ফেরারি প্রেম পর্ব-৪৫

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৪৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“হোয়াই নট? আপনি যেমন আমার দুঃসময়ে পাশে ছিলেন, আমি কেন আপনার দুঃসময়ে পাশে থাকব না? থ্যাংকসটা আমি এই সময়ের জন্য হয়ত তুলে রেখেছিলাম! ইকুয়েল ইকুয়েল করব বলে।”

রূপলের নিবিড় দু’চোখে তাকিয়ে নীহারিকা স্বস্তির আভাস খুঁজে পেল। তবে এরমধ্যে নীহারিকা বেশ ভালোভাবেই খেয়াল করল, রূপলের দৃষ্টি যেন আজ কিছুতেই সরছে না তার থেকে! বরং তাকে চাওয়ার গভীরতা যেন ক্রমশ বেড়েই চলছে! এর কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা নীহারিকা। তাই ব্যাপারটায় ভীষণ অবাক সে। বিস্ময় কাটাতে রূপলকে এই সম্বন্ধে প্রশ্ন না করলেই নয়। যেই ভাবা সেই কাজ। গলা ঝাকিয়ে নীহারিকা রূপলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। আগ্রহী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“হেই রূপল? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কী হয়েছে আপনার?”

নীহারিকার ঘোরে ডুবে থেকেই রূপল হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলল,

“হয়ত প্রেম রোগে ধরেছে আমায়!”

তাজ্জব হয়ে গেল নীহারিকা। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হলো রূপলের দৃষ্টি এখনও তার দিকেই সীমাবদ্ধ! আচমকা শুকনো ঢোক গিলে সে নির্বোধ গলায় শুধালো,

“সিরিয়াসলি? কার প্রেমে পরেছেন আপনি?”

“আপনার প্রেমে তো ভুলেও নয়! সো ডোন্ট ওরি! এখানে প্রেমে পরার মত আরও সুন্দর সুন্দর জিনিস আছে!”

বেশ ভাব নিয়ে কথাগুলো বলল রূপল! বসা থেকে সোজা দাড়িয়ে গেল। অবিলম্বে নীহারিকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে শার্টের কলারটা ঠিক করতে করতে এদিক ওদিক তাকালো। যেন নীহারিকাকে চিনেই না এমন একটা ভাব নিলো! ঠোঁটে হাসির লেশমাত্র ও নেই তার। গম্ভীর ভাব ফুটে উঠেছে মুখের সর্বত্র। রূপলের এই আকাশচুম্বী ভাব দেখে রাগে গাঁ রি রি করে উঠল নীহারিকার। সেও বসা থেকে দাড়িয়ে গেল। রূপলের মুখের কাছে আঙুল তুলে সে দাঁতে দাঁত চেপে রূপলকে শাসিয়ে বলল,

“যদিও আমার প্রেমে পরেন না? আমি কিন্তু আপনাকে পাত্তা দিবনা! পরিবারের ঠিক করা ছেলেকেই বিয়ে করব।”

সঙ্গে সঙ্গেই নীহারিকার আঙুলটা মুচড়ে ধরল রূপল! ভাবশূণ্য দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকালো। দাঁত গিজগিজিয়ে বলল,

“যদিও আমি আপনার প্রেমে পরি। তাহলে আপনি কেন আমাকে বিয়ে করবেন না? লেট মি আনসার?”

আঙুল মুচড়ে ধরে রাখায় ব্যথায় নীহারিকা ছটফট করতে লাগল। তবে মুখে তা প্রকাশ করলনা। এই তুচ্ছ ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা সে রাখে তা বুঝাতে চাইল রূপলকে। অসহ্যকর দৃষ্টিতে নীহারিকা এবার রূপলের দিকে তাকালো। রাগী গলায় বলল,

“কারণ অতিরিক্ত সুদর্শন ছেলেদের চরিত্রের ঠিক থাকেনা! ক্যারেক্টারলেস হয়। আমি যেমন কালো তেমনি কালো ছেলেকেই বিয়ে করব! কেউ কাউকে ঠকানের সম্ভাবনা থাকবেনা।”

“এসব ভুয়া লজিক আপনাকে কে শেখায়? গাঁয়ের রঙে মানুষের চরিত্র বুঝা যায়? কোন জ্যোতিষির কাছ থেকে এই অবাস্তব কথা শুনেছেন?”

