ফেরা পর্ব-১

0
2251

#ফেরা

কখনো অতীতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ হলে, আপনি কী করবেন? ভুল গুলো শুধরে নিবেন? নাকি হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোর সাথে বেশি সময় কাটাতে চাইবেন? আমি ঠিক জানিনা আপনি কী করবেন। কিন্তু শাহাজাদী কোন অপশন বেছে নিবে? বলতে পারবেন?

১.

ক্লাসরুমে লাস্ট বেঞ্চ বাদে কোথাও কোনো সিট ফাঁকা না পেয়ে শাহাজাদীকে লাস্ট বেঞ্চে বসতে হলো। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত কেউই তাকে লাস্ট বেঞ্চে বসতে দেখেনি।পুরো ক্লাস অবাক চোখে শাহাজাদীর দিকে তাকিয়ে আছে। নিধি প্রায় ধমকে উঠে বললো
– এখানে কি সার্কাস নাকি যে তোরা হা করে তাকিয়ে আছিস?
রত্না বিদ্রুপ করে বললো
– ফার্স্ট বেঞ্চে বসা ম্যাডাম যদি লাস্ট বেঞ্চে বসে তখন সেটা সার্কাসের পর্যায়ে পড়ে যায়না?
– ক্যান লাস্ট বেঞ্চে লেখা আছে নাকি যে ওখানে বসলেই সার্কাসের পর্যায়ে চলে যায়?
– লেখা না থাকলেও আজকে আমি লিখে দিবো।
ফারিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বললো
– ভোরের পাখি আজকে রাতের পাখি হয়ে গেলো!
পুরো ক্লাসের মেয়েরা হাসতে শুরু করলো ফারিয়ার কথায়।
নিধিকে কথা বাড়াতে নিষেধ করে শাহাজাদী বেঞ্চের উপর মাথা রেখে চোখ বুজলো।
ক্লাস সিক্স থেকে নাইন পর্যন্ত সে সবার আগে ক্লাসে এসে ফার্স্ট বেঞ্চের সিট দখল করেছে। রত্না অনেক চেষ্টা করেও ওই বেঞ্চে বসতে পারেনি। কিশোরী বয়সী মেয়েদের মাঝে খুবই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া, মনোমালিন্য হয়। শাহাজাদীর সাথে ক্লাসের সবারই এই মনোমালিন্য চলছে প্রায় তিন বছর ধরে একমাত্র নিধি বাদে। নিধি মোটামুটি ধরনের স্টুডেন্ট আর শাহাজাদী মেধাবীদের অন্যতম। নিধির চরিত্রে চাঞ্চল্য যেমন প্রধান বৈশিষ্ট্য, শাহাজাদীর বৈশিষ্ট্য স্থিরতা। অমিলই তাদের মাঝে সবচেয়ে মিলে যাওয়ার বিষয়। এদের মধ্যে ফ্রেন্ডশিপ হওয়াটা অসম্ভব তারপরও হয়ে গেছে।
নিধি শাহাজাদীর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো
– কীরে শাজু, চিঠি পড়েছিস?
শাহাজাদী মাথা তুলে লাজুক স্বরে বললো
– হুম।
শাহাজাদী তখনও চোখ বুজে আছে। নিধি বললো
– চিঠিটা দে। আমিও পড়বো। কী এমন লিখেছে যে আমার শাজু লাজে রাঙা হয়ে যাচ্ছে।
– অন্যের চিঠি পড়তে নেই।
– তুই আবার অন্য কবে হলি? আমি আর তুই তো একই তো।
– আমি লজ্জায় তোর সামনে পরে আসতে পারবো না।
– আরে বেকুব। চিঠিটা তো আমিই তোকে এনে দিলাম। পারলে তো ওইসময় পড়ে তারপর তোকে দিতে পারতাম।
– তাহলে বাড়ি ফেরার পথে তোকে দিবো। তবে প্রমিজ কর কাউকে বলবি না!
– এতোদিনে এই চিনলি আমাকে?
নিধি অভিমান করে বললো।
– আচ্ছা চিঠিটা তোকে কীভাবে দিলো?
– ক্লাসে এতো কিছু বলা যায়না।
– তাহলে আজকে সন্ধ্যার পরে বাসায় আসিস। আম্মুর মিটিং আছে, আসতে দেরি হবে।
– চিঠিটা দে।
– বললামই তো এখন না।
– দোস্ত, তুই হ্যাঁ বলবি তো?
শাহাজাদী দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখলো। নিধি ভেবে নিলো পজিটিভ কিছু হবে।
প্রথম ক্লাসের ঘণ্টা বাজার ৫ মিনিটের মধ্যে লিপি খন্দকার ক্লাস নেয়ার উদ্দেশ্যে আসলেন। সামনের বেঞ্চে শাহাজাদীকে না দেখতে পেয়ে রত্নাকে জিজ্ঞেস করলেন
– শাহাজাদী আসেনি?
– জ্বি, ম্যাম এসেছে।
আঙ্গুল দিয়ে শাহাজাদীকে দেখিয়ে দিয়ে বললো
– ম্যাম, আজকে ওর দেরি হয়েছিলো তাই লাস্ট বেঞ্চে বসতে হয়েছে।
লিপি খন্দকার কিছুই বললেন না। নাম ডাকা শেষ করে ক্লাসে মন দিলেন।
শাহাজাদীর আজকে ক্লাসে মন আসছেনা। চিঠির শব্দগুলো চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। গতরাত থেকে সকাল পর্যন্ত কমপক্ষে ২১ বার চিঠিটা সে পড়েছে আর লজ্জায় লাল টকটকে হয়ে মুখ লুকিয়েছে দু’হাতের মধ্যে।
