ফেরারি প্রেম পর্ব-৩৪

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৩৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“কাল রাতে তোর কী হয়েছিল মা? স্কুটিটা দেখে তুই এত ভয়ে পেয়ে গিয়েছিল কেন? কত শখের এই স্কুটিটা তোর বল? বিগত চার পাঁচ মাস ধরেই দেখছি স্কুটিটাকে তুই ধরেও দেখছিস না! কী হয়েছে তোর বল তো?”

স্কুটির কথা শোনা মাত্রই নীহারিকা তার নিজের মধ্যে ফিরে এলো। ঘুমের ঘোর কেটে গেল তার। অগোছালো দৃষ্টি ফেলল তার মায়ের দিকে। স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ক্রমশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। জায়গা থেকে খানিক নড়েচড়ে উঠল সে। কম্পিত গলায় তার মাকে বলল,

“স্কুটিটি কোথায় মা?”

নীহারিকার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে বিস্ময়ের মাত্রা আরও ছাড়িয়ে গেল মারজিনা বেগমের! বিচলিত হয়ে তিনি নীহারিকার মাথায় হাত বুলালেন। শঙ্কিত গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

“এই কী হয়েছে তোর? স্কুটির কথা শুনলে তুই এভাবে রিয়েক্ট করিস কেন? ক্ষণিকের মধ্যেই তোর রিয়েকশন এভাবে পাল্টে গেল কেন? কী লুকাচ্ছিস তুই আমাদের থেকে?”

তৎক্ষণাৎ হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল নীহারিকা। তুখোড় আতঙ্কিত ভাব তার মধ্যে বিদ্যমান। তার মায়ের কথারও কোনো প্রত্যুত্তর নেই তার কাছে। অপ্রত্যাশিতভাবে সে কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল! ওয়াশরুমের দরজা আটকে সে দরজার পেছনে পিঠ ঠেকালো। একনাগাড়ে কয়েকদফা রুদ্ধশ্বাস ফেলে আয়নায় তাকালো। বিস্তীর্ণ মুখমণ্ডল জুড়ে তার ঘামের ছিটেফোঁটা। কপাল থেকে গড়গড়িয়ে ঘাম ঝরছে তার৷ বিভৎস দেখাচ্ছে তাকে। এক পা দু’পা করে সে বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আয়নার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে হুট করেই ট্যাব ছেড়ে দিলো। চোখেমুখে পানি ছিঁটানো শুরু করল। পানি ছিঁটানো অবস্থাতেই সে বিচলিত গলায় বিড়বিড় করে বলল,

“যে করেই হোক আমাকে স্বাভাবিক হতে হবে। নিজের দুর্বলতা কাউকে বুঝানো যাবেনা! সবাইকে বুঝাতে হবে আমি নরমাল আছি। কিছু হয়নি আমার। আমিতো ব্রেইভ গার্ল! আমি কেন ভয় পাব হ্যাঁ? বুকে সাহস রেখে আমাকে সব পরিস্থিতি সামলে নিতে হবে।”

মুখে পানি ছিঁটানো শেষে নীহারিকা ভেজা মুখে পুনরায় তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেও সে স্বাভাবিক হতে পারছিলনা! দরজা ভেদ করে তার মায়ের গলার স্বর যদিও তার কর্ণকুহরে ভেসে আসছিল তবুও সে এই মুহূর্তে নীরব থাকার চেষ্টা করল। মিনিট কয়েক নিজেকে ধাতস্থ করার পর নীহারিকা ফট করে দরজা খুলে বের হয়ে এলো।চিন্তিত মারজিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে সে অবিশ্বাস্যভাবেই ফিক করে হেসে দিলো! তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“বি কুল মা! আমিতো তোমাদের ভয় দেখাচ্ছিলাম। এত ভয়ে পেলে চলবে বলো? বি স্ট্রং প্লিজ।”

তাজ্জব বনে গেলেন মারজিনা বেগম! বোকার মত তিনি নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে রইলেন। নির্বোধ গলায় শুধালেন,

“ভয় দেখাচ্ছিলি মানে? কাল রাতে যা যা হলো সব নাটক ছিল?’