“যা আমার নিজের জীবনের সাথে ঘটে গেছে তা আমি অন্যের কাছ থেকে শিখব যাব কেন? শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, বরং আমার পরিচিত অনেক কাছের মানুষদের সাথে এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে। সুন্দর পুরুষদের নারীদের প্রতি লোভ থাকে বেশী! তারা মেয়েদের মন নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। আমি আমার জীবন থেকে যতটুকুনি উপলব্ধি করতে পারলাম আপনাকেও ঠিক ততটুকুনিই বললাম।”

নীহারিকার আঙুলটা ছেড়ে রূপল নিজের রাগকে সংযত করার চেষ্টা করল। ঠাণ্ডা মাথায় সে নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ওকে ফাইন। আগে আপনি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো। হাতের পাঁচটা আঙুল-ই কী সমান?”

ব্যথা নিয়ে আঙুলটা ঘঁষতে ঘঁষতে নীহারিকা ঠোঁট উল্টে রূপলকে বলল,

“না। বাট পৃথিবীর সব সুদর্শন ছেলেরা খারাপ হয়! তার মধ্যে আপনিও একজন!”

“ওহ্ রিয়েলি? আমিও আপনার চোখে খারাপ? তা কী খারাপ কাজ করেছি আমি আপনার সাথে? কাম অন টেল মি?”

“সেদিন রাতের কথা মনে নেই? আপনি আমার গালে চুমু খেয়েছিলেন!”

রাগী ভাবমূর্তি পাল্টে ব্যগ্র হাসল রূপল। আপত্তি কর ভঙ্গিতে নীহারিকার দিকে এক কদম এগিয়ে এলো। ডানপিটে গলায় বলল,

“হ্যাঁ তো? গালেই তো চুমু খেয়েছি। ঠোঁটে তো খাইনি! তবে নেক্সট টাইম ঠোঁটে খাব! আমি তো এমনিও খারাপ অমনিও খারাপ! সো খারাপ কাজ করেই না হয় খারাপ হলাম।”

অমনি নীহারিকার ঠোঁটে হাত চলে গেল। বড়ো বড়ো চোখে সে রূপলের দিকে তাকালো! রূপলের ব্যবহার আচরণে সে হতবাক না হয়ে পারলনা। দিন দিন এ কী অবনতি হচ্ছে রূপলের? এজন্যই বুঝি পুরুষ লোকের সঙ্গ এত খারাপ? বেলেহাজ কথাবার্তা বলতেও তাদের মুখে আটকায় না? নীহারিকার ভয়ার্ত এবং চুপসে যাওয়া মুখখানি দেখে ভেতরে ভেতরে রূপলের বেশ পাশবিক আনন্দ হচ্ছিল! তবে উপরে সে বেশ গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। প্যান্টের পকেটে হাত গুজে ভাবে ডুবানো গলায় বলল,

“নেক্সট টাইম আমাকে খারাপ বলার আগে দুইবার ভাববেন ওকে? যখনি আমি নোটিশ করব আপনি আমাকে খারাপ ভাবতে শুরু করেছেন তখনি কিন্তু আমি আপনার ঠোঁটে….

কথার মাঝখানে রূপলকে থামিয়ে দিলো নীহারিকা! রূপলের ঠোঁট কাটা কথা তার একদমই সহ্য হচ্ছিলনা! গাঁয়ে কাটা দিচ্ছিল। অদ্ভুত সুন্দর এক অনুভূতি হচ্ছিল! যে অনুভূতি তার হৃদয়কে অস্থির করে তুলছিল। বেশীক্ষণ এই অস্থিরতা তার মধ্যে কাজ করতে থাকলে জ্ঞান হারাতে বেশী সময় লাগবে না তার। তাই নীহারিকা রূপলকে উপেক্ষা করৱ। নদীর ঘাট পাড় হয়ে সে সামনের দিকে হাঁটা ধরল। রূপলও নীহারিকার পিছু নিলো। প্রসঙ্গ পাল্টাতে নীহারিকা অস্থির হয়ে উঠল। পিছু ঘুরে তৎপর দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো। নিশ্বাস হীন গলায় বলল,

“আমাদের এখন রহস্য উদঘাটন করতে হবে মিস্টার রূপল! সবিতা আপুর বাসায় যেতে হবে। প্লিজ হারি আপ।”

“ওহ্ নো! আবার মিস্টার রূপল কেন? রূপলই তো ঠিক ছিল!”

