ফেইরিটেল পর্ব-৫১

0
1785

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–51

পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ নাকী সময়। সময় মূল্যবান কারণ এটাকে কেউ টাকার মতো নিজের কাছে গচ্ছিত রাখতে পারে না। নিম্নবর্গের মানুষ থেকে শুরু করে দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি– সবার জন্য রাত-দিন মিলে চব্বিশ ঘণ্টাই বরাদ্দ। এই সময় দ্রুতগামী রেলগাড়ীর মতো অবিরাম চলছে৷ ঝিকঝিক শব্দ তুলে। কোথাও থামবার জো নেই তার। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিট, মিনিট গড়িয়ে ঘণ্টা, ঘণ্টা গড়িয়ে দিন এবং দিন গড়িয়ে মাস যায়, বছর আসে। এটাই জাগতিক নিয়ম। আমরা কোনদিন নিয়ম ভঙ্গ করতে পারি না। প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করার ক্ষমতা এ জগতের কোন জীবের নেই৷

নিউইয়র্কে বসন্তের একদিন, আজ নিউইয়র্কে যেন রঙ লেগেছে। চারপাশ হরেক রকম রঙিন ফুল-পাতায় ভরপুর। রাস্তায় রাস্তায় ফুল এবং পাতা পড়ে আছে। পৃথিবীবাসী ভাবে নিউইয়র্কের শীতকাল বেশি সুন্দর কিন্তু ইমানের কাছে বসন্তকাল বেশি ভালো লাগে। বসন্তমুখর ফুলেল নিউইয়র্ক মনের কোণে অদ্ভুত রকমের ব্যাকুলতা সৃষ্টি করে৷ এসময় নিউইয়র্কের বিভিন্ন পার্ক, ফাঁকা অরণ্য জায়গায় টিউলিপ ফুল ফুটে। গাছে গাছে গোলাপি চেরি ফুলের মেলা বসে। পাখিরা গান গায়। প্রজাপতি, মৌমাছি খেলাধুলা করে। কাঠবিড়ালি গাছ থেকে গাছে লাফায়৷

