিজেকে রান্না করবে?
ইমান তার কথা বোধহয় শুনতে পেল। তবে প্রতিত্তোরে কিছু বলল না খালি হাসল। ওয়েটারটা এক প্লেট ফুচকা টেবিলে রেখে সব গুছিয়ে নিয়ে কেটে পড়ল। মিরার আগেই ইমান প্লেটটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, “কতদিন পর ফুচকা চোখে দেখলাম! শেষ কবে খেয়েছি মনে পড়ে না। আগে আমরা স্কুল শেষ করে ফুচকা খেতাম। এক প্লেট পাঁচ টাকা করে।”
মিরা ঠোঁট গোল করে বলে, ও। আমি প্রায়ই এক্সট্রা ঝাল দিয়ে ফুচকা খাই।
ইমান নিজের মুখে একটা ফুচকা পুড়ে দিয়ে বলে, আগের মতো মজা নাই আর। বাংলাদেশটাও আর আগের মতো নেই। এই শহরটায় নিজের শৈশব খোঁজার চেষ্টা করছি কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না।
মিরা বুঝতে পারছে না ইমান কেন তাকে এইসব বলে সময় নষ্ট করছে। একে তো সে নিজের জন্য ওয়েটারকে এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ফুচকা ওর্ডার দিয়ে আনালো। সেই ফুচকা এখন উনি খাচ্ছেন আয়েশ করে। কেন আগে যখন সার্ভ করা হয়েছিল তখন কই ছিল? নিশ্চয়ই কোন সুন্দরী ললনার পিছন পিছন ঘুরছিল। এইজন্য সময় পায়নি সাহেব ফুচকা খাওয়ার। এখন তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে খাচ্ছে।
ইমান হুট করে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, গালি দিলে নাকি আমাকে?
মিরা ঘাবড়ে গিয়ে বলে, আমি গালি দিই না।
ইমান কিছু পল তার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে থাকে। এতে অস্বস্তি হতে থাকে মিরার। সে পাশ কাটিয়ে সরে যেতে ধরলে, ইমান তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আরে যাচ্ছো কেন? ফুচকা খাবে না?
— আপনি খান মজা করে৷
— তোমার সাথে খেলেই মজা পাব।
মিরা তার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, মানে?
ইমান প্লেট এগিয়ে দিয়েই বলে, শেয়ারিং ইজ কেরারিং ইউ নো না?
মিরা দেখল প্লেটে এখনো চারটে ফুচকা অবশিষ্ট আছে। সে টক মিশিয়ে একটা ফুচকা ঠোঁট সামান্য খুলে মুখে পুড়ে নিল। ইমান ফুচকা হাতে নিয়ে তার ফুচকা খাওয়া বেশ আয়োজন করে দেখছে। তাকে দেখে মনে হবে মিরার ফুচকা খাওয়া দেখা জগতের সবচেয়ে দামী দৃশ্য। যদিও বা দুইজনের শেয়ার করে খাওয়ার কথা থাকলেও, ইমান অবশ্য আর খায়নি। সবটাই মিরাকে খেতে হয়েছে। ফুচকা খাওয়ার পালা চুকিয়ে তারা বর-কণের কাছে চলে যায়। সব গেস্টদের খাওয়া শেষ। এখন শুধু বর-কণে আর তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের খাওয়া বাকি।
মিরা গিয়ে সোনালী আপুর পাশের চেয়ারে বসল। ইরা আগেই খেয়ে নিয়েছে জন্য সে তার এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প করায় ব্যস্ত। মিরার পাশের সীটটা খালিই ছিল। খাওয়া আরম্ভ করার পর পর ইমান মিরার খালি সীটটার সামনে এসে দাঁড়ালো কিন্তু বসল না। সে গলার সুরে রসিকতা এনে বলে, দুলা ভাই খাওয়া-দাওয়া কেমন হচ্ছে? বউয়ের পাশে বসে খেতে লজ্জা পাচ্ছেন নাকি?আরেকটা রোস্ট নেন বলেই সে রোস্টের ডিশ এগিয়ে দিল। প্রান্ত ভাই ইমানের এই আন্তরিকতায় খুশি হয়ে সোনালীকে আস্তে করে বলে, তোমার ভাই কী ডিনার করেছে? খেতে দেখলাম না তো। ওকে আমাদের সঙ্গে বসতে বলো৷
সোনালী আপু মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলে এবং গলার স্বর খানিক উচু করে বলে, এই ইমান আয় বস মিরার পাশে। একসাথে খাই।
ইমান জবাবে বলে, আমি খাব না আপু। তোমাদের কে দেখতে এলাম জাস্ট। এরপর মিরার দিকে তাকিয়ে বলে, মিরা তোমাকে আরেকটা রোস্ট দিই?
