#ফেরা
২২.
বাড়ির পেছনে বাঁশ ঝার আছে তার পাশেই তাহিরা বিশাল ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে। মনো খুঁজতে খুঁজতে বাঁশ ঝারের কাছে আসতেই ভয়ে চমকে উঠলেন। তিনি জানতেন তাহিরা এখানেই থাকবে৷ কিন্তু এভাবে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে সেটা ভুলেও ভাবেন নি৷ আয়াতুল কুরসি পড়ে শরীর বন্ধক দিয়ে তাহিরার কাছে গিয়ে বললেন, ” এখানে কী করছিস?” তাহিরা ঘোমটার ভেতর থেকে মুখ বের করে বলল, ” ঘরে যেতে মন চাচ্ছে না। ”
” তাহলে মামুন কি একা ঘুমাবে?”
” উনার তো আজকে আসার কথা না। ”
” ওর যখন ইচ্ছা তখন আসবে। তোর দায়িত্ব তুই পালন করবি৷ ঢং করা বন্ধ কর। চল আমার সাথে। ” কথা শেষ করে হাত ধরে টেনে নিজের শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন।
” একটা ভালো শাড়ি তো পরতে পারতি। কীসব পরছিস! নতুন জামাইয়ের সামনে এভাবে কেউ যায়। ভাগ্যিস তোর চাচা বাসায় নাই। তাইলে আমারে রাগারাগি শুরু করতো। ” তাহিরা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার শোবার ঘরে যাওয়ার ইচ্ছা জাগছেই না। সঞ্চয়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস ভেতরে নেই। এদিকে চাচী তাকে ঘরে না পাঠিয়ে শান্ত হবেন না৷
” চাচী আজকের রাতটা মিনা আপার ঘরে ঘুমাই? আগামীকাল না হয়.. ” মনো আলমারি খোলা রেখে তাহিরার কাছে এসে কান টেনে ধরে বলল, ” কেনো? কী হইছে তোর? মাসিক চলে নাকি? জামাইরে খুলে বলবি৷ সমস্যা কোথায়?”
” না চাচী, মাসিক না। ”
” তাহলে আর কোনো অজুহাত দিবি না। আমি যা বলবো চুপচাপ করবি। একটা কথা বলবি তো কান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। ” চাচীর কথা তার মনে হয় না কানে গেল। বিরবির করে বলল, ” আমি ওই ঘরে আজকে যাবো না। ” মনো রাগ সামলাতে না পেরে বেশ জোরেশোরে চড় দিয়ে বসলেন। তাহিরার মনে হলো পুরো শরীর কেঁপে উঠেছে।
” আর একবার না বলে দ্যাখ৷ আমি তোর কী করি! বহুত কষ্ট করে তোকে এতো সুন্দর আর ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিছি। এখন যদি কোনো ঝামেলা করোস তাহলে তোর সাথে আমি জীবনে কথা বলবো না। মনে রাখিস?” এমন চড় আর হুমকি শোনার পরে আর না বলার সাহস পেল না তাহিরা।
মনো নিজের একটা টাঙ্গাইল শাড়ি বের করে তাহিরাকে তার মতো করে পরিপাটি করে দিলেন। তারপর নিজে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসলেন৷ তাছাড়া উপায়ও ছিলো না। যদি আবার পলায়? তখন তো তার মাথায় হাত হয়ে যাবে। এমনিতেই কয়েকদিন যাবত হাঁটুর ব্যথা বেড়েছে। এই অবস্থায় হাঁটা চলা করাও কষ্টের ব্যাপার। তাহিরা ঘরে ঢোকার পরে কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। দরজা ভেতর থেকে আটকানোর শব্দ পাওয়ার পরে ফিরে এলেন। এখন একটু চিন্তা মুক্ত লাগছে নিজেকে। মুক্তার কথা মনে পড়ে গেল। সে থাকলে হয়তোবা আরো ভালো আপ্যায়ন করতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ জীবন টা এমনই নাকি। সবাই সবার মতো চলতে থাকে। আর যে হারিয়ে যাওয়ার হারিয়ে যায়।
****
ঘরে ঢুকেই তাহিরা কী করবে বুঝতে পারছে না। সঞ্চয় তার টেবিল চেয়ার জুড়ে বসে আছে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে বই বন্ধ করে দিল।
” পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে কেন?” সঞ্চয়ের প্রশ্নে কিছু একটা বলা প্রয়োজন। সত্যিটা বলা যাবেনা৷
” আপনার পরীক্ষা তাই বিরক্ত করতে চাচ্ছিলাম না। ”
” শাজু, কেমন আছ?” পুরোনো এই নাম শুনে আৎকে উঠলো তাহিরা৷ দ্রুত সঞ্চয়ের কাছে গিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, ” এই নামে ডাকবেন না। কেউ শুনতে পারলে আমার রক্ষে হবে না। এই নাম আপনাকে বলা নিষিদ্ধ। ”
সঞ্চয়ের মনে হলো শাজু তার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে না। সেদিন তো কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। আজকে কী হলো আবার?