ইমানের আজ অফিসের শেষদিন ছিল। সে দশম বারের মতো জব ছেড়ে দিল। আজকাল কোথাও মন টেকে না। খালি বুকের ছটফটানি বিরামহীন ভাবে চলতে থাকে। একশ’ বিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আধঘন্টা ধরে পানি ফুটাতে থাকলে, পানি যেমন করে অস্থিরতা শুরু করে, আজ থেকে ছয়টা বছর ধরে তার সারা শরীরের রগে রগে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরায়-উপশিরায় সেইরকম অস্থিরতা ভেসে চলেছে৷ এর মাঝে তিন বছরের জন্য সে ওয়াশিংটন ছিল। এবছর আবারো নিউইয়র্কে ব্যাক করেছে জবের জন্য । কিন্তু সেই জবও আজ ছেড়ে দিল৷ গাড়ি চালিয়ে সে টাইম স্কয়ারের দিকে যেতে চাইছিল কিন্তু আনমনেই বাক ঘুরের ব্রুকলিন ব্রীজের দিকে আগালো। ওই জায়গায় দারুণ কিছু স্মৃতি আছে তার। সেই স্মৃতি বারবার সে মনে রাখতে চায়৷ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বিগত ছয় বছরের হিসাব মিলালো সে। মিরা ফিরে যাওয়ার পর তার কাছে সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকা অসার্থক লাগছিল। কাকে নিয়ে বাঁচবে সে? প্রিয়জনের মনে নিজের প্রতি বিপুল পরিমাণ অবিশ্বাস কাধে চাপিয়ে বেঁচে থাকা দুর্বিষহ। তবে এখন সে বেঁচে থাকার জন্য একটা মাত্র অর্থ পেয়েছে। একটা কারণ, একটা আলো! তার জীবন যখন থেমে গেল, সবকিছু অসহ্য লাগতে লাগলো, তখন একটামাত্র সংবাদ তার জীবনের মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মতো শান্তি এনে দিল৷ তার আর মিরার সন্তান আসার খবর তার বুকে আশার আলো এনে দিল৷ মরে যেতে গিয়েও বেঁচে থাকার সূর্যোদয় নতুন করে সূচনা হলো। মিরার দেশ ছাড়ার পর সে উম্মাদের মতো আচরণ শুরু করে। হাসনাহেনা, সাদ তাকে বোঝানোর বহু চেষ্টা করে। কিন্তু সে বাড়ি ছেড়ে আসে৷ ওই দোতলার রুমে মিরার স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়ায়৷ মুহূর্তেই করোনা মহামারীর প্রকোপ বেড়ে গেল। সারা আমেরিকা অচল হয়ে পড়ল। সব থমকে গেল। পৃথিবীবাসীর হাহাকারে পাখিরাও কিচিরমিচির করা বন্ধ করে দেয়৷ আমেরিকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হলো। বেশ কিছু দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করা হলো। ফলে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে যাওয়া পেছালো তার৷ এরপর নিজেই করোনা ভিকটিম হলো। সব মিলিয়ে মিরা যাওয়ার তিন মাস পর সে বাংলাদেশে যায়। ততোদিনে অনেককিছু পালটে গেছে। বড় মামা নানীকে নিয়ে বসুন্ধরায় থাকেন। এদিকে তার পরিবার মানে মিরারা মিরপুরে। ছোট মামা পুরান ঢাকায় ছিলেন তখন। সে আসায় সবচেয়ে রাগ করে সোনালী আপু। নানীও তাকে দেখে ক্ষিপ্ত হন। মিরা সবাইকে বিয়ের পরবর্তী কালীন কথা জানিয়ে দিয়েছিল। বড় মামা একদিন তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, ” মিরা তোমার বউ হলেও, ও আগে আমাদের মেয়ে৷ ওর সুখ-ই আমাদের সুখ। আমি ভেবে-চিন্তে তোমার সাথে ওর বিয়ে দিলাম। ভাবলাম তুমি ঘরের ছেলে। ওকে আগলে রাখবে। কোনদিন ওকে আঘাত দিবে না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম৷ তুমি সবচেয়ে বেশি ওকে আঘাত দিয়ে ফেললে৷ ও এখন সময় চায়। ওকে সময় দিতে পারলে, অপেক্ষা কর। নাহলে অন্যকিছু ভাবো৷”,

অন্যকিছু ভাবা যে তালাক তার বুঝতে সময় লাগল না। মিরার সঙ্গে তার দেখাও হয়।ওকে।দেখার পর তার মনে হয়েছিল, তার বউ বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিটি প্রেগন্যান্ট ওমেন৷ ওই ভরা পেটে সে হাতও রাখে৷ অনুভব করে নিজের অনাগত অস্তিত্বকে। কিন্তু মিরা তার প্রতি সহায় হয়নি। দিন কে দিন আরো কঠিন হচ্ছিল৷ সবার রাগ ও ঘৃণার পাত্র হলেও সুপ্তি বেগমের তার উপর মায়া হলো। ইমান তার হাত ধরে কেঁদেও দিয়েছিল৷ তখন উনি প্রশ্রয় দিয়ে বলে, ” আমি মিরাকে বোঝাব৷ আপাতত ও সুস্থ হোক। এখন ওর মনে চাপ দিতে চাচ্ছি না। তবে আমার উপর বিশ্বাস রাখো৷ আমি ওকে বোঝাব৷ ওর চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি৷ ভালোবাসা হলো চুম্বকীয় বস্তু। এটা আশেপাশের অভিমানকে টেনে নিজের গায়ে বসিয়ে দেয়। তুমি ওকে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সময় দাও৷ ”

সেই ছয় বছর ধরে মিরাকে সুপ্তি বেগম বোঝাচ্ছেন। ছয় বছর ধরে ইমানও অপেক্ষায় আছে। অপেক্ষায় আছে তার পরিবারকে ফিরে পাওয়ার জন্য। আরেকটা বার!