“নাটক নয়ত কী? তোমার মেয়েকে আগে কখনও এভাবে ভয় পেতে দেখছ বলো? এসব তো আমার অভিনয় ছিল! মিস্টার রূপলকে ভয় দেখানোর জন্য!”

অমনি দরজার ওপাড় থেকে সব শুনে নিলো পিয়াসা! আড়ি পাতার জন্য সুযোগ বুঝে দাড়িয়ে ছিল সে! নীহারিকার মনগড়া কথাগুলো শুনে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তাৎক্ষণিক দরজা থেকে সরে দাড়ালো সে। ছুটে গেল তার রুমে। বিছানার উপর থেকে ফোনটি হাতে নিয়েই রূপলের নাম্বারে ডায়াল করল। নীহারিকার পেছনে লাগার আরও একটি সুযোগ পেল সে। এই সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চায়না সে।

ঐদিকে রূপল ব্যস্ত সজলের ক্লাস নিতে! কিছুটা নির্দয়ভাবেই রূপল উত্তপ্ত ছাদের উপরে কানে ধরে উঠ বস করাচ্ছিল সজলকে! দোলনায় বসে সে দোল খাচ্ছিল আর কাউন্ট করছিল এই নিয়ে কতবার তাকে কানে ধরে উঠ বস করানো হচ্ছে। পা দুটো ধরে আসতেই সজল অসহায় দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। চেহারাতে দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে রূপলকে বলল,

“ভাই আর কত? পা-দুটো তো অবশ হয়ে এলো। প্লিজ ভাই এবারের মত আমাকে মাফ করে দিন। বড়ো ভাই হয়ে ছোটো ভাইয়ের উপর এভাবে টর্চার করবেন?”

ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে রূপল সজলের দিকে তাকালো। আঙুলের ইশারায় সজলকে উঠ বস করতে বলল! ধীর গলায় বলল,

“১০৩! তারপর?”

“১০৪! কিন্তু ভাই আমি আর পারছিনা। তবে সেদিন কিন্তু আমার কোনো দোষই ছিলনা ভাই। আপনিই কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারেননি আমাকে! তাই আমিও না বুঝে ফট করে ভুলভাল কথা বলে ফেলেছি আপনাকে।”

“উঁহু। কথা বাড়াচ্ছিস কেন বল তো? ভাই বিরক্ত হচ্ছি তো! জানিসই তো পুরোনো পাগল আমি! মাথা গরম হয়ে গেলে নিজেকেও ছাড় দিইনা!”

ইতোমধ্যেই রূপল টের পেল তার পকেটে থাকা ফোনটি সাইলেন্ট মোডে কাঁপছে। পকেট থেকে ফোনটি বের করল রূপল। স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে দেখল পিয়াসার নাম্বার থেকে কল। তাড়াহুড়ো করে রূপল কলটি তুলল। মৃদু হেসে রূপল হ্যালো বলতেই পিয়াসা রাগে ফোঁসফোঁস করে বলল,

“তুমি কোথায় ভাইয়া?”

“বাসায়। কেন?”

“তুমি জানো নীহারিকা তোমার সাথে কী গেইম খেলেছে?”

নির্বোধ গলায় রূপল শুধালো,

“কী গেইম?”

“তোমাকে কাল রাতে বোকা বানিয়েছে সে!”

“কীভাবে?”

“সে আসলে কাল রাতে কোনো ভয় টয় পায়নি! তোমাকে হেনস্তা করার জন্য অভিনয় করেছে। এবার বুঝো এই মেয়ে কত শেয়ানা! আমিও তো বলি তার মত একটা দুঃসাহসী মেয়ে কীভাবে এতটা ভয় পেতে পারে! নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।”

“এক সেকেণ্ড এক সেকেণ্ড। তোকে এসব কে বলল?”