ভ্রু যুগল কুচকে এলো নীহারিকার। কপালেও কয়েক দফা ভাজ পরল। সন্দেহের দৃষ্টিতে সে পিছু ফিরে রূপলের দিকে তাকালো। কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“এই? আপনি কী আমার সাথে লাইন মারার চেষ্টা করছেন?”

গাঁ ছাড়া ভাব নিলো রূপল। পুনরায় প্যান্টের পকেটে হাত গুজল। জবাবে নীহারিকাকে রাগানোর জন্য বলল,

“লাইন তো আপনি আমাকে মারার চেষ্টা করছেন! আমার মনকে বার বার….

এরমধ্যেই ভীড়ের মাঝখানে কেউ এসে নীহারিকার গাঁয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে সোজা হেঁটে চলে গেল পার্কের গেইটের দিকে। পুরুষালি শরীরের ধাক্কা। বেশ শক্তপোক্ত এই ধাক্কা। ব্যথায় উহ্ করে উঠল নীহারিকা। কথা বলা থামিয়ে দিলো রূপল। ভ্রু যুগল কুঁচকে সে লোকটির যাওয়ার পথে তাকালো। শূণ্য গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ব্যথা পেয়েছেন?”

“সামান্য।”

ফট করে রূপলের মাথায় কিছু একটা কাজ করল। অস্থির হয়ে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গেই লোকটির পিছু নিলো সে! অবাক হয়ে নীহারিকা দৌঁড়োতে থাকা রূপলের দিকে তাকিয়ে রইল। এক পর্যায়ে সেও রূপলের পিছনে দৌড়াতে লাগল। উৎকণ্ঠিত গলায় রূপলকে শুধালো,

“হেই রূপল? কী হয়েছে? আপনি হঠাৎ দৌড়চ্ছেন কেন?”

দৌড়ানো অবস্থাতেই রূপল পিছু ফিরে রাগী গলায় নীহারিকাকে বলল,

“হাউ স্ট্রেঞ্জ নীহারিকা। লোকটা আপনার গাঁয়ে আস্ত একটা সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে দিল আর আপনি টের ও পেলেন না? অ্যানি হাউ আপনি তাড়াতাড়ি মেডিকেলে যান। ডক্টরকে বলুন কিছু একটা করতে। ড্রাগসের প্রভাব যেন আপনার শরীরে ছড়িয়ে পরতে না পারে তার আগে।”

দৌড়ে কিছুদূর যেতেই রূপল কালো হুডি পরা লোকটিকে পার্কের গেইটের বাইরে দেখতে পেল! প্যান্টের পকেটে হাত গুজে লোকটি বেশ নিশ্চিত রূপে দাড়িয়ে আছে। সাধারণ মানুষদের সাথে বেশ স্বাভাবিকভাবেই মিশে গেছে লোকটি। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সবেচেয় সরল, সোজা খুবই নির্বোধ লোক একমাত্র তিনি! লোকটির পাশে শান্ত এবং স্থিরভাবে দাড়ালো রূপল। তব্ধ শ্বাস ফেলে সে পাশ ফিরে ধীর গলায় লোকটিকে বলল,

“হায় ইয়াং ম্যান!”

সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি পাশ ফিরে রূপলের দিকে তাকালো। নীহারিকা এতক্ষণ রূপলের পাশেই দাড়িয়ে ছিল। হুডির ভেতর থেকে লোকটি চোখ তুলে রূপলের দিকে তাকাতেই নীহারিকার চোখের সামনে লোকটির চেহারা ভেসে উঠল! সঙ্গে সঙ্গেই নীহারিকা অস্থির হয়ে উঠল। জায়গা থেকে প্রস্থান নিয়ে সে রাস্তায় গাড়ির সন্ধান করতে লাগল। ব্যস্ত গলায় রূপলকে বলল,

“এই লোকটিই সেই লোক রূপল! প্লিজ তাকে ক্যাচ করুন। আমি হসপিটালে যাচ্ছি।”

উত্তেজিত হয়ে যেইনা লোকটি ছুটে পালাতে যাবে অমনি রূপল পেছন থেকে লোকটির হুডির মাথা টেনে ধরল! বল না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি দাড়িয়ে গেল। টানতে টানতে রূপল লোকটিকে নিয়ে একটি জনমানবহীন নিরিবিলি জায়গায় দাড়ালো। আক্রোশ ভরা দৃষ্টিতে লোকটি রূপলের দিকে ফিরে তাকিয়ে রইল। যেন এক্ষণি রূপলকে আস্ত চিবিয়ে খাবে!অমনি রূপল অট্ট হেসে দিলো! মুহূর্তেই সেই হাসি তার ভয়ঙ্কর রূপ নিলো! হাসির মধ্যেই সে হিংস্রতা ফুটিয়ে তুলে লোকটিকে বলল,

“খুবই সস্তা প্ল্যানিং তোর! একই প্ল্যান বার বার কাজে লাগানোটা কখনও মাস্টারমাইন্ডের কাজ হতে পারেনা! তুই হয়ত ভুলে গেছিস নীহু খুবই ধূর্ত মেয়ে! সে ধরে ফেলেছে তোর চালাকী। তা না বুঝেই তুই দ্বিতীয়বার একই প্ল্যান কাজে লাগালি। আর ধরাও পরে গেলি। সো স্যাড অফ ইউ ইয়ার।”

বলেই রূপল লোকটির নাক বরাবর জোরে এক ঘু’ষি মারল! সঙ্গে সঙ্গেই লোকটির নাক থেকে গড়গড়িয়ে র’ক্ত ঝরতে লাগল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এত অসহনীয় ব্যথা পাওয়ার পরেও লোকটি মুখ থেকে কোনো আর্তনাদ প্রকাশ করলনা! শুধু তাই নয় তার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হচ্ছেনা। রূপলকে শাসাচ্ছে না, হুমকি-ধমকি দিচ্ছেনা। এমনকি নিজের পক্ষে সাফাইও দিচ্ছেনা! ব্যাপারটায় ভীষণ অবাক হলো রূপল। হুডির কলার চেপে ধরে সে লোকটিকে এনে তার মুখোমুখি দাঁড় করালো। চোয়াল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী হলো? তুই চুপ করে আছিস কেন? নিজের পক্ষে কিছু বলবি না? আমাকে হুমকি দিবি না?”

লোকটি তবুও চুপ রইল! কেবল রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকল। মুখ থেকে বের হয়ে আসা রক্ত গুলো সে থু থুর মাধ্যমে ফেলতে লাগল। ভ্রু উঁচিয়ে রূপল এবার থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“এই তুই কী বোবা?”

অমনি লোকটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো! হতবিহ্বল হয়ে রূপল লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রশ্ন ছুড়ল,

“সবিতাকে তুই চিনিস?”

লোকটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো! পুনরায় উদ্যমী গলায় রূপল প্রশ্ন ছুড়ল,

“সবিতা এখন কোথায় আছে তুই জানিস?”

লোকটি আবারও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো! উত্তেজিত হয়ে উঠল রূপল। লোকটির কলার ধরে টানতে টানতে সে লোকটিকে নিয়ে রাস্তায় চলে এলো। ঝাঁজালো গলায় লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল,

“তুই এক্ষণি আমাকে সবিতার কাছে নিয়ে যাবি! সকাল থেকেই তাকে আমি ফোনে পাচ্ছিনা। মনে হয়না সে বাড়িতেও আছে বলে। ইদানিং তাকে বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়না। হৃদিকেও কাল রাতে সবিতা আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে। আমি আমার ভাইজির ব্যাপারে কোনো কম্প্রোইজ করব না!”

#চলবে..?

[আগামী পর্বেই রহস্যের জট খুলে দেওয়া হবে। পরীক্ষা চলছে তাই লেইট হচ্ছে গল্প দিতে। আশা করি আপনারা আমার সমস্যাটা বুঝবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here