ব্রুকলিন ব্রীজের দিকে হাঁটা দিলেও সে থেমে যায় মাঝপথে। এরপর ফিরে আসে, গাড়ির দিকে৷ দশ মিনিটের মধ্যে সাদা গাড়িটার ছাদে গোলাপি চেরি ফুলের পাপড়িতে ভরে গেছে। সে বিড়বিড় করে বলে, ” আমার জীবনে কী কোনদিন বসন্ত ফিরে আসবে?”

____________________

কোন একদিন সকালবেলার বাংলাদেশ, মিরপুর। মিরপুরবাসীদের নিয়ে ঢাকাবাসীদের ট্রল করার শেষ নেই৷ মেট্রোরেলের জ্যামের জন্য মিরপুর বিখ্যাত৷ স্টেডিয়ামের জন্য জনপ্রিয়। চিড়িয়াখানার জন্য সবার কাছে পরিচিত। এবং বেনারশি পল্লির শাড়ি সবার বাজেটপ্রিয়৷ তখন ভোর সোয়া পাঁচটা বাজে। মিরা এলার্মের আওয়াজে উঠে বসে। চোখে ঘুম লেগে আছে এখনো। কাল রাত জেগে কাজ করেছে সে। ঘুম কম হয়েছে৷ সে উঠে ফ্রেস হলো৷ রান্না করতে হবে। সকালের নাস্তার পাশাপাশি টিফিন এবং বিকেলের নাস্তার প্রিপারেশন সেড়ে যেতে হবে। সকালে উঠে আদা চা খায় সে। এরপর সব কাজ করে। চুলোর আচ্ বাড়িয়ে রুটি বেলতে লাগলো৷ সাতটা অব্দি রান্না সেড়ে সে পুনরায় বেডরুমে গেল। বেডে গুটিসুটি অবস্থায় ঘুমন্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এখন শুরু হবে যুদ্ধ। যুদ্ধই তো। বাবুকে উঠিয়ে স্কুলের জন্য রেডি করা যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। কথাটা হাসির শোনালেও যারা ছোট্ট বাচ্চার মা তারা হারে হারে টের পায় এর সত্যতা। সে বাবুর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ” বাবু উঠো! ময়নাপাখি উঠো৷ স্কুলে যাবে না?”

সে নড়েচড়ে উঠে। আরো চারবার ডাকার পর একচোখ খুলে বলে, ” আম্মু আজকে স্কুলে যাব না৷ স্কুল পঁচা৷”

মিরা বলে উঠে, ” স্কুলে না গেলে বড় হবে না তো বাবা। স্কুলে যেতেই হবে৷ উঠো, উঠো৷

বাবু মটকা মেরে শুয়ে থাকল৷ মিরা এবারে বলে উঠে,” ইমাদ উঠো তো বাবা। তুমি বড় হতে চাও না?”

–” চাই আম্মু।”

–” এভাবে স্কুলে না গিয়ে বাসায় থাকলে কোনদিন বড় হবে না।”

ইমাদ চটজলদি উঠে বসল। মিরার মায়াই হলো। ছোট বাচ্চাগুলোর উপর জুলুম করা হয়। কিন্তু কিছু করার নাই স্কুল তো যেতেই হবে। ইমাদ যখন ফ্রেস হয়ে আসে, মিরা তাকে ইউনিফর্ম পড়িয়ে দেয়। সে বলে উঠে, ” আম্মু জানো, সৃজা না আমার নামে ম্যাডামকে কমপ্লিন দিয়েছে৷”

–” তুমি কী করেছো?”