তার এই ১৫ বছরের জীবনে প্রথম প্রেম পত্র। কিশোরী বয়সী মেয়েদের আবেগটা একটু বেশিই থাকে। ভালোবাসা বলতে শুধু অবিরাম একটি সম্পর্কে জড়ানোকেই বুঝায় না। সেখানে বিভিন্ন রাসায়ন, নিউরন এবং হরমোন অনুক্রমে একসঙ্গে কাজ করে যা আমাদেরকে অন্য কারো প্রতি আসক্ত হতে সাহায্য করে। তার ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে। মাই ব্রেস্ট’ এর একদল গবেষকদের একটি ইনফোগ্রাফিক তৈরি করেছেন যাতে ভালোবাসার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যে, এই প্রক্রিয়ার সময় আমাদের মন ও দেহে কি ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
তারা ডেইলি মেইলকে বলেন, ‘প্রেম একটি শক্তিশালী আবেগ যা সর্বজনীনভাবে মানুষের দ্বারা অনুভূত হয়। তা সত্ত্বেও আমাদের এই অনুভূতির কারণ সবচেয়ে রহস্যময় এবং এখনো অধরা রয়ে গেছে আমাদের কাছে। তবে আমরা একবার স্ক্র্যাচ করে আমাদের মনের ইচ্ছা, প্রেম এবং অন্যের প্রতি মোহ বা টান অনুভব করার পেছনে একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছি।’
‘শরীরের হরমোন এবং অণুর সমন্বয় সম্পর্কের তিনটি পর্যায়-কাম, আকর্ষণ এবং সংযুক্তি, যা আমাদের প্রেমে গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে। এবং প্রতিটি ধাপেই আলাদা আলাদা রাসায়ন কাজ করে যা আমাদের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার পিছনে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।’
গবেষকদের মতে, ইতিহাসের প্রতিটি প্রেম কাহিনি রাসায়নিক ডোপামিন দিয়ে শুরু হয়েছিল যা মস্তিষ্ক ও অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি হতে উৎপাদিত হয়।
কিন্তু এতসব জটিল বিষয় তার মাথায় আপাতত নেই। হয়তোবা ভবিষ্যতে কখনো প্রেমের প্রতি বিরক্ত হয়ে, আবেগকে হরমোন দিয়ে চালিয়ে দেবে। তার শুধু এটুকু জানা আছে যে, ” প্রথম বসন্ত উঁকি দিচ্ছে তার জীবনে। ”
ক্লাসে অমনোযোগী বিষয়টি লক্ষ্য করে নিধি, শাহাজাদীর হাতে চিমটি কেটে বললো
– ক্লাসে মন দে, তা নাহলে বিপদ!
মুচকি হেসে ক্লাসে মন দেয়ার চেষ্টা করলো।
শাহাজাদী নামটা বেশ বড় হওয়ায় প্রায় সবাই তাকে শাজু বলেই ডাকে। টিফিন পিরিয়ডে নিধি শাজুকে বললো
– আজকে ম্যাথটা ঠিক বুঝলাম না। স্যার এসে কীভাবে কী বললো আর করলো। তারপর চলে গেলো।
শাহাজাদী বললো
– বাসায় আসিস আমি বুঝিয়ে দিবো।
বাসায় ফেরার পথে মগবাজার মোড়ে জ্যামে পড়তে হলো। জ্যাম শব্দটার সাথে সে অভ্যস্ত কিন্তু ভালো লাগেনা। ছোটো বেলা থেকে এই জ্যামের শহরে বেড়ে ওঠা।
মন খারাপ থেকে শুরু করে ভালো লাগা সবকিছুই এই জ্যামের শহরের আকাশটার কাছেই বলে দেয় শাজু। আকাশটাই তার সকল সুখ দুঃখের সাথী। পনেরো মিনিটের জ্যামে আটকে থাকার পরে বাসায় পৌঁছে যেন শান্তি পেলো শাজু।
স্কুল ড্রেস খুলে গোসল সেরে নিলো। চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটোর দিকে তাকিয়ে হাসলো শাজু। গতকাল ইংরেজি প্রাইভেট শেষ করে ফেরার পথে নিধি ওর ডান হাতের মুঠোর মধ্যে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে বললো
– যাও চান্দু বাসায় গিয়ে আস্তেধীরে লুকিয়ে পড়ে নিও।
শাজু কিছু একটা বলতে যাবে আর তখন পিছন থেকে সঞ্চয় এসে সাজুর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। শাজু অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললো
– কিছু বলবেন?
সঞ্চয় হাঁপাতে হাঁপাতে বললো
– শাহাজাদী…..
– হ্যাঁ…
– মানে বলতে চাচ্ছিলাম আর কী মানে…..
নিধি বিরক্ত হয়ে বললো
– যা তোর কিছু বলতে হবেনা।
সঞ্চয় আহত স্বরে বললো
– শাহাজাদী ওভাবে তাকিয়ে থেকো না লজ্জা লাগে!
শাজু লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে এলো। সঞ্চয় ছেলেটার সাথে আজকেই প্রথম কথা হলো। আর কীভাবে অপমান করলো তাকে!

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here