কথাটার মধ্যে মিরার ঠেশ মেরে বলার চিহ্ন পেল। কাজেই অকপটে জবাব দেয়, আপনার রোস্ট খেতে মন চাচ্ছে বললেই হয়।
ইমান যেন খানিকটা ভড়কে গেল। এরপর কিছু বলবে তা মনে মনে গুছিয়ে নিতে নিতেই সোনালী আপু বলে উঠে, মিরা ওকে কাবাবটা খাইয়ে দে তো। ও তো ছোট থেকেই কাবাব খুব পছন্দ করে।আমেরিকায় কী আর এতো মজার কাবাব পাওয়া যায়?
মিরার হাতে একটা কাবাব ধরিয়ে দিল সোনালী আপু। সে বলে উঠে, তুমি-ই খাইয়ে দাও আপু।
সোনালী আপু বলে, আমিই খাওয়াতাম৷ কিন্তু দেখ তো লম্বুটা সেই কই দাঁড়ায় আছে। ওতোদূর আমার হাত যাবে?
মিরা কাবাব হাতে নিয়ে বোকার মতো বলে উঠে, “আপনি একটু মাথা নিচু করুন তো।”
ইমান ভারী অবাক হয়ে ঘাড় কুচো করতেই মিরা তার মুখের সামনে কাবাব ধরল। সে দ্বিতীয় দফায় অবাক হয়ে গেল এবং মুচকি হেসে বলে, বাপরে আজকে ওতো দরদ জন্মালো কী করে? সারাদিন তো গালির উপর রাখো আমাকে।
— খাওয়ার সময়ে এতো কথা বলতে হয় না।
মিরা আরেকটু খাবারটা এগিয়ে দিতেই ইমান ভদ্র ছেলের মতো কাবাবটা মুখে তুলে নিল। এরপর জর্দার বাটি থেকে একটা ছোট মিষ্টি হাতে নিয়ে মিরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, নাও মিষ্টি খেয়ে মিষ্টির মতো সুইট হও।
মিরার ইচ্ছা ছিল না ইমানের দেওয়া মিষ্টি খাওয়ার কিন্তু মুখে পুড়ে নেওয়ার পর তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। ফটোগ্রাফার এসে কয়েকটি ছবিও তুলে নিয়েছেন এই ফাকে।
যেহেতু পুরান ঢাকার অনুষ্ঠান তাই আরো রাত অব্দি বলতে গেলে একটা-দেড়টা অব্দি অনুষ্ঠান চলবে৷ খাওয়ার পর্ব চুকাতেই রাত সাড়ে এগারোটা পাড় হয়ে গেল। এরপর বরপক্ষের সৌজন্যে সাউন্ড বক্সে গান ছাড়া হলো। সবাই মিলে হৈচৈ করতে লাগলো। ইমান একপাশে দাঁড়িয়ে ফোন চালাচ্ছিল। প্রয়োজনীয় মেইল চেইক দিচ্ছিল সে। মেইল চেক দিতে গিয়ে বেশ কিছু সময় পার হলো। তার আর প্রোগ্রামের দিকে হুশ নেই৷ পরক্ষণেই বড় চাচা তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো? যাও সবার সঙ্গে গিয়ে আনন্দ কর৷
ইমান দ্রুত ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলে, জী চাচা। কয়েকটা প্রয়োজনীয় কাজ সেড়ে নিলাম। এখনই যাচ্ছি।
সে সামনে আগাতেই তার সঙ্গে বরপক্ষের সেই ছেলেটার ধাক্কা লাগলো। সে গলায় ভদ্রতার টান এনে বলে, “আস্তে৷”
ছেলেটা ব্যস্ততা দেখিয়ে সর্যি বলেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ইমান ঈগল চক্ষুতে তাকে পরখ করল। ছেলেটা সোজা মিরা যেখানে সেইদিকে হাঁটা ধরেছে। ছেলেটার নাম রাকিব। বিবিএ সেকেন্ড ইয়ার।ড্যাফোডিলে পড়ে৷ প্রান্ত ভাইয়ের চাচাত ভাই। সে বুঝে পায় না, দুলাভাইয়ের চাচাত ভাইয়ের সঙ্গে এতো কিসের খাতির মিরার? রাগে গা জ্বালা দিয়ে উঠতেই সে হতভম্ব। আশ্চর্য মিরা রাকিবের সঙ্গে কথা বলায় তার এতো কেন জ্বলছে? জ্বলছে তো জ্বলছেই বরং এমন ভাবে জ্বলছে যেন মনটাই বুঝি দগ্ধ হয়ে ছাইবর্ণ ধারণ করবে!