–” আমি কিছু করিনি৷ ও সবসময় ক্লাসে কথা বলে। এজন্য বোর্ডে ওর রোল লিখেছি। তখন থেকেই আমার উপর রাগ ওর। কালকে আমাকে টিফিন টাইমে মারছিল। আমিও মারছি। ও ম্যামকে বলে দিসে। এখানে আমার কোন ফল্ট নাই।”

মিরা বললো, ” ফ্রেন্ডের সঙ্গে মা/রা/মা-রি করবে না বাবা৷ ”

ইমাদ ভদ্র বাচ্চার মতো বলে, ” আচ্ছা।”

সাড়ে সাতটায় সে ইমাদকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। বাসায় সবাই ঘুমাচ্ছে। নিচে গাড়ি পার্ক করা ছিল। আজকে ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে এজন্য ঠিক করল নিজেই ড্রাইভ করে। সে ড্রাইভিং শিখেছে৷ কিন্তু গাড়ি চালানো হয় না৷ আজকে ইমাদকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে সে অফিস যাবে।

তাকে ড্রাইভিং সীটে বসতে দেখে ইমাদ প্রশ্ন করে, ” আম্মু তুমি গাড়ি চালাবা?”

–” হ্যাঁ।”

ইমাদকে স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার সময় সে জানালো, ” আম্মু জানো, বাবা আমার জন্য বড় বড় খেলনা পাঠাচ্ছে৷”

মিরার মুখ থেকে সঙ্গে সঙ্গে হাসি বিলীন হয়ে গেল। সে বলে উঠে, “গত মাসে না অনেক গুলো খেলনা আনালে আবার কেন?”

ইমাদ এর জবাব দিতে পারল না। মাকে চুমু দিয়ে বলে, ” বাই, বাই আম্মু। তুমি বাসায় তাড়াতাড়ি আসবা কিন্তু।”

ছেলের আদুরে স্পর্শে মিরার কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে হেসে বলে, ” আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আসবো৷ ”

ইমাদকে স্কুল গেইটের ভেতর ঢুকতে দেখে সে গাড়ি ঘুরালো। ইমাদের স্কুল থেকে তার অফিসে যেতে ঘন্টা খানেক লাগে৷ এ সময় জ্যাম হয় বেশ৷

পয়তাল্লিশ মিনিট পর সে অফিসে প্রবেশ করে। আজকে অফিসের পরিবেশ থমথমে৷ সে আসতেই পিয়ন আনিস মিয়া চা এনে দিয়ে বলে, ” আফা, অফিসের পরিবেশ ভালা না।”

–” তাতো বুঝতেই পারছি৷ কিন্তু হয়েছেটা কী?”

–” ন্যান্সি ম্যাডাম সিইও সাহেবকে বের করে দিসে। উনি নাকী বিরাট অংকের টাকা মারছে। ম্যাডাম ক্ষেইপা গেল। ওনারে পাকড়াও করলে, সিইও চোর ব্যাটা উলটা হুমকি দিসে। কয় আমারে ছাড়া এই অফিস, ব্যবসা চলব?”

মিরা বিচলিত হলো। এই অফিসে সে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে সাত মাস আগে জয়েনিং করেছে৷ বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ক্লোথিং ব্র্যান্ড এটা। স্যালারি ভালো দেয়। সিইও সাহেব তাকে খুব পছন্দ করে৷ স্নেহ করে। ওনাকে বের করে দেওয়ায় মিরার ভারী মন খারাপ হলো। হাসি হাসি মুখের লোকটা কীভাবে অসৎ হতে পারে? তাহলে কী পৃথিবীর সবাই মুখোশধারী?

চলবে৷

[ “ফেইরিটেল” উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে সবাইকে স্বাগতম৷ আজকে এই অব্দি থাক৷ নতুন অতিথিকে কেমন লাগলো সবার? আস্তে-আস্তে সবটা ক্লিয়ার হবে। সবাইকে ভালোবাসা। সবার ঈদ কেমন কাটলো?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here