“কেউ বলেনি। আমি নিজের কানেই শুনেছি। মা আর মেয়েতে মিলে এসব বলাবলি করছিল। ভাগ্যিস আমি সব শুনে নিয়েছি। নয়ত তুমি এখনও একটা ট্রমার মধ্যে থাকতে।”

মাথায় যেন ফট করে আগুন ধরে গেল রূপলের! কলটা কেটেই সে রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগল। খালি গাঁয়ে ছাদে সচরাচর আসা হয়না তার। তবে আজ সজলকে শাস্তি দেওয়ার নেশায় সে এতটাই বুদ হয়েছিল যে নিজের দিকে তাকানোর সময়ই পায়নি সে! তাদের পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে একটি মেয়ে তাকে আড়চোখে দেখছিল ক্ষণে ক্ষণে। মুচকি মুচকি হাসছিলও তাকে দেখে! অনেকক্ষণ যাবত যদিও রূপল বিষয়টা খেয়াল করছিল তবুও সে একটু দেখতে চাইছিল মেয়েটি শেষ অবধি কী করতে চায়! মাথা গরম হয়ে যেতেই রূপল নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। পায়ের কাছে সে একটি ইটের কণা খুঁজে পেতেই ইটটি হাতে তুলে নিলো! জায়গা থেকে ওঠে এগিয়ে গেল ছাদের রেলিংয়ের দিকে। হঠাৎয়ের মধ্যেই সে ইটটি নিক্ষেপ করল পাশের বাড়ির ছাদে থাকা মেয়েটির দিকে! রাগে গজগজ করে বলল,

“ফা’ল’তু মেয়ে কোথাকার! খালি গাঁয়ে একটা ছেলেকে দেখে খুব মজা নিচ্ছিস তাইনা? এই তুই কোন ফ্ল্যাটে থাকিস? রুম নাম্বার বল? আমি আসছি। তখন কাছ থেকে দেখিস আমাকে। প্রয়োজনে প্যান্টও খুলে দিব!”

ইটটি যদিও মেয়েটির গাঁয়ে পড়েনি তবে রূপলের অদ্ভুত আচরণে মেয়েটি খুব অবাক হয়ে গেল। পাশাপাশি প্রচণ্ড ভয়ও পেয়ে গেল। ‘ওমাগো’ বলে চিৎকার করে সে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে গেল! রাগে রূপলের অবস্থা ধরাশায়ী। সামনের চুলগুলো টেনে ধরে সে পেছনের দিকে ঘুরতেই দেখল সজল দৌড়ে পালাচ্ছিল ছাদ থেকে। অমনি রূপল পেছন থেকে সজলকে ডাকল। মেজাজ হারিয়ে বলল,

“এই তুই কোথায় যাচ্ছিস? কাজ আছে শুনে যা।”

কপাল চাপড়ালো সজল! কাঁদো কাঁদো মুখে বিড়বিড় করে বলল,

“আজ আমারে খাইছে এই বদরাগী রূপল। নির্ঘাত ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবে আমাকে! যেখানে একটা অপরিচিত মেয়েকে ছাড় দেয়নি সে, সেখানে আমাকে ছাড় দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসছেনা! এই বান্দায় কী আবার পা’গল হয়ে গেল? যদি আমার সামনে প্যান্ট খুলে দেয়?!”

নখ কামড়াতে কামড়াতে সজল রূপলের দিকে এগিয়ে এলো। ভীরু দৃষ্টিতে সে রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। আস্ত একটি সিগারেট ধরিয়ে রূপল সজলের কাঁধে হাত রাখল। অস্থির গলায় বলল,

“আমাকে একটা হেল্প করতে পারবি?”

“কী হেল্প?”

“একটা মেয়েকে শায়েস্তা করতে হবে!”

“কোন মেয়ে?”

“পিয়াসার ননদ।”

“ঐযে নীহারিকা? বিশ্রী দেখতে মেয়েটা?”