চেয়ারে বসা অবস্থায় শাজুর কোমড় দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথা বুকের উপর রেখে বলল, ” পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে কেন? সত্যিটা বলো। আমি রাগ করবো না। ”
” সাহস পাচ্ছিলাম না৷ ”
” আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি। ” শাজুর বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটানোর মতো শব্দ হচ্ছে। সেদিন তো এমন ছিলো না৷ সেদিন তার ভেতরে শান্ত ভাব ছিলো।
সঞ্চয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়ার অনেক ইচ্ছা তাহিরার ছিল। কিন্তু কখনো সেটা করার সুযোগ তার হয়নি৷ হাত চিরুনির মতো চুলের মধ্যে চালিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল, ” সঞ্চয়, কেমন আছেন? ”
এই মানুষটা কি সত্যিই তার? নাকি এটা অল্পকিছু সময়ের জন্য! তার মা’কে সে কী উত্তর দিবে?
” তুমি আমাকে ভুলে গেছ তাই না?”
” এটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর না। ”
” তুমি কি বুঝতে পারছ না, আমি কেমন আছি?”
” না, আমার অনুভূতি শূণ্য অবস্থা। আপনার তো আমার সাথে থাকার কথা না। ”
” শাজু, আমরা এখন স্বামী – স্ত্রী। প্রেমিক প্রেমিকা নই৷ ”
” আপনি আগের তুলনায় অনেক সুন্দর হয়ে গেছেন। আর আমি হয়েছি কুৎসিত। ”
” তোমার শরীরের গন্ধটা সুন্দর। অসম্ভব সুন্দর । তোমাকে ছেড়ে একা কীভাবে থাকবো সেটাই বুঝতে পারছি না৷ ” শাজুর আবোলতাবোল কথাকে এখন পাত্তা দিতে গেলে এই সময়টাও নষ্ট যাবে।
” আপনি আগামীকালই চলে যাবেন? ”
” হুম ”
” আপনি পড়তে বসুন৷ আমি ঘুমাই তাহলে? ”
” আমি এখানে পড়তে এসেছি নাকি? ”
” তাহলে বই খাতা নিয়ে এসেছেন যে?”
” ওটা যাস্ট শো । আমি এসেছি তোমার সাথে সময় কাটাতে৷ ”
” আপনি কেমন আছেন?” শাজু আবার প্রশ্ন করলো।
” ভালো, তুমি কেমন আছ?”
” ভালো না ”
” কেন?”
” ঠিক জানিনা। কেনো যেন মনে হচ্ছে সামনে বড় ধরনের বিপদ আছে। ”
” তোমার ভুল ধারণা। ”
শাজু বিরবির করে বলল, ” তাই যেন হয়। ”
হঠাৎ মনে হলো তার কানে কানে কেউ বলল, ” তুই কি ওয়াদার কথা ভুলে গেছিস? ”
চলবে…
~ Maria Kabir