মিউজিক বক্সে তখন “শিলা শিলা” গান বাজছে। ইমানের বিরক্তি এবার রাগে রুপান্তর হচ্ছে৷ রাকিব মিরা একসঙ্গে নাচানাচি করছে৷ অবশ্য ওরা একা না। গানের তালে অনেকেই নাচছে। রাকিব মিরার কিছুটা কাছাকাছি অবস্থান করতেই,
ইমান হনহন করে হেঁটে গিয়ে মিরাকে ডাকল৷ মিরা বলে উঠে, কিছু বলবেন?
— কাজ আছে। আসো একটু৷
মিরা সরে আসতেই ইমান তাকে সঙ্গে করে ম্যানেজারের রুমে গেল। সেখানে ম্যানেজারের সঙ্গে হুদাই আগ বাড়িয়ে কথা বলল। আবার কমপ্লিন ও দিল। যেগুলো একদম অপ্রয়োজনীয়। যেমনঃ হলে নাকি লাইটিং কম ছিল। আরো ব্রাইট হওয়া দরকার। কাবাবের মাংস বেশি গলানো হয়েছে যার জন্য টেস্ট ভাল হয়নি৷
মিরা কমপ্লিন গুলো শুনে অবাক। লাইটিং তার কাছে কম লাগেনি। তার সব ছবিই কী সুন্দর এসেছে। আর কাবাবটাও মজা ছিল। সে নিজেই দুটো খেয়েছে।
ম্যানেজার ভদ্রলোক বেশ ভালো। এক গাল হেসে বলে, জি স্যার নেক্সট টাইম থেকে খেয়াল রাখব৷।
ম্যানেজারের রুম থেকে বের হয়ে, তাকে নিয়ে ইমান পার্কিং লটে এসে বলে, তুমি এখানে দাঁড়াও আমি সামিয়ানা খুলল।
— সামিয়ানা খুলার জন্য তো লোক আছেই৷
— বেশি বুঝতে হবে না তোমাকে।
বলেই নিজ গরজে একপাশের সামিয়ানা খুলল। এরপর হলের ব্যাকসাইড থেকে ডালা এনে এনে বরপক্ষদের গাড়িতে ঢুকাতে শুরু করে৷ মিরাও কেউ তার সঙ্গে যেতে হচ্ছে। ডালা নাকি সে একা ধরে আনতে পারবে না। আরেকজনের সাহায্য লাগবে৷ বিশ-একুশটা ডালা। একটা একটা করে হলের ব্যাকসাইড থেকে এনে গাড়িতে ঢুকাতে ঢুকাতে রতা একটা পার। মিরার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে৷ তার পাও ব্যথা শুরু করেছে। বিরক্তিতে সে চ বর্ণ উচ্চারণ করে। অযথাই তাকে নিয়ে চর্কি ঘুরছে তারা।
মিরা এবারে রাগ নিয়ন্ত্রিত করে বলে, আর কত? ওদিকে গান ও বন্ধ হয়ে গেল। সবাই কত মজা করল। আপনি আমাকে একফোঁটা মজা করতে দিলেন না৷
ইমান ফোন বের করে সময় দেখে বলে, তুমি এতো সেলফিশ কেন? বোনের বিয়েতে সামান্য কাজটাও করতে চাও না। কই আমি ও তো আনন্দ করলাম না। তাই বলে কি তোমার মতো ফ্যাস ফ্যাস করে কাঁদছি ? আমার রেসপনসেবলিটি আছে না?তোমার মতো ঢ্যাং ঢ্যাং করে নাচা-নাচি করি না। বুঝলা?
চলবে।
[ আপনাদের নীরবতায় আমার লেখার ইচ্ছাটাই মরে যাচ্ছে। মনে হয় গল্পটা কেউ পছন্দ করছেন না। অবশ্য এটা আমারই এক ধরনের ব্যর্থতা। ]