কথাটা বলে সজল দম ফেলারও সময় পেলনা! সঙ্গে সঙ্গেই তার গালে ঠাস করে এক চড় পড়ল! পূর্বের তুলনায় আরও অধিক হিংস্র হয়ে উঠল রূপল! নীহারিকার অপমান তার সহ্য হলোনা। কেন হলোনা তার কোনো উত্তর নেই তার কাছে! চোয়াল উঁচিয়ে সে হতবাক সজলকে বলল,

“তোকে ছোটোভাই বলে স্বীকার করতেও এখন আমার লজ্জা করছে! তুই আমার ভাই হয়ে কী-না গাঁয়ের রঙ নিয়ে একটা মেয়েকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলি? আমরা তোকে এই শিক্ষা দিয়েছিলাম? ফারদার তুই আমার সামনে পরবিনা! নয়ত খবর আছে তোর।”

সজলকে হুমকি দিয়ে রূপল ছাদ থেকে প্রস্থান নিলো। হতভম্ব হয়ে সজল রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। হঠকারী গলায় বলল,

“ঐ মেয়ের প্রতি এত টান ভাইয়ার? তাকে বেড কমেন্টস করাতে তার ছোটো ভাইয়ের গাঁয়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করলনা?”

______________________________________

অতিরিক্ত ঝাল খেতে খেতে নীহারিকার চোখ থেকে টলটলিয়ে পানি ঝরছিল! তবুও ফুচকা খাওয়া বন্ধ করছেনা সে। এছাড়াও তো আর কোনো উপায় নেই তার হাতে! কারণ, তার সামনেই হিংস্র রূপ নিয়ে বসে আছে রূপল! দশ প্লেট থেকে আরও পাঁচ প্লেট ফুচকা খাওয়া বাকী আছে তার। কিন্তু তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছেনা এত ঝালযুক্ত ফুচকাগুলো খাওয়ার। রীতিমত হাঁপিয়ে উঠছিল সে। গাঁ থেকেও ঘাম ঝরছিল। এসব দেখে যেন রূপল পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছিল! তার মনস্কামনা পূর্ণ হচ্ছিল। মোটামুটি ভাবে চলে এলো সে। তুড়ি মেরে সে নীহারিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। গলা খাঁকিয়ে বলল,

“কী মিস নীহারিকা? আরও কয়েক প্লেট অর্ডার করব না-কী? আপনার জন্য আজ আমার জেব খালি করতেও কোনো অসুবিধা নেই!”

চোখে জল এবং মুখে ফুচকা নিয়ে নীহারিকা মাথা দুলিয়ে না বুঝালো। দেঁতো হাসল রূপল। ভ্রু উঁচিয়ে নীহারিকার দিকে তাকালো। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

“কেমন লাগছে আমার শাস্তি? টেন আউট অফ টেন?”

“একদম ঝাক্কাস! ফার্স্ট ক্লাস! টেন আউট অফ টুয়েন্টি।”

“তবুও নত হবেন না আপনি?”

“নাহ্! কারণ আমি চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করতে পছন্দ করি!”

রেগে গেল রূপল। দাঁতে দাঁত চেপে সে নীহারিকার দিকে এগিয়ে এলো। উগ্র মেজাজ নিয়ে বলল,

“এটা কোনো চ্যালেঞ্জ নয় ওকে? এটা হলো আপনার মিথ্যে বলার শাস্তি! আমাকে হেনস্তা করার শাস্তি।”

“ফুচকা খাওয়া মেয়েদের জন্য কখনও শাস্তি হতে পারেনা! বরং এটা হলো আমাদের জন্য আরাম।”

পুনরায় ব্যগ্র হাসল রূপল। আগ্রাসী দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। ডানপিটে গলায় বলল,

“আরামটাই পরে বেরাম হয়ে বের হবে! দেখুন না বাড়িতে যাওয়ার পর ঠিক কী কী হাল হয় আপনার। রূপল কী চিজ তা বাড়ি যাওয়ার পর বুঝবেন।”

#চলবে…?

[ইদের ব্যস্ততার জন্য আসলে গল্প লিখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আজও বাড়িতে অনেক মেহমান। ঘড়ি ধরে গল্প লিখতে হয়েছে। রি-চেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here